Spread the love

দেহের অন্যান্য অংশের ক্যানসারের সঙ্গে এর সাযুজ্য নেই বললেই চলে। শিশু ও কিশোরদের মধ্যেই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ক্রোমোজোম মিসম্যাচ বা অ্যাবারেশন বা জন্মগত ত্রুটির কারণে তৈরি হওয়া এই অসুখ সেরে ওঠার সম্ভাবনা কতটা? জীবনযাপনের সঙ্গে এর যোগই বা কতটুকু? আমাদের শরীরের কোন অংশের হাড়ে কোন ধরনের ক্যানসারের সম্ভাবনা বেশি। বিশদে বললেন ডা. প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি।

  • বোন ক্যানসার কী ?

প্রাথমিকভাবে আমাদের হাড় থেকে কোনও টিউমারের সৃষ্টি হলে তাকে সারকোমা (Sarcoma) বা বোন ক্যানসার (Bone cancer) বলা হয়। এই অসুখ মূলত শিশু, বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছোনো বা সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোনোদেরই আক্রমণ করে। খুব সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় বলা যায় ক্রোমোজোম মিসম্যাচ (Chromosome Mismatch) বা অ্যাবারেশন (Aberration) বা ট্রান্সলোকেশন (Translocation) বা কনজেনিটাল অ্যানোম্যালি (Congenital Anomaly)-র জন্য এই রোগের সৃষ্টি হয়।

  • এই রোগের লক্ষণগুলো কী ?

আক্রান্ত অংশে তীব্র যন্ত্রণা ও ফুলে যাওয়া। এছাড়া সংলগ্ন অঞ্চলের স্নায়ু বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অনেক সময় পক্ষাঘাত (Paralysis)-গ্রস্তও হয়ে পড়ে। যেমন আমাদের গলবিল বা ন্যাসোফ্যারিংকস্ (Naso-pharynx)-এ যখন বোন ক্যানসার বাসা বাঁধে, তখন অনেক ক্ষেত্রেই জিভ অসাড় হয়ে যায় বা মুখ বেঁকে যায়। যাকে বলা হয় ফেসিয়াল পলসি (facial palcy)। আবার চক্ষুগহ্বর (orbit) যখন আক্রান্ত হয়, যাকে বলা হয় অরবাইটাল ক্যানসার (orbital cancer), তাতে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে। এই লক্ষণকে বলা হয় প্রপটোসিস (proptosis)। অরবাইটাল ক্যানসার-এ মূলত শিশুরাই আক্রান্ত হয় ৷

  • শিশু ও কিশোরদের মধ্যেই কি এর প্রকোপ বেশি ?

হ্যাঁ। প্রাথমিক বোন ক্যানসার প্রধানত আক্রমণ করে শিশু, কিশোর ও যারা সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে তাদেরকেই। কারণ ক্রোমোজোম মিসম্যাচ বা অ্যাবারেশন বা ট্রানন্সলোকেশন বা কনজেনিটাল অ্যানোম্যালি অর্থাৎ জন্মগত ত্রুটির কারণে যখন বোন ক্যানসার হয়, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে জীবনের প্রথম পর্বেই।

  • কত ধরনের বোন ক্যানসার আছে?

মূলত চার ধরনের। চিকিৎসাশাস্ত্রে বোন ক্যানসারকে বলা হয় সারকোমা (Sarcoma)।

(১) অস্টিওসারকোমা (Osteosarcoma)। এই ধরণটাই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বলা যেতে পারে ৬০ শতাংশ বোন ক্যানসারই অস্টিওসারকোমা।

(৩) ইউইংস্ সারকোমা (Ewings sarcoma)। এতে প্রধানত আক্রান্ত হয় ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সিরা।

(৪) আর প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত বোন মেট্যাসট্যাসিস (Bone Metastasis)-এর শিকার হন অন্য কোনও প্রাইমারি বোন ক্যানসার থেকে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, বোন ক্যানসারের প্রথম তিনটি ধরনকে প্রাথমিক বা প্রাইমারি বোন ক্যানসার বলা হয়। যার সূত্রপাত হয় সাধারণত প্রস্টেট, ব্রেস্ট বা লাং ক্যানসার থেকে। কিন্তু চতুর্থ অর্থাৎ বোন মেট্যাসট্যাসিস-কে সারকোমার পর্যায়ে ফেলা হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে সেকেন্ডারি বোন ক্যানসারের পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে।

  • প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি বোন ক্যানসারের মধ্যে পার্থক্য কী?

প্রাথমিকভাবে দেহের হাড় আক্রান্ত হলে সেটা প্রাইমারি বোন ক্যানসার (Primary Bone Cancer)। কিন্তু দেহের অন্য অংশের ক্যানসার যখন পরবর্তীতে হাড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাকে সেকেন্ডারি বোন ক্যানসার বলে (Secondary Bone Cancer)।

  • বোন ক্যানসার আর বোন ম্যারো (Bone marrow) ক্যানসার কি আলাদা?

সম্পূর্ণ আলাদা। বোন ক্যানসার হচ্ছে হাড়ের ক্যানসার আর বোন ম্যারো ক্যানসার বলতে মাংসপেশির ক্যানসারকে বোঝায়।

  • আমাদের শরীরের কোন অংশের হাড়ে এই ক্যানসারের বাসা বাঁধার সম্ভাবনা বেশি?

হাড়ের প্রধান অংশ ৩টি। মেটাফিসিস (Metaphysis), এপিফিসিস (Epiphysis), ডায়াফিসিস (Diaphysis)। হাড়ের এই তিনটি অংশের এক একটিতে এক এক ধরনের ক্যানসারের সম্ভাবনা বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় অস্টিওসারকোমা মেটাফিসিসে বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে ডায়াফিসিসে ইউইং’সারকোমা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আবার কিছু কিছু ক্যানসার ফ্ল্যাট বোন-এ হয়, কিছু কিছু লং বোন-এ ।

  • অস্টিওপোরোসিস কী পরবর্তীকালে বোন ক্যানসারের রূপ নিতে পারে ?

কখনই নয়। অস্টিওপোরোসিস হাড়ের একটা অসুখ (Osteo porosis), যার অন্যতম কারণ ক্যালশিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর অভাব। প্রস্টেস ও ব্রেস্ট ক্যানসার যখন হাড়ে ছড়িয়ে পড়ে (Metastasis Carcinoma), তখন অনেক সময় আপাতদৃষ্টিতে এক্স-রে পিকচার-এ অস্টিওপোরোসিস-এর সঙ্গে কিছু কিছু মিল পাওয়া যায় । কিন্তু এর ভিত্তিতে দুটি রোগের মিল খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন।

  • বোন ক্যানসার কি বংশগত অসুখ ?

অস্টিওসারকোমা ও ইউইংসারকোমার ক্ষেত্রে বংশগত ও জিনগত প্রভাব খানিকটা কাজ করে। বলতে পারেন ১৫ শতাংশ। এছাড়া জন্মগত ত্রুটি (congenital anomaly) নিয়ে যারা জন্মগ্রহণ করেন তাদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

  • কোনও গর্ভবতী মহিলা এই রোগে আক্রান্ত হলে গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্ষতির সম্ভাবনা কতটা?

একটু বিশদে বলি। গর্ভবতী মহিলার চিকিৎসার ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। যেমন, ক্যানসারের প্রকৃতিটা কেমন? অ্যাগ্রেসিভ না লেস অ্যাগ্রেসিভ, দেহের কোন অংশের হাড় আক্রান্ত ইত্যাদি। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির হাত ধরে বোন ক্যানসারের চিকিৎসা আজ কমাইন্ড মোডালিটি (combined modality) বা মাল্টি মোডালিটি (multy modality)-র যুগে পৌঁছেছে। যার আওতায় পড়ে সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিয়োথেরাপি। প্রয়োজনমতো এগুলির যে-কোনও একটি বা সবই প্রয়োগ করা হয়। এই কেমো ও রেডিয়োথেরাপি গর্ভস্থ ভ্রূণের ওপর বিশেষভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সে কোনও না-কোনও জন্মগত ত্রুটি (congenital Anomaly) নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। বলা ভাল কেমো ও রেডিয়োথেরাপি প্রয়োগের ২ বছর আগে এবং পরে গর্ভধারণ না করাই বাঞ্ছনীয়।

  • আক্রান্তদের সেরে ওঠার সম্ভাবনা কতটা ?

র‍্যাবডোমায়োসারকোমা ও ইউইং’স্‌ সারকোমার ক্ষেত্রে আর্লি স্টেজে অর্থাৎ স্টেজ ১, স্টেজ ২ এবং স্টেজ ৩-এ ৫ বছরের জন্য TCP (Tumor control Probability) 90% ।

তুলনায় অস্টিওসারকোমা একটু বেশি আক্রমণাত্মক। এক্ষেত্রে স্টেজ ১ ও স্টেজ ২-এ সেরে ওঠার সম্ভাবনা ৭০-৮০%। এর পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ স্টেজ ৩-এ খুব ভাল ফল আশা করা যায় না। তবে BRM (Biological Response Modifiers) ও কিছু মলিকিউলার জিনম (Molecular Genom)-এর ওপর অনেক গবেষণা হচ্ছে। আশা করা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বোন ক্যানসারের চিকিৎসায় অভূতপূর্ব উন্নতি হবে।

  • আধুনিক জীবনযাপন কি কোনওভাবে এই রোগের জন্য দায়ী ?

বোন ক্যানসারকে কোনওভাবেই শরীরের অন্য কোনও ক্যানসারের সঙ্গে এক করে দেখলে চলবে না। মদ্যপান, ধূমপান বা স্ট্রেসফুল লাইফের সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই বললেই চলে। তাই অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ফল, শাকসবজি দিয়ে এই রোগকে ঠেকিয়ে রাখাও সম্ভব না।

Related Posts