আপনার সুখী গৃহকোণ সাজানোর প্রাথমিক উপকরণ সঠিক বাস্তুজ্ঞান। অন্দরের সাজসজ্জার প্রসঙ্গ আসে তারপরে। ঘরের অবস্থান, দরজার অভিমুখ, আসবাব, সাজ-সরঞ্জাম, আলোর ব্যবহার… অন্দরমহলের বাস্তুশাস্ত্র সঠিক রাখতে এই সবই হওয়া চাই যথাযথ।
শুধু চার দেওয়ালের সমষ্টি নয়। বেঁচে থাকার রসদ তো বটেই, সেই সঙ্গে বাড়ি প্রত্যেকের কাছে একটা আবেগও, যেখানে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো পরিজনদের সঙ্গে উপভোগ করে থাকেন সকলে। আর তাই অন্দর সাজিয়ে তোলার প্রসঙ্গ উঠলেই আমরা বড় বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। কত যত্ন নিয়ে সাজিয়ে তুলি বাড়ির প্রতিটি কোণ! কিন্তু শুধু তো সাজসরঞ্জামটুকুই অন্দরের প্রাণসম্পদ নয়। অন্দর এবং তার বাসিন্দাদের ভাল থাকার সঙ্গে রীতিমতো বিজ্ঞান জড়িয়ে রয়েছে। যার চেনা নাম বাস্তু। এদেশের প্রাচীন বিজ্ঞানগুলোর মধ্যে অন্যতম এই শাস্ত্রের উল্লেখ কিন্তু বেদেও রয়েছে।
প্রকৃতির পাঁচটি তত্ত্ব, অর্থাৎ জল, হাওয়া, মাটি, আগুন আর আকাশ, এগুলোই বাস্তুর আধার। আর বাসস্থানে এই পাঁচটি তত্ত্বের মধ্যে সমতা বজায় রাখাই বাস্তুর উদ্দেশ্য। গ্রহ, চন্দ্র, সূর্যের অবস্থান এবং পৃথিবীর তড়িৎ-চুম্বক ক্ষেত্রের চারিত্রিক ধর্ম মেনে বাড়ি সাজালে তবেই এই পঞ্চতত্ত্বের সমীকরণ ব্যালান্স করা সম্ভব। তবে শুধু ঘরের অবস্থান, রং, আলো বা সাজ-সরঞ্জামই বাস্তুর একমাত্র একক নয়। বাসিন্দাদের উপরও অনেকাংশে নির্ভর করে অন্দরের বাস্তুসাজ। এ বিষয়ে তাই আলাদাভাবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে সার্বিকভাবে কিছু নিয়ম মানতে হলে অন্দর সাজানোর ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখতে পারেন।
অনেকেই বাস্তু এবং ফেং শুইয়ের মধ্যে তফাত করতে পারেন না। সত্যি বলতে, এদেশের পরিবেশ বা বাড়ির পরিকাঠামোয় ফেং শুই কিন্তু অতটাও উপযোগী নয়, যতটা বাস্তুশাস্ত্র। কারণ প্রাথমিক নীতি এক হলেও এই দুই বিজ্ঞানের উৎসগত বিভেদ রয়েছে। সাধারণত, যে বিজ্ঞান যে জায়গায় উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, সেখানেই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হয়। কারণ, সেদেশের রীতি-নীতি, সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে তার সঙ্গে। ফেং শুই বা বাস্তু, যে বিজ্ঞানের কথাই বলি না কেন, প্রতিটার উপযোগিতাই আমাদের অবচেতন মনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। স্বাভাবিকভাবেই এদেশের সংস্কৃতি আমাদের অবচেতনকে যতটা প্রভাবিত করতে পারবে, অন্য দেশের রীতি বা বিশ্বাস ততটাও প্রভাব ফেলবে না। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, বাস্তু মেনে আপনি বাড়িতে ভগবান কুবেরের একটি ছবি রেখেছেন। এর প্রভাব আপনার অবচেতনে যতটা, একটি লাফিং বুদ্ধমূর্তি কিন্তু ততটাও প্রভাবিত করবে না আপনাকে। আর তাই সুফলও পাবেন না।
প্রবেশপথের অভিমুখ নিয়ে অনেকে অনেক রকম মতামত দেন। এর কোনও সত্যতা নেই। বাড়ির অভিমুখ যেদিকেই হোক, তাতে বাস্তুবিধি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। বরং বাড়ির ভিতরের সাজ অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তু সঠিক রাখতে বাড়ির উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাই অন্দরে এই দুই অংশের ব্যালান্স থাকা একান্ত জরুরি।
বাড়ির উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিক যতটা সম্ভব খোলামেলা রাখুন। বড় জানলা রাখতে পারেন। এতে সকালের প্রথম সূর্যরশ্মি ঘরে প্রবেশ করবে এবং ঘরে পজ়িটিভ এনার্জি বাড়বে। একই ভাবে বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ যতটা সম্ভব বন্ধ বা ভরাট রাখার চেষ্টা করুন। দুপুরে সূর্যের তেজ যখন সবচেয়ে বেশি থাকে, তখন সূর্যের অভিমুখ দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ফাঁকা রাখলে এই রশ্মি অন্দরের পজ়িটিভ এনার্জি নষ্ট করে দিতে পারে।
আবার উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কখনও রান্নাঘর বা বাথরুম রাখা উচিত নয়। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রবেশপথও না রাখা শ্রেয়।
বেডরুমের অবস্থান নির্ণয় করার ক্ষেত্রে ঘরে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের পেশার কথা মাথায় রাখতে হবে। যেমন, কেউ যদি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকেন, সেক্ষেত্রে পশ্চিমমুখী বেডরুম তাঁর জন্য শুভ। ম্যানুফ্যাকচারিং সংক্রান্ত ব্যবসার ক্ষেত্রে আবার দক্ষিণমুখী বেডরুম থাকা ভাল। ক্রিয়েটিভ কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও পশ্চিমমুখী বেডরুম বেছে নিতে পারেন।
শোবার সময় মাথা দক্ষিণমুখী বা পূর্বমুখী রাখা শুভ। প্রাপ্তবয়স্ক বা চাকরিরত ব্যক্তিদের জন্য দক্ষিণ অভিমুখে মাথা রেখে শোওয়া ভাল। ছোটদের জন্য পূর্বদিক বেশি শুভ। যদি একান্তই পূর্ব বা দক্ষিণমুখী হয়ে শোওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে পশ্চিমমুখীও শুতে পারেন। তবে উত্তরদিকে মুখ করে কখনওই শোবেন না।
ছোটরা যেখানে পড়াশোনা করছে, সেই অংশের বাস্তুও গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা আইন নিয়ে পড়াশোনা করছে, তাঁদের স্টাডি টেবল দক্ষিণমুখী হওয়া শুভ। আইটি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা কম্পিউটার সংক্রান্ত পড়াশোনার ক্ষেত্রে পশ্চিমদিকে মুখ করে পড়তে বসলে ভাল।
বাড়ির চারপাশে খুব বেশি নেগেটিভ এনার্জি যেন না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। বাড়ির আশেপাশে কোনও হাসপাতাল বা শ্মশান বা এই ধরনের কিছু না থাকাই বাঞ্ছনীয়। এমনকী মন্দির বা কোনও ধর্মীয় স্থানের পাশেও বাড়ি করা উচিত নয়। এমনিতে এই ধরনের স্থান পবিত্র হলেও এখানে পজ়িটিভ এনার্জি এতই বেশি যে, তা মানবশরীরের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই বাড়ি করার সময় এই ধরনের নির্মাণ এড়িয়ে চলুন।