‘পান্তাভাত’ – বাংলার অতি পরিচিত অথচ গভীর আবেগে মোড়া এক খাদ্যসংস্কৃতি। গরম ভাত যখন থেকে ঠান্ডা হয়ে যায়, সেই ভাতকেই পরদিন জল দিয়ে ভিজিয়ে খাওয়ার যে ঐতিহ্য – এ যেন বাঙালির এক চমৎকার কৌশল। কিন্তু বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে এই জলে-ভেজা ভাতের গল্প বদলে যায় নামে, রীতিতে, স্বাদে ও পরিবেশনে। চলুন ঘুরে দেখা যাক, বাংলার কোথায় কেমন পান্তা খাওয়া হয়।

অঞ্চলভেদে পান্তার রীতি ও নামঃ
১। ওড়িশাঃ-
নাম – পখালা ভাত। একটি ওড়িয়া রন্ধনপ্রণালী, যা জলে ধুয়ে বা হালকাভাবে গাঁজানো ভাত নিয়ে গঠিত। খাদ্যটির তরল অংশটি ‘তোরাণী’ নামে পরিচিত।
রীতি –
- অনেকে এটি সারা বছর ধরে খান, বিশেষত মধ্যাহ্নভোজের জন্য।
- ওড়িশায় প্রতিবছর ২০ মার্চ ‘পখাল দিবস’ পালন করা হয় পান্তাভাতের জনপ্রিয়তাকে উদযাপন করতে।
পরিবেশন –
- ভাত ঠান্ডা করে সারারাত ভিজিয়ে রাখা হয়। পরের দিন সকালে সরষের তেল, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ কুচি, দই, শসা, জিরে ফোড়ন আর পুদিনা পাতার সাথে জল মিশিয়ে খাওয়া হয়।
- এটি জনপ্রিয়ভাবে শুকনো ভাজা শাকসব্জী যেমন আলু, বেগুন, বড়ি এবং শাক ভাজা বা ভাজা মাছের সাথে পরিবেশন করা হয়।

২। পশ্চিম মেদিনীপুরঃ-
নাম – ঠান্ডা ভাত/ভেজা ভাত।
রীতি –
- পশ্চিম মেদিনীপুরে কৃষিপ্রধান পরিবারগুলোর মধ্যে গ্রীষ্মকালীন ভোর বা দুপুরবেলার অন্যতম সস্তা ও উপকারী খাদ্য হল ভেজা ভাত।
- মাঠে কাজ করতে যাওয়ার আগে শরীর ঠান্ডা রাখতে সকালের দিকে এই ভাত খাওয়ার রীতি এখনও প্রচলিত।
পরিবেশন –
- রাতের রান্না করা ভাত মাটির হাঁড়িতে রেখে তার মধ্যে ঠান্ডা জল ঢেলে দেওয়া হয়। ভাত ভিজে গেলে সকালে সরাসরি খাওয়া হয়।
- এখানে পান্তাভাতের সঙ্গে খাওয়া হয় – পোড়া আলু ভর্তা, কচু পাতার ভর্তা বা দুধ কচুর ভর্তা, ডাল ভর্তা, শুটকি ভাজা (বিশেষ দিনে), কাঁঠাল বীজ পোড়া ভর্তা, পোড়া কুমড়ো বা উচ্ছে দিয়ে ভর্তা।

৩। আসামঃ-
নাম – পইতা ভাত।
রীতি –
- আসামের কৃষক সমাজে পইতা ভাত গ্রীষ্মকালীন সকালে খাওয়ার অত্যন্ত পরিচিত রীতি।
- বিহু উৎসবের সময়, বিশেষ করে বোহাগ বিহু-তে অনেকে ঘরে ঘরে পইতা ভাত পরিবেশন করেন।
- আসামে পইতা ভাত খাওয়ার সময় এক ধরনের টক স্বাদের লেবু (কাজি নিম্বু) ব্যবহার হয়। অনেক বাড়িতে আবার “লুংরি ভাত” নামেও পরিচিত।
পরিবেশন –
- রাতের রান্না করা ভাত মাটির বা স্টিলের পাত্রে রেখে তাতে জল ঢেলে ঢেকে রাখা হয়। সকালে হাত দিয়ে ঘেঁটে খাওয়া হয়।
- এখানে পইতা ভাতের সঙ্গে খাওয়া হয় – মাচর টেঙ্গা (টক দিয়ে রান্না করা ছোট মাছ), মিটকা বা নাকু কচু পাতার ভর্তা, পোকুরি মাছ ভাজা বা পুড়া মাছ, শুঁটকি মাছের ভর্তা, মিঠা তেল বা “থেল” নামের সরষে তেলের ঘ্রাণ দেওয়া ভর্তা।
৪। ঝাড়গ্রাম ও বাঁকুড়াঃ-
নাম – পোহো ভাত।
রীতি –
- এই অঞ্চলের আদিবাসী ও গ্রামীণ সমাজে পোহো ভাত একটি দৈনন্দিন খাদ্য।
- বর্ষাকাল বা আষাঢ়-শ্রাবণের দিনে, মাঠে কাজ করার আগে সকালের খাবার হিসেবে এই পান্তা খাওয়ার রীতি রয়েছে।
- বিশেষ করে হুল দিবস, করম পূজা, বা সরনা উৎসবের দিনেও এই খাবার পরিবেশিত হয়।
পরিবেশন –
- সাধারণত রাতের রান্না করা ভাত মাটির হাঁড়িতে রেখে জল ঢেলে ঢাকা দিয়ে রেখে দেওয়া হয়। সকালে সেটি হাত দিয়ে ভেঙে, হালকা নুন দিয়ে খাওয়া হয়।
- এখানে পোহো ভাতের সঙ্গে খাওয়া হয় – রসুন-লঙ্কা বাটা, শালপাতা বা বনজ শাক ভর্তা, বাঁশকচুর ভর্তা (মশলা দিয়ে বাটানো), ছোট মাছ পোড়া বা ভাজা, ছাতু বা কুঁড়ের ভর্তা, উড়াদ ডালের বড়া ভাজা।
বাংলার প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এই পান্তার রঙ, রূপ, রীতি আমাদের শেখায় – ‘একই ভাত, তবু কত বৈচিত্র্য’। পান্তা তাই শুধু পুষ্টিকর নয়, সাংস্কৃতিক ভাবেও অমূল্য।
পশ্চিম মেদিনীপুরে কৃষিপ্রধান পরিবারগুলোর মধ্যে গ্রীষ্মকালীন ভোর বা দুপুরবেলার অন্যতম সস্তা ও উপকারী খাদ্য ছিল ভেজা ভাত। মাঠে কাজ করতে যাওয়ার আগে শরীর ঠান্ডা রাখতে সকালের দিকে এই ভাত খাওয়ার রীতি এখনও প্রচলিত।