Spread the love

শরীর ও মন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এ জন্য শরীরের অনেক রকম সমস্যা রয়েছে, যেগুলো মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে থাকে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নানা রকম অসুখ হয়ে থাকে। এই অসুখ দুই রকমের—স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন অসুখ। স্বল্পকালীন শারীরিক অসুস্থতায় একরকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয় আবার দীর্ঘকালীন অসুস্থতায় মানসিক সমস্যা আরেক রকম হয়ে থাকে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বল্পকালীন শারীরিক অসুস্থতায় যে মানসিক সমস্যা বেশি দেখা যায় সেটি হলো ডেলিরিয়াম। এ সমস্যায় রোগী কিছু সময়ের জন্য পরিবেশ ও পরিস্থিতি থেকে একেবারে আলাদা হয়ে যান। অর্থাৎ রোগীর পরিবেশসচেতনতা হ্রাস পায় ও চিন্তাশক্তি বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। যেমন একজন মানুষ টাইফয়েড জ্বর বা নিউমোনিয়া বা অন্য কোনো সংক্রমণের জন্য অসুস্থ হলে অনেক সময় দেখা যায় তিনি ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না, তাঁর কী সমস্যা হয়েছে, তা বলতে পারছেন না। আবার ডেলিরিয়াম সমস্যায় ভোগা কোনো রোগীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আজ কী বার বা তিনি কোথায় আছেন, তাহলে তার জবাবও ঠিকমতো তিনি দিতে পারেন না। আর অন্যান্য মানসিক সমস্যার মধ্যে আছে বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা।

কুশিং সিনড্রোম

হরমোনজনিত একটি সমস্যা আছে যাকে বলে ‘কুশিং সিনড্রোম’। শরীরে স্টেরয়েড হরমোন বেড়ে গেলে এই সমস্যাটি হয়। এর ফলে বিভিন্ন রকমের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হয়ে থাকে। এমনকি এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি সাইকোসিস হতে পারে।   

 কার্ডিয়াক নিউরোসিস

কিছু হার্টের সমস্যায় মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয়, ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটে। এ ছাড়া বিভিন্ন রকমের হার্টের রোগে যে মানসিক সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তা হলো ‘কার্ডিয়াক নিউরোসিস’। আবার হৃদযন্ত্রের কোনো সমস্যার কথা শুনেও রোগীর স্বল্পমেয়াদি দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে অথবা দীর্ঘমেয়াদি ডিপ্রেশন বা হতাশা হতে পারে। কার্ডিয়াক নিউরোসিস রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন রোগীর হার্টের অসুখ সেরে গেলেও প্রায়ই ওই মানসিক সমস্যাগুলো ফিরে আসে। এ ধরনের রোগীর রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না, বিষণ্নতায় ভোগেন, অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করা কমিয়ে দেন।

ফাংশনাল বাওয়েল ডিজঅর্ডার

আবার পেটের কিছু সমস্যা আছে যেমন ‘ফাংশনাল বাওয়েল ডিজঅর্ডার’-এর ফলে দীর্ঘ বা স্বল্পকালীন মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ। এর মধ্যে আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের জন্য রোগীর দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা, খিটখিটে মেজাজ, খুঁতখুঁতে স্বভাব দেখা দেয়। সেই সঙ্গে এ সমস্যা হলে রোগী ঠিকমতো খাবার খেতে পারে না, রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেন না, এমনকি ঠিকমতো কাজে মনও দিতে পারেন না।

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার

কোনো একটা বড় অসুখ বা মানসিক আঘাত থেকে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ হতে পারে। এর ফলে রোগী দীর্ঘদিন একটা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভুগে থাকেন। যেমন এখন দেখা যায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাঁরা হাসপাতালে ছিলেন, তাঁদের সেই সময়ের অভিজ্ঞতা দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেড়ায়। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হলে রোগী অনেক রাত ঘুমাতে পারেন না, অস্থিরতায় ভোগেন, মনোযোগের অভাব দেখা দেয়, কিছু খেতে পারেন না, ভুলে যাওয়ার সমস্যা হয়ে থাকে।

হাইপোকন্ড্রিয়াসিস

আবার আরেক শ্রেণির মানুষ আছে যাঁরা সারাক্ষণই চিন্তা করে, এই বুঝি অসুস্থ হয়ে গেলেন। একে ‘হাইপোকন্ড্রিয়াসিস’ বলে। ‘কনভারসন ডিজঅর্ডার’ নামের একটি মানসিক অসুখ আছে যেখানে রোগীর হাত অবশ হয়ে যায়, খিঁচুনি হয়; কিন্তু পরীক্ষা করে কোনো রোগ শনাক্ত করা যায় না।

ম্যালিংগারিং ডিজঅর্ডার

আর আমাদের দেশে খুব সাধারণ একটি সমস্যা দেখা যায় যার নাম ‘ম্যালিংগারিং ডিজঅর্ডার’। এ সমস্যায় একজন মানুষ কাজের দায়িত্ব থেকে পালাতে অসুস্থ হওয়ার ভান করেন। এই সমস্যাকে মুনচাউসেন সিনড্রোমও বলে। শিশুদের মধ্যে এই ম্যালিংগারিং বেশি দেখা যায়। স্কুলে যেতে না চাইলে তারা অনেক সময় ভান করে যে তার পেটে ব্যথা করছে বা শরীরের কোথাও সমস্যা হচ্ছে।

হরমোনজনিত সমস্যার জন্যও অনেকের মানসিক অসুবিধা হয়ে থাকে। যেমন থাইরয়েডের সমস্যায় যাঁরা ভোগেন, তাঁদের অনেক মানসিক সমস্যা দেখা যায়। থাইরয়েডের ডোজ কম কাজ করলে বিষণ্নতা দেখা দেয় বা বেশি কাজ করলে দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ দেখা দেয়। 

এ ছাড়া, ব্রেন টিউমার, মৃগী রোগ, শরীরে গ্লুকোজ হঠাৎ করে কমে যাওয়া বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া, মাথায় আঘাতজনিত সমস্যা, দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ বা অ্যালকোহল সেবনে বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা, খিটখিটে মেজাজ, ভুলে যাওয়ার সমস্যা হতে পারে।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শঃ

এসব সমস্যার জন্য একজন চিকিৎসককে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভালোমতো রোগীকে পরীক্ষা করতে হবে। রোগীর সমস্যাটা কতটুকু শারীরিক ও কতটুকু মানসিক, সেটি যাচাই করতে হবে। এ জন্য একজন চিকিৎসকের কয়েকটি বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে কোনো কোনো শারীরিক অসুস্থতার জন্য রোগীর মানসিক সমস্যা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শারীরিক অসুস্থতার জন্য ওষুধ যেমন দেবে, তেমন মানসিক সমস্যার জন্য কোন ওষুধ কতটুকু এবং কী ডোজে দিতে হবে, তা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ দুটি ওষুধের বিক্রিয়ায় রোগীর শরীরে অন্য সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে জন্য রোগী দেখার সময় চিকিৎসকের অবশ্যই সময় নিয়ে রোগীর অসুস্থতার ইতিহাস ভালো করে জানতে হবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগীর জন্য সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

Related Posts