-রূপক সাহা
গাড়ি থেকে নামতেই পাঠকজি আপ্যায়নের ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আইয়ে, আইয়ে মামাজি। হাম শোচা ভি নেহি থে, আপ জ্যায়সে মহান আদমি হামারা ই ছোটা গাঁওমে আয়েঙ্গে।’ পাঠকজির হাসিমুখ দেখে বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। ভদ্রলোককে কলকাতায় বারকয়েক দেখেছি। কোর্ট-শার্ট-প্যান্ট পরা কর্পোরেট চেহারায়। কিন্তু আজ উনি একেবারে দেহাতি পোশাকে। মাথায় ইয়া পাগড়ি। গলাবন্ধ নীল জওহর কোটের তলায় সাদা শেরওয়ানি আর চোস্ত। প্রথমে ঠাওর করতে পারিনি, উনিই দীনবন্ধু পাঠক। এক সময় রৌরকেল্লা স্টিল প্ল্যান্টের জিএম ছিলেন। হিন্দি সিনেমায় গোবলয়ের গ্রামে যে সব সরপঞ্চকে আমরা দেখে থাকি, পাঠকজিকে সেই রকমই মনে হচ্ছে।
ফোনে রোশনি শিখিয়ে দিয়েছিল, ‘দেখা হলে মামু প্রথমেই তুমি হাতজোড় করে নমস্তে বলবে। হড়বড় করে খুব বেশি কথা বলতে যেও না। বিশেষ করে, ওদের রিলেটিভদের সঙ্গে। প্রতি পদে পদে ওরা বাঙালিদের খুঁত ধরে। হাড় বদমাশদের গুষ্টি। বাঙালিদের ওরা খুব হেয় করে।’ রোশনি হল আমার বিধবা বড়দির একমাত্র মেয়ে। পাঠকজি হলেন ওর শ্বশুর। বারাণসীর পঠকৌলি গ্রামের ছেলে রৌণক পাঠকের সঙ্গে রোশনির বিয়ে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া মারফত আজকাল অনেক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। সেখানেই দুজনের আলাপ এবং প্রেম। বিয়ের সিদ্ধান্তটা যখন ওরা নেয়, তখন রোশনি হুমকিই দিয়েছিল, ‘তোমরা না মানলে আমরা কিন্তু রেজিস্ট্রি করে নেব।‘ শুনে বড়দি কেঁদেকেটে একশা । তখন আমিই বলেছিলাম, ‘এখনকার যুগে বাঙালি-অবাঙালি মানলে চলে? দিদি, তুই একবার ছেলেটাকে ডেকে পাঠা। কথা বলে দেখি, কেমন পরিবারের। তার পর না হয় ডিসিশন নেওয়া যাবে।’ রৌণকের সঙ্গে কথা বলে আমার তখন খুব ভালো লেগেছিল।
কিন্তু প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন এই পাঠকজি। প্রথমত, অব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়েকে স্বীকার করবেন না। দ্বিতীয় কারণটা অদ্ভুত। বঙ্গালের মেয়ে মানেই লেফটিস্ট… বামপন্থী মনোভাবের। পাঠক পরিবারে মানাবে না। ফোনে বেশ কয়েকদিন ধরে ভদ্রলোক কড়া কড়া কথা শুনিয়ে ছিলেন। শেষে একদিন আমিই রেগেই বললাম, ‘আগে আপনার ছেলেকে সামলান। না হলে আমাকে পুলিশে কমপ্লেন করতে হবে।‘
তার পর পাঠকজি আর ফোন করেননি। কলকাতায় সোশ্যাল ম্যারেজের সময় ওঁরা কেউ আসেননি। আমাদের আত্মীয়-স্বজনরাও তখন মুখ বাঁকিয়ে ছিলেন, ‘কদ্দিন আর টিকবে। কালচারে মিলবে না। মেয়েটাকে বনি জলে ফেলে দিল।’ বনি মানে আমার বড়দি… বনানী।
বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে পাঠকজিরা রোশনি-রৌণকের কোনও খোঁজ নেননি। কিন্তু ওদের বাচ্চা হওয়ার পর বরফ গলতে শুরু করে। এর মধ্যে পাঠকজি রিটায়ার করে রৌরকেল্লা থেকে পৈতৃক ভিটেতে ফিরে গেছেন। স্ত্রীকে নিয়ে উনি বার তিনেক কলকাতাতে এসেওছেন নাতনিকে দেখতে ৷ কিন্তু অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও ওঁরা বনিদির বাড়িতে যাননি। বাচ্চাটাকে নিয়ে রোশনি দুবার পঠকৌলিতে গেছিল। প্রথমবার ফিরে আসার পর ওর মুখ অন্ধকার। কে নাকি ওকে প্রশ্ন করেছিল, ছেলের জন্ম দিতে পারলে না? প্রচণ্ড রেগে ও বনিদিকে বলেছিল, ‘একেবারে গাওয়ার ফ্যামিলি, জানো মা? মেয়ে কেউ চায় না । মেয়েদের সব সময় ওরা দাবিয়ে রাখে । ভাবতে পারো, এই যুগেও সারাক্ষণ তোমায় শাড়ি পরতে হবে। ঘোমটা দিয়ে থাকতে হবে। মনে হচ্ছিল, যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে পারি, ততই মঙ্গল। এত ভালো ভালো সালোয়ার কামিজ আর জিনস নিয়ে গেলাম । ওখানে একটাও পরতে পারিনি।’ তিন বছরের মাথায় রোশনির মেয়ে… খুশবুর মুণ্ডন। সেই অনুষ্ঠান পঠকৌলিতে ঘটা করে করছেন পাঠকজি। সেই উপলক্ষে এই প্রথম নেমন্তন্ন করেছিলেন বনিদিকে। কিন্তু রোশনি ই বারণ করে, ‘মা, তুমি যেও না। গেলে তোমার মান-সম্মান রাখবে না। তুমি হিন্দি বলতে পারো না। ওদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারবে না । তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। তার চেয়ে বরং মামুকে পাঠিয়ে দাও। তেমন হলে মামু ওদের দু-চারটে কথা শুনিয়ে দিয়ে আসতে পারবে।’ রোশনির কথা মনঃপূত হয়েছিল বনিদির। আমাকে অনুরোধ করেছিল, ‘প্লিজ শানু, তুই যা ভাই। আর তো ওখানে যাওয়ার সুযোগ হবে না । তুই গিয়ে সব দেখেটেখে আয়। রণি যা বলে, সত্যি কিনা।’ বনিদির অনুরোধেই আমি এখন পঠকৌলিতে। আমার পরনে পুরোপুরি বাঙালি পোশাক। ধুতি, পাঞ্জাবি, গায়ে জড়ানো কাশ্মিরী শাল। পোশাকটা ইচ্ছে করেই পরেছি। পাঁচিল ঘেরা বিরাট এরিয়া। তারই মধ্যে পাঠকজির দোতলা বাড়ি। গাড়িবারান্দার পাশে বিশাল প্যান্ডেল, রঙিন চাঁদোয়া, মেঝেতে বিছানো সুদৃশ্য কার্পেট। একদিকে ব্যুফের ব্যবস্থা। সেখানে কেউ চেয়ারে বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। প্রচুর লোক খাওয়াদাওয়ায় ব্যস্ত। রৌণক বা রোশনিকে ধারেকাছে দেখতে পেলাম না। সাদর অভ্যর্থনা করে গেট থেকে আমাকে গাড়িবারান্দা অবধি নিয়ে যাওয়ার সময় পাঠকজি হিন্দিতে বললেন, ‘খুশবুকে নিয়ে ওঁর দাদি মন্দিরে গেছেন। ওঁরা এখনই ফিরে আসবেন। সম্ন্ধজি, চলুন ততক্ষণে আমার রিলেটিভদের সঙ্গে আপনাকে আলাপ করিয়ে দিই।’
ভিড়ের মধ্যে নিয়ে গিয়ে পাঠকজি আমার সঙ্গে আত্মীয়দের পরিচয় করাতে লাগলেন। পুরো গ্রামটা ব্রাহ্মণ পাঠকদের। সেই কারণে নাম পঠকৌলি। কেউ ইউনিভার্সিটিতে পড়ান, কেউ সরকারি বড়ো চাকুরে, ডাক্তার বা ব্যবসায়ী। একজন পদ্মশ্রীও আছেন। ‘বেটি বাঁচাও’ আন্দোলন করে তিনি খেতাবটা পেয়েছেন। বিদেশ থেকেও অনেকে হাজির হয়েছেন। আমার পরিচয় দেওয়ার সময় পাঠকজি সবাইকে বলতে লাগলেন, “আপ হ্যায় রোশনিকো মামাজি। প্রশান্ত গুহা… ওয়েস্ট বঙ্গালকো মসুর রাইটার অ্যান্ড জার্নালিস্ট।’ পাঠকজির এক পিসতুতো বোন, তাঁর স্বামীর চাকুরিসূত্রে বেশ কয়েক বছর শিলিগুড়িতে ছিলেন। দেখলাম, বাংলা সাহিত্য নিয়ে তাঁর ভালো ধারণা আছে। চেয়ার টেনে বসে তিনি আমার সঙ্গে
গল্প করতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে বিমল মিত্র… অনেকের লেখার হিন্দি অনুবাদ ভদ্রমহিলা পড়েছেন। আমি যত মুন্সি প্রেমচাঁদের প্রশংসা করি, তিনি ততই শরৎচন্দ্র নিয়ে উচ্ছ্বসিত। আড্ডা মারার ফাঁকে মাটির গ্লাসে সরবত এসে গেল। কীসের জানি না, তবে চুমুক দিয়ে আমার দারুণ লাগল । মোবাইল ফোন বাজছে। পকেট থেকে সেট বের করে দেখি, পর্দায় রোশনির নাম। সুইচ অন করতেই ফিসফিস করে ও জিজ্ঞেস করল, ‘মামু, রণিদের বাড়িতে কখন এলে?’
বললাম, ‘আধ ঘণ্টার মতো হবে। তোরা কদ্দুর? ‘এত আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। তুমি কোথায় বলো তো?’
‘যেখানে লাঞ্চের অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়েছে, সেখানে বসে আছি।’
‘ইস, এতক্ষণ ধরে তোমাকে বাইরে বসিয়ে রেখেছে?’ হঠাৎ গলার স্বর বদলে গেল রোশনির, ‘এ জন্যই আমি তোমাদের আসতে বারণ করেছিলাম।’ বলে লাইনটা ও কেটে দিল। এত রাগের কী হল, বুঝতে পারলাম না। অনুষ্ঠানের বাড়ি, নিশ্চয়ই ভিতরটা অগোছালো হয়ে আছে। পাঠকজি এখনও আমাকে বাড়ির ভিতর নিয়ে যাননি। এতে মান-অপমানের কী আছে? মাঝ ডিসেম্বর, পঠকৌলিতে হালকা ঠান্ডা। রোদ্দুেরে পিঠ ঠেকিয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম। বেশ ভালো লাগছে। পাঠকজির কমবয়সী স্বজনরা এসে মাঝে মাঝে আমাকে প্রণাম করে যাচ্ছে। রৌণকের এক তুতো দাদা রাজনৈতিক নেতা। তিনি এসে বঙ্গালের রাজনীতি নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। একবার সন্দেহ হল, আমি বামপন্থী কিনা, তা জানার চেষ্টা করছেন নাকি? পরে বুঝলাম, তা নয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিদের অসামান্য ভূমিকা নিয়ে উনি অনেক কথা বললেন। এও স্বীকার করলেন, সুভাষচন্দ্র বোস যদি প্রথম প্রাইম মিনিস্টার হতেন, তা হলে দেশের এই হাল হত না। পাঠকজির পরিবার বাঙালিদের হেয় করেন বলে তো আমার মনে হল না পঠকৌলিতে আসার আগে, আমাকে কী কী করতে হবে রোশনি শিখিয়ে দিয়েছিল। ‘তোমাকে খুব বেশি টাইম রণিদের বাড়িতে থাকতে হবে না মামু । মায়ের পাঠানো গিফটগুলো নিয়ে তুমি ওদের বাড়িতে যাবে। মুণ্ডনের সময়টুকু থাকবে। তার পর লাঞ্চ করেই যাতে ফেরার ট্রেন ধরতে পারো, তার ব্যবস্থা আমি করে রাখব।’ শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কথাগুলো বলার সময় মেয়েটা কেন একবারও ভাবল না, বয়স্ক যে লোকটা প্রায় ছয়শো কিলোমিটার ট্রাভেল করে পঠকৌলি যাবে, ঘণ্টা দুয়েক সেখানে কাটিয়ে, বিশ্রাম না নিয়ে ফেরার সময় তার কতটা কষ্ট হবে?
গিফটও কম নাকি? দুটো বড়ো স্যুটকেশ লেগে গেছে সে সব ঢোকাতে। বনিদি জিজ্ঞেস করেছিল, “কাকে কী দিতে হবে রে?’ আমার সামনেই পঁচিশজনের লিস্ট তৈরি করেছিল রোশনি । তাতে রৌণকের বাবা-মায়ের নাম তো বটেই, চাচা-চাচি, বুয়া, ভাবীদের সবার নাম ছিল। ও যে ফদটা দিয়েছিল, তাতে আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। ‘মামু, ওদের ওখানে অদ্ভুত সব নিয়ম। মেয়েপক্ষের লোক যতবার যাবে, প্রত্যেকবার সবার জন্য গিফট নিয়ে যেতে হবে। তুমি এবার প্রথম যাচ্ছ। পুরুষদের জন্য জামা-প্যান্টের পিস, মেয়েদের জন্য শাড়ি, পারলে কসমেটিকস দিতেই হবে। এ ছাড়া, খুশবুর জন্য সোনার বালা মাস্ট। নইলে আমার মুখ থাকবে না।’
মুখ ফসকে তখন আমি বলে ফেলেছিলাম, ‘বলিস কী! কত টাকার ধাক্কা, বুঝতে পারছিস? তোর মা পাবে কোথায়?’
রোশনি নির্বিকার, বলেছিল, ‘তা বললে তো চলবে না মামু। আমার বিয়ের সময় মায়ের কিচ্ছু খরচ হয়নি। বিয়ের বাজারে ওখানে রণির দাম কত হত, জানো? অন্তত দশ লাখ টাকা নগদ আর একটা আই টোয়েন্টি গাড়ি। বিনে পয়সায় এমন একটা পাত্তর পেয়ে গ্যাছো, তোমাদের কপাল ভালো। মাকে ইলঅ্যাডভাইস দিও না। গিফটগুলো কেনার ব্যবস্থা করো। দরকার হলে মাকে একটা এফডি ভাঙিয়ে ফেলতে বলো।’ শুনে বনিদির চোখটা ছলছল করে উঠেছিল। আর আমার মনে হয়েছিল, ভাগ্যিস বিয়ে করিনি। নিজের মেয়ে হলে ঠাস করে গালে একটা চড় মারতাম। কিন্তু, মেয়েটাকে কিছু বলা যাবে না। বনিদি কষ্ট পাবে। পরে চাপ দিয়ে রোশনি অবশ্য সব আদায় করেছিল। গড়িয়াহাটের নামী দোকানে গিয়ে গিফটগুলো নিজে পছন্দ করে কিনেছে। কিন্তু যাদের জন্য কেনা, তাদের মনমতো হল কিনা, ও নিশ্চিত হতে পারছিল না।
মনে অশান্তি নিয়ে কাল ট্রেনে উঠেছিলাম। ঠান্ডার জন্য রাতে ঘুমও হয়নি। ভোর ছ’টায় স্টেশনে নেমে দেখি, রৌণক দাঁড়িয়ে। পা ছুঁয়ে প্রণাম করে, একগাল হেসে ও বলেছিল, “ওয়েলকাম মামাজি। আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে, খুব টায়ার্ড। আগে চলুন, আপনাকে হোটেলে নিয়ে যাই। ওখানে ঘন্টা তিন-চারেক রেস্ট নিয়ে, ব্রেকফাস্ট করে, তার পর আমাদের বাড়িতে যাবেন।’ স্যুটকেশ দুটো নিজেই ও গাড়িতে তুলে নিয়েছিল। তার পর কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘পিতাজি এত লোককে নেমন্তন্ন করে ফেলেছেন, সবাইকে বাড়িতে অ্যাকোমোডেট করা যাচ্ছে না। স্পেশাল কয়েকজনকে হোটেলে রাখতে হচ্ছে।’ সাত-আট বছর কলকাতায় কাটানোর জন্য রৌণক বাংলাটা ভালো বলতে পারে। অত্যন্ত ধীর-স্থির, ঠান্ডা মাথার ছেলে। কোনও বদ অভ্যাস নেই । মদ ছোঁয় না, সিগারেট খায় না। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয়, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য। রোশনির জন্য আমরাও বোধহয় এত ভালো পাত্তর জোগাড় করতে পারতাম না। আর জোগাড় করে দিলেও রোশনির সঙ্গে সে ঘর করতে পারত না। নিজের পড়াশুনো আর কলেজে পড়ানো ছাড়া রোশনি আর কিছুই করে না। কিন্তু অফিস সামলেও সংসার চালানো, এমনকি বাচ্চার দেখাশোনা রৌণকই করে। অসীম ধৈর্য্য ছেলেটার। গাড়িতে উঠে রৌণক বলেছিল, ‘খুশবুর মুণ্ডন যেখানে হবে, আপনি কি সেখানে যেতে চান মামাজি?’
জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘অনুষ্ঠানটা বাড়িতে হচ্ছে না?’
‘না, মামাজি। এখান থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে খুরাসো বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে দুর্বাসা মুনির আশ্রম এখনও রয়েছে। পণ্ডিতজি ওখানেই। মুণ্ডন করাতে বলেছেন। বেলা ঠিক ন’টার সময় আমরা ঋদ্ধিকে নিয়ে খুরাসোতে যাব।‘
‘তোমরা ফিরবে কখন ?’
‘অনেকক্ষণ ধরে যজ্ঞ-টজ্ঞ হবে। আমাদের ফিরতে বেলা একটা বেজে যাবে।’
‘পাঠকজিও কি তোমাদের সঙ্গে যাবেন?’
‘না, পিতাজি ততক্ষণ ইনভাইটিদের সামলাবেন। আমরা কাজগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছি মামাজি।’
বাবার কাজ ছেলেরা ভাগাভাগি করে নেবে, এটাই তো সুস্থ সামাজিক লক্ষণ। বলেছিলাম, ‘রিটায়ার করার পর পাঠকজি এখানে সময় কাটাচ্ছেন কী করে?’
‘পিতাজি ঠিকই করে রেখেছিলেন, শেষ জীবনটা পঠকৌলিতে কাটাবেন। এখানে ফ্রেশ এয়ার, ফ্রেশ ভেজিটেবলস। ওয়াটার ইজ অলসো ভেরি গুড। বাড়ির চারপাশে, বাউন্ডারির ভিতরই উনি খেতি করেছেন। সেখানে পিতাজি সবজি চাষ করেন। দিনের অনেকটা টাইম দেন। তা ছাড়া, এই গ্রামে আমাদের প্রচুর রিলেটিভ থাকেন। ভালো-মন্দে তাঁদের পাশে থাকার কথা ভেবেই উনি এখানে বাড়ি বানিয়েছেন।’
বাহ, কী সুন্দর চিন্তাধারা। আমাদের বয়সী লোকেরা তো এই রকম টেনশনহীন জীবনই কাটাতে চান। কজনের ভাগ্যে সেটা জোটে? আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে যে বিরাট আনন্দ, তা-ই বা কজন বোঝেন? জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘গ্রামে এসে থাকার ইনস্পিরেশনটা পাঠকজি কার কাছ থেকে পেয়েছেন?’
রৌণক বলেছিল, ‘আমার দাদাজির কাছ থেকে। দাদাজি পুলিশ অফিসার ছিলেন। উনি এসপি হয়ে রিটায়ার করেন। তারপর অনেকেই ওঁকে পরামর্শ দেন, লখনউতে সেটল করে যেতে। কিন্তু, কারও কথা উনি শোনেননি। দাদাজিকে ফলো করেছেন পিতাজি। আমরাও পিতাজির কাছে একটা জিনিস শিখেছি মামাজি। যে যত বড়ো চাকরিই করো না কেন, ফ্যামিলি আগে। আফটার অল, চাকরিটা তো করা ফ্যামিলির জন্যই। ফ্যামিলিকেই প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত।’ কথাগুলো শুনে চমকে তাকিয়েছিলাম। কতই বা বয়স ছেলেটার! চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। এরই মধ্যে এত পরিণতমনস্ক হয়ে গেছে! এই বয়স থেকে ছেলেটা পরিবারের পরম্পরা রাখার কথা ভাবছে! আমার বয়স পঁয়ষট্টি ছাড়াল। আজ পর্যন্ত রৌণকের বয়সী কোনও বাঙালি ছেলের মখে আমি এমন কথা শুনিনি। ভিড়ের মাঝে বসেই রৌণকের কথা ভাবছি। এতই যার শিকড়ের টান, বিয়ের সময় সে বাবা-মাকে অগ্রাহ্য করল কী করে?
দূর থেকে ব্যান্ডপার্টির বাজনা বেজে আসছে। আওয়াজটা এসে থামল গেটের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচটা গাড়ি এসে ঢুকল বাউন্ডারির ভিতরে। গাড়ি থেকে নেমে এলেন পাঠকজির স্ত্রী, কোলে খুশবুকে নিয়ে। নেড়া হওয়ার সময় বোধহয় খুশবু কান্নাকাটি করেছে। মুখ-চোখ ফোলা। কলেজে যাওয়ার আগে মেয়েটাকে রোশনি রোজ বনিদির কাছে রেখে যায়। অফিস থেকে ফেরার সময় রৌণক ওকে বাড়ি নিয়ে যায়। ছয় মাস বয়স থেকে, বলতে গেলে বনিদিই মেয়েটাকে মানুষ করেছে। ঝাঁকড়া চুলে ওকে খুব সুন্দর দেখাত । বনিদি রোজ বিকেলে ওর চুলে দু’বেনুনি করে দিত। ওর নেড়া মাথায় এখন রঙিন শোলার মুকুট। তার ফাঁক দিয়ে ছোট্ট একটা টিকি দেখা যাচ্ছে। খুশবুকে দেখে আমার হাসিই পাচ্ছে। আমাকে দেখে ফের কান্না ছাপিয়ে এল ওর দু’চোখে। অভিযোগের সুরে বলল, “দাদাম্মাজি, দেখো, দাদি নে মেরে বাল কাটোয়া দিয়া।”
পাঠকজির স্ত্রীর আশপাশে রোশনির বয়সী এয়োতিদের ভিড়। প্রত্যেকের হাতে উপচারের ডালা। এর বোধহয় রৌণকের তুতো-ভাইদের বউ অথবা ওর বিবাহিত তুতো-বোন। এদের মাঝে হঠাৎই রোশনিকে চোখে পড়ল। মুখ তেতো করে শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোমটা দেওয়া বলে প্রথমে ওকে চিনতে পারিনি। দেখলাম, রোশনিও আমাকে না-চেনার ভান করল। তার পর খুশবুকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। পাঠকজির স্ত্রী দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। সেজে আছেন বলে নয়, ভদ্রমহিলা এখনও যথেষ্ট সুন্দরী। পরনে গাঢ় সবুজ রঙের দামি কাঞ্চিভরম শাড়ি। গলা আর হাত সোনার গয়নায় ভর্তি। তাতে আরও আভিজাত্য ফুটে বেরোচ্ছে। গয়না দেখে তখনই আমার মনে পড়ল, কথায় কথায় রোশনি একদিন বনিদিকে বলেছিল, ‘মা, ছমছমির যা গয়না আছে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমি বাবা ওঁর সঙ্গে কোনও কনফ্রনটেশন যাব না। মরে গেলে গয়নাগুলো তো আমাকেই হাতাতে হবে। আমাকে যা করতে বলছে, এখন আমি করে যাচ্ছি।’ বনিদি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কী করতে বলছে তোকে?’
‘সপ্তাহে পাঁচদিন নিরামিষ খেতে বলেছে। মাসে একদিন উপোষ। রোজ হনুমানজির পুজো করতে বলেছে। লাস্ট যেবার আমি পঠকৌলিতে গেলাম, সেবার আমায় টেস্ট করেছিল। সত্যিই আমি হনুমান চাল্লিশা পড়ি কিনা? ওরা জানে না, আমি মুখস্ত বিদ্যায় ওস্তাদ। শুধু হিন্দি নয়, বাংলাতেও হনুমান চাল্লিশার পুরোটা বলে গেলাম। শুনে ছমছমি খুব খুশি।’
রোশনি উঠে যাওয়ার পর বনিদিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ছমছমিটা কে রে দিদি?” বনিদি বলেছিল, ‘ওর শাশুড়ি। বেয়ান এই বয়সেও সব সময় পায়েল পরে থাকেন বলে, রোশনি ওর নাম দিয়েছে ছমছমি। ভাব তো, কথাটা যদি কোনওদিন রণির কানে যায়, তা হলে কত দুঃখ পাবে? দোষ আমারই বুঝলি শানু। মেয়েটাকে ঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি। তোর জামাইবাবুর আদরে বাঁদর হয়ে গেছে।’
রৌণকের মা দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছেন। আক্ষেপ করছেন, খুশবুর চূড়াকরণ বা মুণ্ডনে একটু দেরি হয়ে গেল। বাচ্চার এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে করানোটাই ভালো। কেননা, ভদ্রমহিলা বোঝালেন, মুণ্ডন হচ্ছে হিন্দু ধর্মের ষোলো সংস্কারের আট নম্বর সংস্কার। যে চুল নিয়ে বাচ্চা জন্মায়, তা কামিয়ে ফেলার বিধান শাস্ত্রকাররা দিয়ে গেছেন বিশেষ কারণে। ওই চুল হল বাচ্চার আগের জীবনের অবাঞ্ছিত চিহ্ন। যত তাড়াতাড়ি তা মুছে ফেলা যায়, ততই মঙ্গল। তার ফলে বাচ্চা নির্মল ভবিষ্যতের দিকে এগোতে পারবে। এই তথ্যগুলো আমার জানা ছিল না। শুনে বেশ শ্রদ্ধাই হতে লাগল ভদ্রমহিলার উপর। উনি আরও বললেন, ‘পাঠকজির খুব ইচ্ছে ছিল, মুণ্ডন হরিদ্বারে গিয়ে করাবেন। কিন্তু ওখানে এত রিলেটিভদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না । আপনাদেরও এই বাড়িতে ডেকে আনতে পারতাম না।’
“রৌণকের মা কথাগুলো এমন মার্জিত ভঙ্গিতে বললেন যে, পুরনো একটা কথা ভেবে আমার লজ্জাই করতে লাগল। রোশনির বিয়ের আগে মাত্র একবারই ফোনে ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সামনাসামনি কথা বলতে চাই বলায়, উনি সেদিন রূঢ়ভাবে বলেছিলেন, ‘প্লিজ, আপনারা কেউ আমার বাড়িতে আসবেন না। এলে আমরা কিন্তু কেউ থাকব না।’ আমিও চ্যালেঞ্জের সুরে বলেছিলাম, “ঠিক আছে। দেখি, বিয়েটা কী করে আপনারা আটকান।’ সময়ের সঙ্গে কত কী পাল্টায়। সময় কত ক্ষতই না মুছে দেয়। যে ভদ্রমহিলা আমাকে বলেছিলেন, বাড়িতে আসবেন না, তিনিই আজ উল্টো কথা বললেন। কথা বলার ফাঁকেই পাঠকজি সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। স্ত্রীকে বললেন, ‘আপ অন্দর যাইয়ে রসোম শুরু হোনেওয়ালা হ্যায়।’
শুনে ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, ‘ভাইসাব, আপ আইয়ে। খুশবু কো আশীর্বাদ করনা হ্যায়।’ জুতো খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখি, ড্রয়িংরুমটা ছোটোখাটো একটা হলঘর। সিলিং থেকে বিরাট একটা ঝাড়বাতি ঝুলছে। উজ্জ্বল আলোর নীচে, এক পাশে কাঠের সিংহাসনে খুশবুকে কোলে নিয়ে বসে আছে রৌণক। পুঁচকে মেয়েটার গলায় বেশ কয়েকটা সোনার চেন। হাতে সোনার বালা, আঙুলে চার-পাঁচটা আংটি। চোখে পড়ল, সিংহাসনের পিছনে আধ ঘোমটা দিয়ে শাশুড়ির পাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রোশনি। আত্মীয়রা একে একে হাজির হচ্ছেন। আশীর্বাদ তো নয়, তাঁরা টাকার বৃষ্টি করে যাচ্ছেন। কেউ টাকার মালা পরিয়ে দিচ্ছেন খুশবুকে। কেউ আদর করে টাকার বান্ডিল রেখে যাচ্ছেন পাশে। পাঠকজি একটা পুঁটলি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বেটি, ইয়ে আপ কো ইস্কুল অ্যাডমিশন কা লিয়ে। এক লাখ এক রুপিয়ে।’ দেখে আমার খুব ভালো লাগল । অবাঙালিদের অনুষ্ঠানে কত সুন্দর এই কালচার। আমরা বাঙালিরা বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, উপনয়ন, অন্নপ্রাশনে কত রকম হাবিজাবি জিনিস কিনে দিই। তার বদলে টাকা দেওয়ার প্রচলন থাকলে, যাকে দেওয়া হচ্ছে, তার অনেক কাজে লাগে।
হঠাৎ মোবাইলে পিং করে একটা শব্দ । কোনও মেসেজ এসেছে বোধহয়। সুইচ অন করে দেখি, রোশনি মেসেজ পাঠিয়েছে। ‘পকেটে টাকা আছে তো?’
বিরক্তি চেপে টাইপ করলাম, ‘থাকবে না কেন ? সোনার বালাটাও এনেছি।’
‘তা হলে দাঁড়িয়ে আছ কেন মামু? শোনো, সবার সামনে শুধু বালাটা দিও না। আশীর্বাদের সময় কিছু টাকা দিও ।’
পাঞ্জাবির পকেট থেকে সোনার বালা আর দু’হাজার টাকার একটা নোট বের করে খুশবুকে আশীর্বাদ করলাম। আর কী করলে রোশনি খুশি হবে, বুঝে উঠতে পারলাম না ।
প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল আশীর্বাদ অনুষ্ঠানটা শেষ হতে। ভিড় পাতলা হতেই রৌণকের মা বললেন, ‘রোশনি, মামাজি কো খানা ইধার লাগাও। ঠিক সে করনা। সমঝ গিয়া না বেটি?’ ভদ্রমহিলা স্নেহচ্ছলে বললেন বটে, কিন্তু আমার মনে হল আদেশ ।
রোশনি বলল, ‘হ্যান, মাম্মিজি। আভি লাগাতা হু।’ কথাটা বলেই ঘোমটা সামলাতে সামলাতে ও দৌড়ল কিচেনের দিকে। স্পষ্ট দেখলাম, রৌণকের মা আরেকটা মেয়েকে চোখের ইশারা করলেন। সেও কিচেনের দিকে গেল। সম্ভবত দেখতে, রোশনি ঠিকঠাক কাজটা করছে কিনা। দেখে মনে মনে হাসলাম। এর পরের আধ ঘণ্টা ধরে যা দেখলাম, সেটা বনিদির কাছে গিয়ে বলার মতো ঘটনা ৷ রোশনি খাবার সাজিয়ে এনে দিল। সব নিরামিষ পদ… রোটি, চাউল, সবজি, পনিরের তরকারি, স্যালাড, রায়তা, টকদই আর গোলাপজামুন । এই মেনু আমাদের বাঙালিদের কোনও অনুষ্ঠানে করলে নিন্দার বন্যা বয়ে যেত। চর্বচোষ্য না খাওয়ালে বাঙালির তৃপ্তি হয় না । মাছ-মাংসের পিছনে খরচা করেই বাঙালি ফতুর। কিন্তু এঁদের এখানে রেওয়াজটা বাস্তবসম্মত। তারিফ করার মতো।
তোয়াজ করে রোশনি আমাকে খাওয়াল ৷ এই কাজটা কোনওদিন ও কলকাতার বাড়িতে করেছে কিনা, আমার মনে পড়ল না। দিনের পর দিন দেখেছি, জল খাওয়ার দরকার পড়লেও বনিদি বা কাজের মেয়েকে ও হুকুম করে। এঁটো বাসনটাও তোলে না। চায়ের কাপ টেবিলে ফেলে রেখে চলে যায়। ধোয়াধুয়ি তো দূরের কথা। সেই মেয়ে আবার হিন্দিতে জিজ্ঞেস করছে আমাকে, ‘মামাজি, আপ কো কুছ দু ক্যায়া।’ সোফায় বসে রৌণকের মা সব লক্ষ্য রাখছেন। ওই অল্প সময়ের মধ্যে আনার সব বোঝা হয়ে গেল, এত বড়ো সংসারটা ওঁর আঙ্গুলিহেলনেই চলছে। কোথায় কী ঘটছে, উনি সব খবরই রাখেন। ওঁর ইচ্ছের বাইরে এই বাড়িতে কিছু হয় না, কেন জানি না, আমার মনে হল, আমি উঠে যাওয়ার পর রোশনিকে উনি পাস বা ফেল মার্কস দেবেন। লাঞ্চ হয়ে যাওয়ার পর দেখি, বেসিনের কাছে হাতে তোয়ালে নিয়ে রোশনি দাঁড়িয়ে আছে। ফিসফিস করে আমাকে বলল, ‘আর বেশিক্ষণ তোমার থাকার দরকার নেই মামু। বিকেল চারটেয় একটা ট্রেন আছে। তুমি তাতে চলে যাও। রণিকে গাড়ি বের করতে বলছি।’
গাড়ির কথা বলতেই আমার স্যুটকেশ দুটোর কথা মনে পড়ল। জিজ্ঞেসা করলাম, ‘গিফটগুলো কি রৌণক নামিয়ে এনেছে?’
‘হ্যাঁ। আমি ডিসট্রিবিউটও করে দিয়েছি। মাকে বোলো, আমার কেনা জিনিসগুলো সবার পছন্দ হয়েছে। তুমি আর দেরি কোর না মামু। দেখলে তো, তোমায় কী ইনসাল্ট করল।’
বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে?’
‘দেখলে না, বাইরে যে ব্যুফের ব্যবস্থা হয়েছে, তা ব্রাক্ষ্মণদের জন্য। তুমি ব্রাক্ষ্মণ নও বলে, তোমাকে আলাদা খেতে বলল বাড়ির ভিতরে। চালাকিটা তুমি ধরতে পারলে না?’
…খানিক পরে হোটেলে ফেরার জন্য গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। রৌণক গাড়ি আনতে গেছে। ঠিক করে ফেলেছি, রোশনি যখন চায় না, তখন আমার কলকাতায় ফিরে যাওয়াই উচিত। হঠাৎ দেখি, পাঠকজি আর তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে রোশনি এসে হাজির। পাঠকজি অনুরোধের সুরে বললেন, ‘সম্বন্ধজি, আপনাকে বলা হয়নি। কাল সকালে খুশবুর মুণ্ডন করা বাল আমরা গঙ্গা মাইকে দেব। সেজন্য বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে যেতে হবে। আপনিও আমাদের সঙ্গে যাবেন। আপনি কিন্তু না করবেন না।’
বললাম, ‘কিন্তু আমার যে আজ বিকেলেই ফিরে যাওয়ার কথা।’
পাঠকজির স্ত্রী বললেন, ‘তা হয় না। মুণ্ডনের চুল অতি পবিত্র জিনিস। গোবর আর দই মাখিয়ে ওটা জলে ফেলতে হবে। ওই সময় মায়ের তরফের কাউকে না কাউকে থাকতে হয়। রোশনি বেটি, সম্বন্ধজিকে তুমি বলো, আজ রাতটা হোটেলে থেকে যেতে। না হলে খুশবুর অকল্যাণ হবে। উদি কাল বিকেলে বারাণসী থেকে না হয় কলকাতায় চলে যাবেন। রণি টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবে।’ ঘোমটার ফাঁক থেকে ফিসফিস করে প্রথমে রোশনি কী বলল, ঠিক বুঝতে পারলাম না। পরের কথাটা কানে এল, ‘মাকে ফোন করে আমি বলে দেব। যেন চিন্তা না করে।’
গাড়িতে উঠে আমিও ঠিক করে নিলাম, হোটেলে গিয়ে ফোনে বনিদিকে আমি কী রিপোর্ট দেব।