পয়লা বৈশাখ বা বাংলার নববর্ষ, বাঙালিদের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এটি শুধুমাত্র নতুন ক্যালেন্ডার বছরের সূচনা নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সামাজিক জীবনের এক গৌরবময় প্রতীক। ‘নব’ অর্থ নতুন, আর ‘বর্ষ’ অর্থ বছর- নববর্ষ মানেই নতুন বছরের আগমন।

পয়লা বৈশাখের উৎপত্তি
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবি বছর হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী তারা কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করত।
কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সঙ্গে এর কোনও মিল পাওয়া যেত না। আর তখনই সম্রাট আকবর এর সুষ্ঠ সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌরবছর ও আরবি হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরির কাজ শুরু করেন।
তৈরি হয় নতুন ক্যালেন্ডার — যেটি আমরা আজ বাংলা সন হিসেবে চিনি। এই ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সালের শুরু হয়।

বাংলা মাসের নামকরণ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলা মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকারাজির নাম থেকে নেওয়া হয়েছে।
যেমন- বিশাখা থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠ্যা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পূষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
আগেকার দিনে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হতো বলে এ মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। তাই এ মাসের নামই রাখা হয় অগ্রহায়ণ। ‘অগ্র’ অর্থ প্রথম আর ‘হায়ণ’ অর্থ বর্ষ বা ধান।

নববর্ষ উদযাপনের রীতি
জানা যায়, নববর্ষের দিনে কৃষকরা খাজনা মেটাতে জমিদারদের বাড়িতে যেতেন, সেখানে আয়োজন হতো মিষ্টিমুখ, পান-সুপারি আর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
এই প্রথা থেকেই জন্ম নেয় ‘হালখাতা’- ব্যবসায়ীদের পুরনো হিসেব শেষ করে নতুন খাতা খোলার প্রথা। হালখাতার সময় ক্রেতাদের মিষ্টি খাওয়ানো, উপহার দেওয়া ছিল ঐতিহ্যের অঙ্গ।

আধুনিক নববর্ষ
আধুনিক কালে, বিশেষত ১৯৬০ এর দশকে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ নতুন উদ্যমে পালিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশে ১৯৮৯ সাল থেকে এই দিনটিকে জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল, এখন ইউনেস্কো কর্তৃক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।
এদিকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও পয়লা বৈশাখ ঘটা করে পালিত হয় — নতুন জামাকাপড়, মিষ্টি খাওয়া, প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো, ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।

পয়লা বৈশাখ শুধুমাত্র একটি ক্যালেন্ডারের পালাবদল নয়। ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির কাছে এই দিনটি আনন্দের, মিলনের এবং সংস্কৃতির সম্মিলিত উৎসব। এটি আমাদের অতীতের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে এবং ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়।