Spread the love

ভোর ৫ টা বেজে ১০ মিনিট। গ্রামের রাস্তা। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশার সাদা অন্ধকার চারপাশে গিজগিজ করছে। ডিসেম্বরের শুরুর সময়ে নদীয়ার আদিত্যপুরে এই ভোরবেলায় যেন এক রূপকথার রাজ্য তৈরি হয়। একটা মিষ্টি গন্ধ আর শিরশিরানি ঠান্ডা হাওয়া যেন কানের পাশে ফিশফিশ করে বলে যায়, ‘ওহে নাগরিক! গাঁয়ের মেঠো পথের আনাচে কানাচে আমি আজও বেঁচে থাকি। চিনতে কি পারো আমায়?’ কোনও এক অতল গহ্বর থেকে শৈশব উত্তর দেয় – ‘এ গলা তো চেনা। এ তো হেমন্তের গলা!’

হঠাৎ-ই কুয়াশার চাদর ভেদ করে এক আবছা মূর্তি ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে চোখের সামনে। এগিয়ে আসছেন এক প্রৌঢ়। মাটির হাঁড়ির ভাড়ে শরীর সামান্য ঝুঁকে পরেছে। অজানা এক মেঠো গান আপন মনে গুনগুন করতে করতেই পার হয়ে যান তিনি। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি খেজুর গাছ। আর প্রতিটি খেজুর গাছেই গর্বের কন্ঠহার হিসাবে ঝুলছে মাটির হাঁড়ি। ক্ষীণ অথচ মিষ্টি ‘টুপ-টাপ’ শব্দে মেতে উঠেছে প্রকৃতি। এমন সময় চোখ চলে গেল এক বৃদ্ধের দিকে। না রাস্তায় নয়, তিনি ঝুলে রয়েছেন খেজুর গাছের মাথায়। গাছের নীচে রাখা ১০-১২ টি মাটির হাঁড়ি। কিছুটা অপেক্ষা করতেই নেমে এলেন তিনি। একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্যই গাছের গোড়ায় বসে পড়লেন। বুকের ঘন ঘন ওঠা-পরা দেখে অনুমান করা যায় তাঁর পরিশ্রমের কথা। আর ইতস্তত না করে সামনে এগিয়ে ‘একটু বসতে পারি এখানে?’ জিজ্ঞাসা করায় তাঁর ঘোলাটে একজোড়া প্রশ্নমাখা চোখ দেখা গেল।

একটু পরেই জমে ঊঠল আলাপ। তাঁর নাম মাধব বিশ্বাস। বয়স ৬৭ বছর।

– ‘এটাই আমার শেষ বছর বাবু। আজকাল গাছে উঠলে পা কাঁপে। যে কোনও দিন গাছ থেকে পরে যেতে পারি। আর শরীর দেয় না। এ বছর মাত্র ৩৫ টা গাছের ইজারা নিয়েছি।’

কথাগুলো বলতে বলতে তিনি উঠে দাঁড়ান। কাঁধে ঝুলিয়ে নেন টাটকা খেজুর রস ভর্তি মাটির হাঁড়িগুলো। সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতেই কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বলে ওঠেন, ‘থাক বাবু, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। কাল তো সেই একাই তুলতে হবে। অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে।’ ততক্ষণে কুয়াশার ঘনত্ব কিছুটা পাতলা হয়েছে। রাস্তায় বেড়েছে লোকজনের সংখ্যা। বেশিরভাগ মানুষের কাঁধেই মাটির হাঁড়ি। পুব আকাশ থেকে একদলা রোদ্দুর ভিজিয়ে দিয়ে গেল আচমকাই।     

-‘সাত পুরুষ ধরে আমরা নলেন গুঁড় তৈরি করি। আমার দাদু ছিল এই এলাকার শ্রেষ্ঠ শিউলি। তাঁর হাতে গাছ কাটা পরলে যেন খেজুরের রসে মিষ্টি আরও বেড়ে যেত। খেজুরের এই সময়টা আমাদের বাড়ি গমগম করত। দাদু আর বাবা খেজুরের রস নিয়ে আসত সকালবেলা। অন্যদিকে ঠাকুমা আর মা উঠোনে উনুন পরিষ্কার করে রাখতো। ওরা ফিরলেই শুরু হত গুড় বানানোর কাজ। যেন একটা মহাযজ্ঞ শুরু হত।’

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে মাধব বাবুর বাড়ি এসে গেছে টেরই পাওয়া যায় নি। কাধেঁর ভার নামিয়ে তিনি মাটিতে বসে পড়লেন মাটির বাড়ির দালানে। পরিচয় হল তাঁর পরিবারের সঙ্গে। খেজুর পাতায় বানানো চাটাই-তে বসে শুরু হল আবার কথোপকথন। উঠোনে নিকানো উনুনে জ্বলে উঠিল আগুন।

-‘খুব ছোটবেলায় দাদুর মুখে গল্প শুনতাম, কার্তিক সংক্রান্তির পরের দিন ভোরে খেজুর গাছে হাড়ি বাঁধা হত। তারপর একটা মাঠে সারাদিন ধরে তৈরি হত গুড়। এই দিনের গুড় বাজারে বিক্রি হত না। ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে খেজুরের রস, গুড় খেত। আবার পাটালিও তৈরি হত। এমনকি ছোটখাটো মেলাও বসত ওই দিনে। নলেন গুড়কে তখন বাবুরা বলত তরল সোনা। আর আজ?’ কথাগুলো বলতে বলতে মাধব বিশ্বাসের চোখ অল্প চিকচিক করে ওঠে। কাঁধে পরে থাকা গামছার খুঁট চলে যায় চোখের কোণায়। এমন সময় মাধব বাবুর বড়ো বউমা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় মুড়ি আর নারকেল দিয়ে গেলেন দুজনকেই। সঙ্গে এক বাটি নলেন গুড়।

– ‘আমার দুই ছেলেই বংশের পরম্পরা ধরে রাখতে চায় নি। বড় ছেলে থাকে সুরাটে। টেন পাশ করেই চলে গেছে সোনা-রুপোর কাজ করতে। বছরে দু’বার বাড়িতে আসে। ভালোই কামায়। আর ছোটোটা, গেল বছর একটা টোটো কিনেছে। অনেক সেধেছিলুম দু’জনকেই। অন্তত গাছ কাটাটা শিখে রাখতে পারত। যে কারণে আমাদের পরিবারের এত হাঁকডাক ছিল, সেটাই আর থাকবে না।’ আমার জিজ্ঞাসু দু’টি চোখ দেখে এবং বুঝতে পেরে তিনি নিজেই বলে উঠলেন, ‘ভালো শিউলি হোয়া অত সোজা নয় গো বাবু। বংশের পর বংশ ধরে বাবা-কাকাদের থেকে আমরা শিখি এই পদ্ধতি। প্রথমে সারা বছর ধরে জমে থাকা খেজুর পাতা নীচ থেকে কেটে সাফ করতে হয়। এটাকেই আপমরা গাঁয়ের লোকেরা গাছ কাটা বলে থাকি। এবার পাতার ঠিক নীচে ধারালো কাটারি দিয়ে চেঁচে নরম করতে হয়। আর এই জায়গাটাই সবথেকে কঠিন। এরপর ওই নরম জায়গায় আলতো করে গুঁজে দিতে হয় বাঁশের সরু কঞ্চি। কঞ্চির ফাঁপা নলের গোড়ায় বাঁধতে হয় হাঁড়ি। সারা রাত ধরে ফোঁটায় ফোঁটায় জমতে থাকে রস।’

ততক্ষণে উনুনে কড়াই চেপেছে। ধীরে ধীরে ফুটতে শুরু করেছে খেজুরের রস। বাড়ির তিন বউ যোগ দিয়েছেন নলেন গুড় তৈরির শেষ ধাপে। কাঠের জ্বালানিতে মাটির উনুনে প্রস্তুত হচ্ছে গুড়। একটি বিশেষ ধরণের হাতা সর্বক্ষণ নাড়িয়ে চলেছেন মাধব বাবুর ছোট বউমা। মূলত নারকেল মালার অর্ধেক অংশে লম্বা কাঠ লাগিয়ে এই হাতা তৈরি করা হয়েছে। আর গুড় তৈরির এই ধাপেই লুকিয়ে থাকে নলেন গুড়ের আসল স্বাদ।

আবার শহরে ফেরা। ট্রেন ছুটে চলেছে ঝমঝম শব্দে। চোখের সামনে খোলা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গৌড় মল্লার’। হঠাৎ-ই চোখ আতকে গেল কয়েকটি লাইনে – ‘এই গুড়ই দেশের প্রাণবস্তু; গুড় হইতেই দেশের নাম গৌড়। আভীরগণ ঘৃত নবনী ও গুড় ভারে বহন করিয়া মৌরীর তীরপথ ধরিয়া ভিন্ন গ্রামে যায়, কখনও বা কর্ণসুবর্ণ পর্যন্ত উপস্থিত হয়। … ইহাই বাংলা দেশের খাটি সোনা। বাংলার গ্রামে গ্রামে এই সোনা উৎপন্ন হইয়া অর্ধেক পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়ে এবং ধাতব স্বর্ণ হইয়া ফিরিয়া আসে।’ অজান্তেই চোখ চলে যায় পাশে রাখা মাটির হাঁড়িটির দিকে। মাধব বাবু আসার সময় দিয়েছিলেন সদ্য বানানো নলেন গুড়। হাঁড়িটি তখনও গরম।   

About Author
Adwitiya Magazine
View All Articles
Check latest article from this author !
নিউ ইয়ার পার্টি লুক
ফুলকপি ঘি রোস্ট
ফুলকপির যত গুণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *