আষাঢ় মাস এলেই ওড়িশার পুরী শহরের আকাশ যেন এক অন্য আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চারিদিকে শোনা যায় শঙ্খধ্বনি, লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামে, আর কন্ঠে শুধু ‘জয় জগন্নাথ’। কারণ, এ সময়ই হয় বিশ্বের অন্যতম বড় উৎসব — জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। রশি টানার আনন্দ আর গায়ে ছুঁয়ে যাওয়া ধুলোর মধ্যে ভক্তরা যেন খুঁজে পায় ঈশ্বরের স্পর্শ। তবে এই উৎসবের কেন্দ্রে নিঃশব্দে মানুষের আত্মাকে ছুঁয়ে যায় জগন্নাথের ‘মহাপ্রসাদ’।

মহাপ্রসাদ মানে শুধু ভোগ নয়, এটি এক অনন্ত আশীর্বাদ। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে প্রতিদিন যে অন্নভোগ প্রস্তুত হয়, সেটিই মহাপ্রসাদ। একে বলা হয় ‘অন্নব্রহ্ম’, কারণ বিশ্বাস করা হয়, ভগবান স্বয়ং এই ভোগ গ্রহণ করেন এবং তারপর তা ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
ইতিহাস ও অলৌকিক সূচনা
- লোককথা অনুযায়ী, জগন্নাথ স্বপ্নে এক সাধুকে আদেশ করেন— ‘আমার জন্য ৫৬ রকমের ভোগ প্রস্তুত করো, আমি প্রতিদিন তা গ্রহণ করব।’ সেই থেকেই শুরু।
- আর রান্না কে করেন জানেন? বলা হয়, স্বয়ং মা লক্ষ্মী-ই মন্দিরের ভিতরে প্রতিদিন ভোগ রান্না করেন।
- পুরাণ মতে, একদিন মা লক্ষ্মী রুষ্ট হয়ে মন্দির ত্যাগ করেন। আর সেদিন রান্না শুরু হলেও কোনও হাঁড়ির খাবার সেদ্ধ হচ্ছিল না। তখন দেবতারা বুঝতে পারেন, রান্নায় শুধু উপকরণ নয়, ঈশ্বরীয় অনুগ্রহ আবশ্যক।
- এই কাহিনি থেকেই জন্ম নেয় মহাপ্রসাদের মাহাত্ম্য – যেখানে রান্না হয় মানুষের হাতে, কিন্তু তা সিদ্ধ হয় ভগবানের আশীর্বাদে। তাই কখনও ভোগে স্বাদের কমতি হয় না, আর রান্নাও অসম্পূর্ণ থাকে না।

কোথায় ও কীভাবে তৈরি হয়?
- পুরীর শ্রীমন্দিরে জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ প্রস্তুত হয় অত্যন্ত নির্ধারিত নিয়মে, ভক্তি ও শাস্ত্রের নির্দেশ মেনে। রান্না হয় মন্দিরের ভিতরে অবস্থিত ‘রোসা ঘর’ বা ‘রন্ধনশালা’-তে। যা বিশ্বের বৃহত্তম হিন্দু রান্নাঘর বলে বিবেচিত। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৫০০টি মাটির হাঁড়িতে রান্না হয়। একেবারে প্রাচীন পদ্ধতিতে, কাঠের আগুনে।
- এই রান্নার সবচেয়ে অলৌকিক দিক হল – একসঙ্গে ৭, ৯ বা ১১ টি হাঁড়ি একটির উপর একটি রেখে রান্না করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যভাবে, উপরের হাঁড়ির খাবার আগে সেদ্ধ হয়, তারপর নিচের হাঁড়ির। বিজ্ঞানের নিয়ম এখানে ব্যর্থ, আর ভক্তি এখানে বিজয়ী।
কী কী থাকে এই ভোগে?
- মহাপ্রসাদের ৫৬ ভোগের মধ্যে প্রধান কিছু ভোগ হলো— টাটা খিচুড়ি, বানপানা, নাড়িয়া কোরা (নারকেল নাড়ু), খুয়া (খোয়া ক্ষীর), পাচিলা কাঁড়ালি (টুকরো করা কলা), কণিকা (সুগন্ধী ভাত), মেন্ধা মুন্ডিয়া (বিশেষ ধরনের কেক), বড়া কান্তি (বড় কেক), মুগ ডালের হালুয়া, কদলি বড়া, ছুন্না পায়েস, পাত্রপাক, শাক, তরকারি, পিঠেপুলি আর নানা রকম মিষ্টান্ন।
- সব ধর্মের মানুষ এই মহাপ্রসাদ গ্রহণ করতে পারেন। এখানে জাতপাতের কোনও স্থান নেই।

প্রচলিত বিশ্বাস
বলা হয়- ঝড় যত বড়ই হোক, রান্নার আগুন কখনও নেভে না। একবার ঘূর্ণিঝড়ের সময় পুরো শহর অন্ধকারে ডুবে যায়, কিন্তু মন্দিরের রোসাঘরে আগুন জ্বলতেই থাকে। কারণ, রান্না থেমে গেলে ভগবানের ভোগ হবে না, আর সেটা অসম্ভব।
জগন্নাথের রথযাত্রা কেবল এক উৎসব নয়, এটি এক জীবন্ত চেতনা। আর মহাপ্রসাদ হল সেই চেতনারই খাদ্যরূপ। হাজারও মানুষের মুখে যে খাবার পৌঁছোয়, তা শুধুই ভোগ নয়, এক অলৌকিক অনুভব। যারা একবার এই ভোগ গ্রহণ করেন, তাদের হৃদয়ে রথের ঘন্টার শব্দ আর প্রসাদের স্বাদ চিরকাল থেকে যায়।