Spread the love

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় তেত্রিশ বছর কেটে গেলেও যে পদ্মফুলের বিলের দেখা মেলেনি, সেই দুর্লভ পদ্ম এখন ফুটতে পারে আপনার ছাদ বা ব্যালকনি আলো করে। এবং আপনাকে কিন্তু এত অপেক্ষাও করতে হবে না, তেত্রিশ দিনেও বাড়িতে বানাতে পারবেন পদ্মবিল, থুড়ি পদ্মপুকুর। ইঁট কাঠের সারি সারি বিল্ডিং-এর মাঝে আপনার ব্যালকনি জুড়ে থাকবে সারি সারি শতদল।  

বীজ সংগ্রহঃ

পদ্ম দু’ভাবে চাষ করা যায়। প্রথমত, কন্দ বা টিউবার দিয়ে; দ্বিতীয়ত, বীজ দিয়ে। প্রথমটি শহরে বসে জোগাড় করা মুশকিল। কেননা, ওটি এখনও পর্যন্ত পদ্মপুকুর থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু দ্বিতীয়টি সহজেই মেলে। যে কোনও দশকর্মার দোকানে, নার্সারিতে পাওয়া যায়। ওখানে গিয়ে পদ্মবীজ চাইলে ওরা ওজন করে দেয়। আবার অনলাইন থেকেও কেনা যায় বীজ। তবে, দাম পড়ে যায় আট থেকে দশগুণ। ফলে, দশকর্মা বা নার্সারিই ভালো।

অঙ্কুরোদগমঃ

যাই হোক, পদ্মের বীজ সংগ্রহ করার পর বীজগুলো ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন, কালো কালো বীজগুলোর একদিকে সরু একখানা বোঁটা আছে। সেই দিকটা বা তার উল্টোদিকটা ঘষতে হবে মোটা শিরিষকাগজে। এটা বেশ ধৈর্যের কাজ। একটু সময় লাগে। পদ্মের বীজের কালো আবরণ বেশ মোটা। ওই আবরণ ভেদ করে নিজে নিজে চারা বের হতে গেলে বীজ বহুদিন সময় নেবে। তার কাজটা সহজ করতে এবং আমাদের অপেক্ষার কাল কমিয়ে আনতেই এই ব্যবস্থা। তাই কালো আবরণ পেরিয়ে সাদা সাদা বীজপত্র দুটি দেখা গেলে তবেই ঘষা বন্ধ করতে হবে। প্রতিটা বীজ এভাবে ঘষা হয়ে গেলে একটি ছোট্ট পাত্রে পরিষ্কার জল দিয়ে বীজগুলো ভিজিয়ে রাখতে হবে। পাত্রটা কাঁচের কাপ, গ্লাস বা বাটি হলে ভালো হয়। তাতে প্রতিদিনের প্রোগ্রেস চোখে চোখে রাখা সহজ হয়।

চারা তৈরিঃ

বীজ ভেজানো পাত্রে বীজের ইঞ্চি-তিনেক ওপর পর্যন্ত যেন জল থাকে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিদিন একবার করে জল বদল করতে হবে। তিন থেকে চার দিনের মধ্যেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সাদা বীজপত্র ভেদ করে সবুজ অঙ্কুর বের হয়ে আসতে দেখা যাবে। এরপর দেখবেন, সেই অঙ্কুরটি দ্রুত বাড়ছে। সরু সরু মৃণাল ছড়িয়ে ছোট ছোট পাতা তৈরি হচ্ছে। দিন দশেকের মধ্যেই বীজ আর কাণ্ডের মধ্যিখান থেকে অজস্র সুতোর মতো শেকড় বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে গাছ ও শেকড় বেশ শক্তপোক্ত হয়ে উঠলে বুঝবেন যে, গাছ পটে দেবার জন্য উপযুক্ত হয়ে গেছে। এই যে দিন দশেকের কোর্সটার কথা বললাম, এই সময় প্রতিদিন নিয়ম করে পাত্রের জল পাল্টাতে ভুলবেন না। আর এই সময় ভুলেও কোন সার-খাবার ইত্যাদি কিছুই দেবেন না। শুধু জল দেবেন। পরিষ্কার জল। এই জলের মধ্য থেকেই খাবার সংগ্রহ করে গাছ পুষ্ট হবে।

পাত্র বাছাইঃ

পটিং-এর সময় হয়ে এলে প্লাস্টিক বা সিমেন্টের ফুটখানেক গভীর গামলা বা টব জোগাড় করতে হবে। পাত্রের গভীরতা আরও বেশি হলে আরও ভালো। তাতে পদ্ম শেকড় ছড়ানোর জায়গা বেশি পাবে, যেমন পুকুরে পায় আর কী। যাই হোক, পটিং-এর পাত্র টবের চেয়ে গামলা হলেই সব থেকে ভালো। ওর মুখটা চওড়া তো, তাই পাতা ছড়ানোর বেশ খানিকটা জায়গা পাবে গাছ। যাই হোক, এই টব বা গামলায় যেন কোন ফুটো না-থাকে।

মাটি তৈরিঃ

পদ্ম তো শুধু জলের ফুল নয়, মাটিও লাগে। এক্ষেত্রে পুকুরের পাঁক হলে খুব ভালো হয়। কিন্তু সবার পক্ষে তো সেটা জোগাড় করা সহজ নয়। তাই আমাদের পাঁকমাটি তৈরি করে নিতে হবে। এর জন্য দু’ভাগ দোআঁশ মাটি, এক ভাগ গোবর সার আর এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে হাড় গুঁড়ো এবং নিম খোলও এক মুঠো মিশিয়ে নিতে হবে। মিশ্রিত মাটি দিয়ে গামলা অর্ধেক ভর্তি করে তার ওপর জল ঢেলে দিতে হবে। এভাবে গামলাটা পনেরো থেকে কুড়ি দিন থাকবে। তাতে গামলার মাটি, গোবর ইত্যাদি পচে পাঁক হয়ে উঠবে। মাটি হয়ে উঠবে মাখনের মতো মোলায়েম। এই পনের-কুড়ি দিন নিয়ম করে গামলার জল যেন মাটির ইঞ্চি দুয়েক ওপর অবশ্যই থাকে, এটা খেয়াল রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, পাঁক তৈরির এই প্রসেসটা বীজ জলে ভেজানোর সময় থেকেই শুরু করে দিতে হবে, তাহলে পটিং-এর সময় মাটি তৈরির জন্য আর অপেক্ষা করতে হবে না।

পটিংঃ

গামলায় পাঁক তৈরি হয়ে গেলে তাতে শেকড়শুদ্ধ পদ্মের চারা আলতো করে পুঁতে দিতে হবে। জোর লাগানোর কোন দরকার নেই। গাছ নরম, চাপ বেশি হয়ে গেলে ভেঙে নষ্ট হবে। তাই সাবধানতার সঙ্গেই এ-কাজ করতে হবে। গামলায় জল এমন পরিমাণে রাখতে হবে, যাতে পদ্মের পাতাগুলো জলের ওপর ভেসে থাকে। মাটিতে ভালো করে শেকড় ধরার জন্য গাছকে একটা মাস সময় দিন। এই সময় কোন খাবার দিতে হবে না গাছকে। মাটি তৈরির সময় যে খাবার দেওয়া হয়েছে, সেটাই এই মুহূর্তে তার জন্য যথেষ্ট।

গাছের খাবারঃ

খাবার দিতে হবে পরের মাস থেকে। খাবার হিসেবে সরাসরি গামলায় সার ছড়িয়ে দেওয়া যায় না, তাতে গাছের ক্ষতি হয়। সার বলতে আমরা ব্যবহার করব DAP রাসায়নিক সার। চার থেকে পাঁচটি দানা কাপড়ে বেঁধে গাছের গোড়া থেকে কিছুটা তফাতে গামলার পাঁকের মধ্যে পুঁতে দিতে হবে। গাছ সেখান থেকেই প্রয়োজনীয় খাবার সংগ্রহ করে নেবে। এটা মাসে একবার দিলেই হবে। গামলার জল মাঝে মধ্যে সাবধানে পরিবর্তন করে দিতে হবে। গাছের পাতা হলুদ হয়ে মরে গেলে, সেগুলো নিয়মিত কেটে ফেলতে হবে। জল পরিষ্কার রাখতে হবে। এছাড়া পদ্ম চাষে আর কোন ঝক্কি নেই।

যত্নঃ

যত দিন যাবে, গাছের গোড়া শক্ত হবে। একলা গাছের চারপাশে ঝাড় হবে। লিকলিকে পাতা ও মৃণালের পরিবর্তে মোটা মোটা ডাঁটি হবে, বড় বড় পাতা হবে। ব্যালকনি বা ছাদ বাগানের চেহারাই বদলে দেবে। পদ্মের গামলায় সবসময় জল জমে থাকে, তাই এতে মশার বাড়বাড়ন্ত হবার সুযোগ থাকে। এটা বন্ধ করতে গামলায় গাপ্পি মাছ ছেড়ে দিন, দেখতেও ভালো লাগবে আর মশার লার্ভা খেয়ে সমস্যার সমাধানও করবে। যদি সেটা সম্ভব না-হয়, তাহলে জলে মাঝে মাঝে সামান্য পরিমাণে চুন দেবেন, তাতে মশার সমস্যা থেকে রেহাই মিলবে।

শীতকালটা পদ্মের ঘুমোবার সময়। এই সময় সে গাছ বাঁচিয়ে রাখতে চায় না, ফুলও দেয় না। গরম পড়লে সে আবার জেগে ওঠে। তাই বীজ থেকে পদ্মের চারা করার উপযুক্ত সময় ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর। গাছ পটিং করার পর ফুলের জন্য পড়ে থাকে ছ’মাস থেকে এক বছরের অপেক্ষা। বীজের গাছে এটুকু অপেক্ষা করতেই হবে। আর সেই অপেক্ষার পথ বেয়েই সহস্রদল পাপড়ি মেলবে আপনার ব্যক্তিগত বাগানে…     

About Author
Adwitiya Magazie
View All Articles
Check latest article from this author !
ফুলকপি ঘি রোস্ট
ফুলকপির যত গুণ
জ্বর কমানোর ঘরোয়া উপায়

Related Posts