Spread the love

‘হটাৎ করেই ভাবতে বসি
মুষল ধারে বৃষ্টি হবে
শুকিয়ে যাওয়া আমার শহর
আবার বসে ভিজবে কবে…।’

প্রদীপ বালার ‘যে বৃষ্টির অপেক্ষায় বসে’ কবিতার এই কটা লাইনই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে মনের মধ্যে। সময় বলছে বর্ষা। কিন্তু প্রকৃতি দেখে তা বোঝার উপায় নেই। কলকাতার প্যাচপ্যাচে গরম থেকে মিলছে না রেহাই। তাই মন বলছে পাহাড়। কিন্তু বর্ষায় পাহাড়! ভেবেই ভয় লাগছে তো? যে পাহাড়কে আপনি বারবার দেখেছেন বসন্তে বা শীতে, দেখবেন বর্ষা তাকে দিয়েছে এক্কেবারে অন্য রূপ। পাহাড়ি গ্রামে খরস্রোতা নদীর বুকে সময় কাটাতে চান? কান পেতে শুনতে চান ঝরনার গর্জন? হাঁটতে চান সবুজে ঘেরা পাহাড়ি রাস্তায়? পরিবার বা প্রিয় মানুষের সঙ্গে কিছু মুহূর্ত কাটাতে চান মেঘের কোলে? তাহলে বেরিয়ে পড়ুন। পিঠে নিন একটি ট্রাভেল ব্যাগ। প্রয়োজন নেই শীতের পোশাক। আগে থেকে টিকিট কাটা না থাকলে তৎকালে কেটে নিন। আর হোটেল বুকিং? সেসব তো এখন বাড়ি বসে অনলাইনেই করে নিতে পারবেন। ইন্টারনেটে পপুলার কোনও ট্রাভেল ওয়েবসাইটে গিয়ে ঝটাপট বুকিং করুন। কিন্তু যাবেন কোথায়! বলছি…

কোথায় যাবেন  

নাকের ডগায় কম খরচে পাহাড় বলতেই মনে আসে দার্জিলিং, সিকিম কিংবা কালিম্পং। কিন্তু আজ, শহুরে কোলাহল শূন্য একটি পাহাড়ি গ্রামের সন্ধান দেব, যেটা কালিম্পংয়ের একদম শেষে অবস্থিত। নামতে হবে এন.জে.পি বা শিলিগুড়ি স্টেশনে। এন.জে.পি থেকে বাস বা শেয়ার কার পাবেন আর শিলিগুড়ি স্টেশন থেকে বেরিয়ে দু-চার পা হেঁটেই বাসস্ট্যান্ড। কালিম্পং যাওয়ার অনেক বাস পাবেন, ভাড়া ১৫০ টাকা জন প্রতি। তবে পৌঁছাতে পাঁচ-ছয় ঘন্টা সময় লাগাবে। অন্যথায় টোটো নিয়ে চলে যান পানিট্যাঙ্কি মোড়। ওখান থেকে পেয়ে যাবেন কালিম্পং যাওয়ার শেয়ার কার। ভাড়া ২০০ টাকা করে। NH10 হয়ে গেলে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। সেবক রোড ধরে কিছুটা যেতেই দেখতে পাবেন উপরে শীতল মেঘ আর নিচে বয়ে চলেছে উত্তাল তিস্তা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবেন কালিম্পং স্ট্যান্ডে। ওখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে মেঘের চাদর জড়িয়ে এক ঘন্টায় পৌঁছে যাবেন দুন ভ্যালি। গাড়ি হোম-স্টে নিয়ে যাবে রেলি নদীর উপর দিয়ে। এ যেন, এক টুকরো ভয়ের সঙ্গে অনেকখানি রোমাঞ্চ। গাড়ির বাইরে পা রাখতেই এক শীতল হাওয়া খেলে যাবে শরীরে। নিরিবিলি, মনোরম পরিবেশ। উপরের দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন বর্ষার পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য। সাদা মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। সেখান থেকে ছিটেফোঁটা জল এসে পড়ছে মুখের উপর। চোখ সরাতে পারবেন না।

কী কী দেখবেন

রেলি নদীঃ কিছুটা সময় কাটাতে পারেন রেলি নদীর ধারে। হোম-স্টে থেকে দু পা ফেলতেই নদী। তখন ‘নদী আপন বেগে পাগলপারা…’। জলে পা ঝুলিয়ে দিতেই হিমেল স্পর্শ খেলে যাবে মনে। কুলুকুলু ধ্বনি শুনে কাটিয়ে দিতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দু’দিকের পাহাড় আর মাঝখানের নদী যেন ছুঁয়েছে ওই আকাশকে।

হ্যাঙ্গিং ব্রিজঃ নদী ছাড়াও পারাপারের আরও একটি রাস্তা হল হ্যাঙ্গিং ব্রিজ। এটা দিয়ে হেঁটে দুন ভ্যালিতে আসতে পারবেন। মজার বিষয়, ব্রিজের এপারে  দুন ভ্যালি আর ওপারে বিদ্ব্যাং ভ্যালি। ব্রিজের উপর থেকে পুরো ভ্যালির ভিউটা দেখতে পাবেন।

ঝরনাঃ মূল আকর্ষণ হল ঝরনা। ভ্যালি থেকে হাঁটা পথে ২ মিনিট দূরত্বে একটু উঁচুতে আছে একটি ঝরনা। দুই দিকে জঙ্গল। তার ঠিক মাঝখানের রাস্তা দিয়ে গেলেই পৌঁছে যাবেন। রাস্তা দেখলেই বুঝতে পারবেন মানুষের আনাগোনা আছে এদিকে। ঝরনায় অবশ্যই স্নান করবেন। পাহাড়ের উপর থেকে পড়া ঝরনার জল দেখে মন ভরে যাবে। গর্জনে সাময়িক ভয় লাগলেও হাত ছোঁয়াতেই দেখবেন সব ভয় নিমেষে গায়েব। আহা, কী ঠান্ডা জল। কত শান্তি!

কোথায় থাকবেন

হোম-স্টেঃ ঘুরতে গেলেই থাকার জায়গা নিয়ে একটা বড় চিন্তা থাকে। এখানে থাকবেন দুন ভ্যালি নেচার রিট্রিট-এ। হোম-স্টেগুলি কাঠের তৈরি। মোটামুটি সব রুম থেকেই আপনি প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে পারবেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।  ফ্যান আছে, আয়না আছে, ওয়াশরুমেও পাবেন গিজার। জানলা খুললেই পাহাড়। সকালবেলা ঘুম ভাঙবে মোরগের ডাকে। আর সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছে সেজে আছে চারিদিক।

কী খাবেন

লোকাল খাবারঃ হোম-স্টে-র মালিকের একইসঙ্গে রয়েছে চাষবাস আর পশুপালন। তাই ওরা নিজেরাই দই, পনীর, লোকাল চিজ ‘ছুরপি’ বানায়। লোকাল শাককে ড্রাই করে স্টোর করে রাখে স্যুপ বানানোর জন্য। মোমো তো আছেই। ওদের লোকাল একরকম চিকেন পাওয়া যায় যেটা পোলট্রির থেকে আলাদা। নদীর মাছ খুব বড় হয়না। তাই মাছের চল কম। এক ধরনের কালো ডাল পাওয়া যায় যার নাম ‘ব্ল্যাক লেন্টিলস’। ওরা ভুট্টার চাষ করে, যেটা দিয়ে রুটি বানায়। এছাড়া ‘গুনরুক’ নামে একটি পানীয় পাওয়া যায়।

বাঙালি খাবার তো আছেই। সকালে চা বিস্কুট। ব্রেকফাস্টে প্রতিদিন লুচি তরকারি। লাঞ্চে ভাত, ডাল, সবজি, ডিম, পাঁপড় ইত্যাদি। সন্ধ্যেয় চা আর ডিফারেন্ট স্ন্যাক্স। আর রাত্রে চিকেন, রুটি। অপশনে থাকবে ভাতও। পছন্দমতো খাবার পেয়ে যাবেন। রান্না খেয়ে মনে হবে যেন বাড়িতেই খাচ্ছেন। আর ওদের আতিথেয়তাও খুব ভাল।

খরচ

বাজেট কম হলেও আপনি যেতে পারবেন এখানে। থাকা-খাওয়া মিলিয়ে মাথাপিছু ১৫০০ টাকা প্রতিদিন। এই খরচে এতকিছু, ভাবতে পারছেন?

মাত্র দুদিনের ছুটিতেও ঘুরে আসতে পারেন এখান থেকে। পাহাড় হচ্ছে একমাত্র জায়গা যেখানে গেলে সুখ ও শান্তি দুটোই খুঁজে পাওয়া যায়।  শহুরে পাহাড় তো অনেক হল। পাহাড় যে, প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের উপহার সেটা বুঝতে হলে আপনাকে একবার না একবার যেতেই হবে এমন একটি পাহাড়ি নিরিবিলি গ্রামে। আর তা যদি হয় বর্ষাকালে, তাহলে এক বিরল অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে পারবেন।

Related Posts