‘সব শুরু হোক শুভ, আর যা শুরু হবে, তা কখনও শেষ না হোক’ – এই বিশ্বাসেই আসে অক্ষয় তৃতীয়া। বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিতে উদযাপিত এই দিনটিকে ‘অক্ষয়’ অর্থাৎ ‘অমর’ বা ‘যার ক্ষয় হয় না’ বলে মানা হয়। হিন্দু পুরাণে বিশ্বাস করা হয়, এই দিনেই ত্রেতাযুগের সূচনা হয়, পরশুরামের জন্ম ও ব্যাসদেবের মহাভারত রচনার শুরু হয়েছিল। তাই বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে এই শুভ তিথির দিনটিতে শুধু ধর্মীয় নয়, ভিন্ন ভিন্ন লোকাচার, রীতি এবং বিশ্বাস লক্ষ করা যায়, কিন্তু হৃদয়ে থাকে একই প্রার্থনা – ‘অক্ষয় হোক সুখ আর সমৃদ্ধি’।

বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকাচার ও রীতিঃ
১। ধর্মীয় আচার ও রীতি –
- অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে ভগবান বিষ্ণু, গণেশ, লক্ষ্মী ও দেবী অন্নপূর্ণার পূজা বহু অঞ্চলে প্রচলিত।
- কেউ কেউ পরশুরাম জয়ন্তী হিসেবেও এই দিনটিকে পালন করেন।
- দেবতার পূজার পাশাপাশি অনেক পরিবারে ঠাকুরঘরের কুলদেবতার পূজা হয়, যেখানে চাল, ফুল, ফল ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়।

২। ব্যবসায়ীদের শুভ সূচনা –
- এই দিনটিকে ‘সদা শুভ’ বলে মনে করা হয় বলে বহু ব্যবসায়ী এই দিনে হালখাতা বা নতুন হিসাব খাতা খুলে থাকেন।
- আগে জমিদাররাও এই দিনেই খাজনার খাতা খুলতেন।
- এখনও বহু স্থানে মিষ্টি বিলি, দোকান পরিষ্কার, নতুন খাতা বা পেন কেনার প্রথা প্রচলিত।

৩। সোনা কেনা ও গয়না পরিধান –
- এই দিনটিতে সোনা, রূপো বা মূল্যবান ধাতু কেনাকে কল্যাণময় ও শুভ বলে মনে করা হয়।
- নারীরা নতুন গয়না পরে, ঘরের শুদ্ধতা রক্ষা করেন এবং গৃহদেবতার কাছে সমৃদ্ধি কামনা করেন।

৪। কৃষিজীবী সমাজের সংস্কার –
- দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের বহু কৃষিপ্রধান গ্রামে এই দিনে বীজ বপনের প্রথা রয়েছে। জমিতে প্রথম বীজ বপন করে কৃষকেরা প্রার্থনা করেন যেন তাদের ফসল চিরকাল অক্ষয় থাকে।
- কোথাও কোথাও এই দিনটিকে কেন্দ্র করে ছোট মেলা ও গাঁয়ের হাট বসে।
৫। খাদ্যসংস্কৃতি ও উৎসর্গ –
বহু জায়গায় এই দিনে পান্তা ভাত, কাঁচা আম, দই, চাল, ফল ইত্যাদি মাটির পাত্রে রেখে দেবতাকে উৎসর্গ করা হয়। এটি ‘পূরণ পূজা’ নামেও পরিচিত, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে। অনেকেই এরপর এই পান্তা খেয়ে দিন শুরু করেন।

৬। আঞ্চলিক ভিন্নতা –
- বর্ধমান ও হুগলি – কুলদেবতার পূজা এবং চাল-জল উৎসর্গের রীতি।
- চব্বিশ পরগনা – মা বাসন্তীর বিশেষ পূজা ও মন্দিরে যাত্রা।
- নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ – গৃহদেবতার পূজা, নতুন কাপড় পড়া ও মিষ্টি বিতরণ।
- উত্তরবঙ্গ – দেবতাপূজা, পূরণ প্রসাদ, ও বীজ বপনের শুভ লগ্ন।
সময় বদলালেও এই দিনের তাৎপর্য ও লোকাচার আজও বাঙালির জীবনে বহমান। আঞ্চলিক ভিন্নতা থাকলেও মূল ভাব একটাই—এই দিন হোক অক্ষয় কল্যাণময়, চিরস্থায়ী সমৃদ্ধির প্রতীক।