মেঘের আলয়! নামেই আছে জাদু। খাসি, জয়ন্তিয়া, গারো- এই তিন পাহাড়ের দেশ মেঘালয়। শিলং তার রাজধানী শহর। যে শহরকে প্রাচ্যের স্কটল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়। শিলং পৃথিবীর অন্যতম সেরা রোমান্টিক শহর। রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত নস্টালজিক শহর। সর্বোপরি বাঙালির প্রাণের শহর। সবুজ ছাওয়া পাইনবীথি, ছন্দময় ঝরনা, টলটলে জলের লেক, চোখ জুড়ানো সবুজ উপত্যকা, মেঘ-কুয়াশার মায়াবী প্রকৃতি- সব মিলিয়ে শিলং যেন ‘সব পেয়েছির দেশ’।
বৃষ্টি তো কলকাতার বুকে হামেশাই দেখেছেন। কিন্তু শিলঙের বৃষ্টি দেখার মজাই আলাদা। তবে মেঘের গতিবিধি দেখে এখানকার জলহাওয়ার আগাম বার্তা বোঝা শক্ত। একটু আগেও যে আকাশ ছিল ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে ধোয়া ঝকঝকে, মুহূর্তেই তা হয়ে গেল কাজল কালো। মেঘের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে গাড়ি গড়াতেই শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। ওয়াইপারের ওঠানামার মধ্যে ভেজা শহরের ছবি দেখছি, আর ভাবছি—এই মেঘ-বৃষ্টির খুনসুটি দেখতেই তো মেঘালয়ে ছুটে আসা, ভাললাগার ভাবনায় তখন রাবীন্দ্রিক সুর। ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ।’
এরপর গেলাম রেসকোর্স আর পোলো গ্রাউন্ডও। ফি-বছর এই পোলো মাঠেই তীরন্দাজি প্রতিযোগিতার আসর বসে। শিলং স্টেডিয়ামও দেখলাম দূর থেকে।
এবার গেলাম লাইতুমখ্রা এলাকায় অবস্থিত ক্যাথলিক ক্যাথিড্রালে। জায়গাটা একটা নাতিদীর্ঘ টিলার উপর। গড়ানে রাস্তার ধারে গাড়ি রেখে ঢুকলাম চার্চের অন্দরে। সুবিশাল দৃষ্টিনন্দন চার্চটি ভারতের বৃহত্তম চার্চগুলির মধ্যে অন্যতম। ভাবগম্ভীর পরিবেশে তখন প্রার্থনা চলছে। প্রধান কক্ষের বাইরের অন্যান্য কক্ষেও প্রার্থনারত মানুষজন। ঐতিহ্য মেনে উঁচু বেদিতে বিশ্বপিতার ক্রুশবিদ্ধ ভাস্কর্য। রয়েছে মা মেরির কোলে শিশু যিশু। হল ঘর জুড়ে হরেক তৈলচিত্রের সম্ভার। তাতে জায়গা পেয়েছে যিশুর জন্মকাল থেকে ক্রুশবিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত সমস্ত জীবনগাথা। চার্চের পিছনটাও বলতে গেলে এক ভিউ পয়েন্ট। সুন্দরী শিলং-এর যেন অন্য লুক। প্রার্থনা চলতেই থাকে। চঞ্চল মনকে বেপথে না হাঁটিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসি।
এই স্যাঁতসেঁতে সিচুয়েশনেই চলে এলাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ওয়ার্ডস লেকে। অবিভক্ত অসমের চিফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড ১৮৯৩ সালে তৈরি করেন এই লেক। কৃত্রিম এই লেক অশ্বখুরাকৃতি। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই এক ছুটে লেক পাড়ে। শিরশিরে হাওয়ায় রোমকূপ জুড়ে শীত-কাঁটা। ছাতা মাথায় ট্রাফিক পুলিশের মতো এদিক-ওদিক করছি। বৃষ্টিটা একটু ব্রেক নিতেই কাঠের ব্রিজের বাউন্ডারি পেরিয়ে ওপারে। ঘোর বর্ষাতেও লেক পাড় জুড়ে ফুলের জলসা। সমুদ্র মাঝে মাড পাহাড়ের মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো, জলের মাঝে এক কৃত্রিম দ্বীপ। বৃষ্টি মাথায় অনেকেই বোটিং-এর নেশায় মাতোয়ারা। প্রতি সন্ধ্যায় এখানে মেলোডি ফাউন্টেন পরিবেশিত হয়। বর্ষণমুখর সকালে রাতের আলোক ঝরনার রূপ ভাবনায় ঠিকঠাক এলো না। এক ঝাঁকড়া গাছের নীচে দেখি এক ঝাঁক রাজহাঁস ভিজছে। ফুলেদেরও ফুলবাবু সেজে থাকার উপায় নেই। বৃষ্টির কশাঘাতে সব কোলকুঁজো অবস্থা। হঠাৎ বৃষ্টিটা তেড়ে-ফুঁড়ে আসতেই, ছুটে গাড়িতে গিয়ে উঠি। এবার গল্ফ কোর্সের রাস্তায় গড়াল গাড়ি। মুখোমুখি হলাম মখমল সদৃশ সবুজ ঘাসে ঢাকা জমির। সেই ঢেউ খেলানো প্রান্তরেই রয়েছে আঠারো গর্তের গল্ফ কোর্স। আর গল্ফ মাঠকে ঘিরে রয়েছে পাইনের নিবিড় বনানি। সব মিলিয়ে এক অতীব নয়নাভিরাম দৃশ্য। বখাটে বৃষ্টির বাড়াবাড়িতে গাড়ি থেকে নামতেই পারলাম না। ভেজা কাচের ভিতর দিয়ে অবলোকন করলাম খাঁ-খাঁ ভেজা মাঠটা। হাত ধরাধরি করে ভিজছে। বৃষ্টিটা বোধহয় এই বেলার জন্য ছুটি নিয়েছে। ফলে একটা রোদ-ঝলমলে ভাব। তবে এলোপাথাড়ি ঝোড়ো হাওয়া চলছে এখনও। চলে এসেছি শহরের মধ্যে অবস্থিত এক পার্কে। অবিভক্ত অসমের রাজ্যপালের স্ত্রীর নামে যে পার্কের নাম লেডি হায়দারি পার্ক। ব্যক্তি প্রতি ও ক্যামেরার জন্য টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম পার্কে। পার্কের ডানদিক জুড়ে ডিয়ার পার্ক ও চিড়িয়াখানা । আর দক্ষিণ দিকে শিশু উদ্যান। গাছপালার মাঝে আছে বাচ্চাদের হরেক রাইড। স্লিপ, খেলনা, দোলনা দেখে এবার চলে আসি মিনি চিড়িয়াখানায় ৷ খাঁচাবন্দি হরেক জন্তু-জানোয়ার। কিছু খাঁচা আবার জানোয়ার শূন্য। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে চিতাবাঘ, শজারু, ছোট ল্যাজওয়ালা বাঁদর, সম্বর, গন্ধগোকুল, পাহাড়ি ছাগল ইত্যাদি। শকুন, ঈগল, পেলিক্যান ছাড়াও আছে রকমারি ছোট-বড় পাখির পাকাপাকি আবাস। এবার শিলং পিকের পথে পা বাড়ানো। শহর থেকে প্রায় ১০ কিমি বন্যদের সান্নিধ্যে বেশ কাটল সময়টা।
এয়ার ফোর্সের ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে দিয়ে পথ। অনুমতি করিয়ে ড্রাইভাররা এই পথ ব্যবহার করে। ১,৯৬৫ মিটার উচ্চতায় শিলং পিক। এখান থেকে পাখির চোখে সমস্ত শহরের এরিয়াল ভিউটা চমৎকার লাগে । কিন্তু পিকের পজিশন মাফিক দাঁড়িয়েও, স্বচ্ছ প্যানোরামিক ভিউ ভাগ্যে জুটল না। ওয়াচটাওয়ারে উঠেও ভরল না মন। মেঘ-কুয়াশায় দূর প্রকৃতিও রইল অধরা। পাহাড় ঢালে প্রহরারত পাইনের সবুজ প্রকৃতি অবশ্য নিরাশ করেনি। পিক প্রাঙ্গণে বাজার যেন উপচে পড়ছে। খাদ্য সামগ্রী, খেলনা ও শো-পিস-ই শোভা পাচ্ছে বেশি। খাসিদের খাস ঐতিহ্য পোশাকও ভাড়ায় বিকোচ্ছে। সে-সব পোশাকে সজ্জিত হয়ে পর্যটকরা ছবিও তুলছে পটাপট। দেখি ফলের দোকানে কাটা আনারস বিক্রি হচ্ছে দেদার। ‘কাটা ফল খাওয়া নিষেধ’—এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে গিয়ে কিনলাম কিছুটা। স্বাদ অপূর্ব। পেটও ভরল, মনও।
লাঞ্চের পর এবার এলিফ্যান্ট ফলসের পথে। শিলং শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় জলপ্রপাত এই এলিফ্যান্ট ফলস্। তিন ধাপে বিভক্ত ফলসের সৌন্দর্য পলক ফেলতেই দেয় না। তবে নীচের দুটি ফলস্ দেখতে হলে হাঁটু আর হার্টবিট এই দুইয়েরই জোর থাকা দরকার। গাড়ি থেকে নামতেই আবার এল গায়ে পড়া বৃষ্টি। মাথা বাঁচাতে তাই এক ছুটে রাস্তার ধারের এক দোকানে। এবার বৃষ্টির ডিউরেশনটা দেখি আরও বেশি। বৃষ্টিটা একটু বিরতি টানতেই টিকিট কেটে ফলসে ফটকে। পা টিপে-টিপে ভেজা ধাপসিঁড়িতে নামতে থাকি। রেলিং দেওয়া বাঁধানো সিঁড়িপথ। প্রথম জলপ্রপাতের সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। প্রপাতকে ঘিরে আছে নাসপাতি আর চেরি গাছের ঠাস বুনোট। পরের দুটি ধাপের প্রপাতের সৌন্দর্য পাগল করা। শুভ্র সফেন জলধারা। সে জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়ালাম। ছিটকে আসা বারিবিন্ধুধারায় শরীরের সঙ্গে মনও ভিজল। প্রাণ জুড়ানো প্রপাতের ছবিও তুলছে পর্যটকরা পটাপট।
এরপর গেলাম রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য জিৎভূমি। কিন্তু সামনে থেকে দেখে চলে আসতে হল, ভিতরে জনসাধারণের ঢোকার অনুমতি নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোথায় বসে লিখতেন, ওঁনার চেয়ার ইত্যাদি যা যা বাইরে থেকে দেখা সম্ভব দেখে বেরিয়ে এলাম।
ওখান থেকে গেলাম বাটারফ্লাই মিউজিয়াম। এটি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। বিশেষ করে ছোটদের কাছে।
এখানেই ট্যুরের ইতি টেনে ড্রাইভার হোটেলের পথ ধরে। ক্রিজে তখনও বৃষ্টিটা চার-ছক্কার চেনা ছন্দে ।
কীভাবে যাবেন?
কোলকাতা থেকে প্রথমে বিমান অথবা ট্রেনপথে গুয়াহাটি। ১২৩৪৫ সরাইঘাট এক্সপ্রেস, ১৫৯৫৯ কামরূপ এক্সপ্রেস, ১৩১৭৫ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস অথবা দ্বিসাপ্তাহিক কলকাতা-গুয়াহাটি গরিবরথ এক্সপ্রেস গুয়াহাটি যাচ্ছে। গুয়াহাটি স্টেশনের বিপরীতেই পলটন বাজার। এখান থেকেই মিলবে শেয়ার সুমো। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গাড়ি ভাড়া করেও ১০০ কিলোমিটার দূরের শিলং শহরে পৌঁছোতে পারেন।
কোথায় থাকবেন?
শিলং শহরে মিলবে অজস্র হোটেল। হাতের কাছে সবরকম সুবিধা থাকায় বাঙালিরা সাধারণত পুলিশবাজারের কাছাকাছি হোটেলে থাকতে পছন্দ করেন। শিলং-এ মেঘালয় পর্যটন দপ্তরের তিনটি হোটেল। পাইন উড হোটেল ও হোটেল অর্কিড শহরের মধ্যে। শহরের বাইরে বড়াপানির কাছে আছে হোটেল অর্কিড লেক রিসর্ট। ২০০০ টাকা থেকে ৮,৫০০ টাকার মধ্যে।
প্রাইভেট হোটেলগুলির মধ্যে হোটেল পোলো টাওয়ার, হোটেল আলপাইন কন্টিনেন্টাল, হোটেল জে. কে. ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল স্বস্তিক, হোটেল লোটাস, হোটেল মনসুন, হোটেল ব্লু পাইন ইত্যাদি। হোটেল ভাড়া ১০০০ থেকে ৯,৯৫০ টাকার মধ্যে।