Spread the love

                              স্বপ্নময় চক্রবর্তী

মেয়ের বিয়ের জন্য খবর কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন সুবিমল। বয়ান লিখছেন। পাত্রী এম এ বি এড, ৫ ফুট চার ইঞ্চি লিখেই মনে হল শিক্ষাগত যোগ্যতার আগে ফর্সা, সুন্দরী লেখা উচিৎ। পাত্রপক্ষ প্রথমেই ফর্সা, সুন্দরী দেখবে। সুতরাং, পাত্রী ফর্সা, প্রকৃত সুন্দরী। এম এ বি এড স্কুল শিক্ষিকা। SSC। একটা শব্দ কমানো যায়। স্কুল বাদ। SSC শিক্ষিকা। এবার বয়স। ৩২। কাশ্যপ গোত্রটা শঃ গোঃ লিখলে চলে? চলে না। শুধু কাশ্যপ লিখলেই ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে। এবারেই আসল সমস্যা। ডিভোর্সি লিখতে হবে। গায়ত্রীকে ডাকেন সুবিমল। হ্যাঁগো, ডিভোর্সি তো লিখতে হবে। কি লিখব? নামমাত্র ডিভোর্সি লিখব?

গায়ত্রী কাপড়ের আঁচল জড়াচ্ছে হাতের আঙুলে। পুরনো কথা আর পুরনো ব্যথাই জড়াচ্ছিলেন আসলে। গায়ত্রী বললেন, গোপন করে লাভ কী?

বাচ্চা আছে, সেটাও কি লিখে দেব নাকি! বাচ্চা আছে জানলে কেউ আসবে না।

গায়ত্রী বললেন, পরে তো জানবে।

সুবিমল বললেন, তা হলে তো অনেক কথাই লিখতে হয়। সন্তান আছে, কিন্তু পাত্রীর নিকট থাকে, তার পিতার হেফাজতেই থাকে, এত লিখতে গেলে যে গাদাখানেক টাকা বেরিয়ে যাবে।

গায়ত্রী চুপ করে থাকেন।

সুবিমল বললেন, শুধু ডিভোর্সি লিখে দিচ্ছি। শেষ বাক্যটা ‘উদার মনের পাত্র চাই’।

বয়ানটা পড়ে শোনালেন সুবিমল।

গায়ত্রী বললেন- খালি উদার? ব্যস!

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ব্যাঙ্ক অফিসার এ-সব কিছু লিখবে না!

সুবিমল বললেন, অত লিখে কাজ নেই। সম্বন্ধগুলো আসুক তো, তার পর দেখা যাবে।

মেয়ে সাত বছর ধরে এই বাড়িতেই। বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ডিভোর্সটা মিটল। তার অনেক আগে থেকেই মেয়ে এখানেই। বাচ্চাটা ওরা চাইল। সুবিমল মেয়েকে বোঝাল- বাচ্চা ওরা চাইছে, ওরা মানুষ করুক ওদের মতো করে, বাচ্চাটাকে নিয়ে জোরাজোরি করে কাজ নেই।

সুবিমল ওর নাতির নাম রেখেছিল কণাদ। প্রাচীন ভারতের এক সায়েন্টিস্টের নামে। ওরা ঠিকুজি কুষ্টি জন্মের সময় মিলিয়ে জ্যোতিষীর কথা মতো ‘হ’ দিয়ে নাম রেখেছে। ‘হ’ দিয়ে হনুমান ছাড়া হরেন ছাড়া আর কোনও নাম পায়নি ওরা। এই সময়ের একটা বাচ্চার নাম হরেন। ওরাই পারে। হরেনের বাপের নাম খগেন করে দিয়েছিল জ্যোতিষীই। সুবিমলের জামাই। নিশ্চয়ই ওদের ফ্যামিলি অ্যাস্ট্রোলজার বলেছিল ‘খ’ দিয়ে নাম রাখতে হবে। তবে, ওর একটা ডাকনাম ছিল লাট্টু। পাড়ার কাছাকাছি থাকে। মোটর সাইকেল আছে, নিজেদের তিনতলা বাড়ি, ফুল মার্বেল। বি কম পাস করে ব্যবসা করছে। অর্ডার সাপ্লাই ছাড়া প্রোমোটারিও। এই যে ফ্ল্যাটটা, জামাই লাট্টুর কাছ থেকেই কেনা। আর ফ্ল্যাটের ব্যাপারে আসা-যাওয়া করতে করতেই সুমির সঙ্গে আলাপ।

সুমি তখন এম এ পড়ছে। ফ্ল্যাটটা কেনার আগেই লাট্টুর মোটরসাইকেলে সুমিকে দেখা যেতে লাগল। বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীতে আলোচনা হল- লাট্টু পাত্র হিসেবে কতটা উপযুক্ত। গায়ত্রী বলল- ছেলেটা কিন্তু দেখতে বেশ ভাল, খুব উদ্যোগী, রোজকারপাতিও ভাল করছে। ধরো না, এই যে ফ্ল্যাটটা বানাচ্ছে, কত লাভ হবে বলে মনে হয়? সুবিমল বলেছিল বাড়িতে পনেরোটা ফ্ল্যাট থাকছে, প্রতিটা থেকে যদি দু’লাখ করেও প্রফিট করে, তিরিশ লাখ থাকছে।

তবেই বোঝ। রিটায়ার করেও তুমি তিরিশ লাখ পাওনি। সারা জীবনের সঞ্চয়ের থেকে বেশি লাভ এক-দেড় বছরে। তা ছাড়া লেখাপড়াও করেছে। বাড়িতে গাড়িও আছে শুনেছি। ওর বাবাও তো বিজনেস করত। বিজনেস ফ্যামিলি। খারাপ কী? বাঙালিতো কেরানিগিরি করেই গেল।

স্কুলজীবনে পড়া একটা সংস্কৃত শ্লোক মনে পড়েছিল সুবিমলের।

কন্যা বরায়তে রুপং

মাতা বিত্তং পিতা শ্রুতম

বান্ধবা কুলমিচ্ছন্তি

মিষ্টান্নম ইতরাজনাঃ।

ছেলেটা সত্যিই দেখতে ভাল। প্রায় ছ’ফুট হাইট। ঝাঁকড়া চুল, কার্তিকের মতো গোঁফ, ফর্সা রঙ। চব্বিশ বছরের একটা মেয়ের এমন ছেলে ভাল লাগতেই পারে। তা ছাড়া মোটরবাইক। মায়েরা তো বিত্তটা গণ্য করে। সংস্কৃত শ্লোকেই বলা আছে। তা ছাড়া সেই কবে, কোন মা নাকি বলেছিল, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। গায়ত্রীও চেয়েছিল ওর সন্তান যেন কেক-এ পেস্ট্রিতে, প্যাটিস বার্গারে, চকোলেট-আইসক্রিমে থাকে। থাকে যেন লিপস্টিক-ক্লেনজিং মিল্ক, সেন্ট-শ্যাম্পুতে।

আর পিতা শ্রুতং মানে বাবারা চায় মেধা। সে যুগে ছিল। এখন বাবারা চায় চালাক-চতুর স্মার্ট গাই। সুবিমলও তাই চেয়েছিল। লাট্টু যখন বাড়ি এসে জলের গেলাসটা হাতে নিত, ওর চার আঙুলে চার রকমের পাথর বসানো চারটে আংটি চকচক করে উঠলেও ওটাকে বৈভব ভেবেছে। ভাবেনি মনের দুর্বলতা।

বিয়েটা হয়ে গেল। আসলে সুমিই ওর মাকে জানিয়েছিল। প্রস্তাবটা মেয়ের বাবাকেই করতে হয়। ছেলের বাড়ি গিয়ে মন্দ লাগেনি। বারান্দায় দোলনা, ঘরে দামি ফার্ণিচার, ঠাকুরঘর। সেকেলে কায়েত বাড়ির ছেলে। সুমির সঙ্গে মানিয়েছিল ভাল। কারণ সুমিও তো কম লম্বা নয়। মেয়েদের চার ফুট চার ভালই বলতে হবে।

অল্প কয়েক দিন পর থেকেই বাড়িটার ব্যাপার-স্যাপারগুলো অদ্ভুত ঠেকতে লাগল সুমির। একটা রোববার সুমিকে বলা হল সকলের জন্য খাবারটা তুমিই কর। কাজের মেয়ে সবিতা লুচি বেলে দিল সুমি ভাজল। সঙ্গে বেগুন ভাজা।

লাট্টুর মা রেগে কাঁই। তোমার মা এই শিক্ষাও দেয়নি যে, ত্রয়োদশীতে বেগুন খেতে নেই।

সুমি বলেছিল, কবে বেগুন খেতে নেই জানি না, তা ছাড়া জানব কী করে আজ ত্রয়োদশী?

কেন? চোখের সামনে বাংলা ক্যালেন্ডারটা ঝুলছে না!

রান্না করতে হত এক বিচ্ছিরি জায়গায় দাঁড়িয়ে। পুবদিকে দাঁড়িয়ে রান্না, দক্ষিণে মাথা দিয়ে শোয়া, শোকেসের দরজা বা আলমারির দরজা যদি কোনওভাবে খোলা থাকত, তুলকালাম কান্ড বাধত। আলমারি নাকি বাইরের নেগেটিভ এনার্জি টেনে নেয়। রান্নাঘরে ঢোকার আগে স্নান করে নিতে হবে। যত শীতই হোক না কেন। শনিবারে শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে পাড়ার শনি মন্দিরে যেতে হবে। যতক্ষণ পুজো হচ্ছে বসে থাকতে হবে। শাশুড়ির জন্য অবশ্য ওরা স্পেশাল ব্যবস্থা করে রাখত- প্লাস্টিকের চেয়ার। সুমিকে নাড়ুর মা, ভুতির মা-দের সঙ্গে দেশি মদের গন্ধবিধুর রিকশাওলাদের সঙ্গে বসে থাকতে হত মাটিতে। লাট্টু যখন পাঁচ হাতের আঙুলে মোটরসাইকেলের হ্যান্ডেল চেপে ধরত, আঙুলের শৌর্যই চোখে পড়েছিল শুধু। বিয়ের পর সুমি বুঝতে পারল ওর বরের দু’হাতে দশটার বদলে ষোলটা আঙুল থাকলে ষোলটা আঙুলেই পাথর বসানো আংটি পরত। বুড়ো আঙুলে আংটি থাকে না। লাট্টুর আট আঙুলে দশটা আংটি এখন। মানে, কোনও কোনও আঙুলে দুটো করে।

ন’টা তো গ্রহ। সবক’টা গ্রহকে বশে রাখার ব্যবস্থা করার পরও একস্ট্রা কিছু। আসলে ওর নিরাপত্তার অভাব ছিল। ভিতরে ভিতরে ভয়ও ছিল। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই বুঝেছিল সুমি, ওর বর কোনও বেআইনি কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত। কোনও কোনও ফোন এলে বাইরে গিয়ে কথা বলত। শুনেছে, লাট্টু বলছে- ঘাবড়াইয়ে মত, বিলকুল সেম সেম হো যায়েগা। কখনও শুনেছে লোগো, রাবার স্ট্যাম্প সব কিছু হয়ে যাবে।

ওদের বাড়ির একতলাতেই অফিস ঘর ছিল একটা। এ ছাড়া বৌবাজারের দিকেও কি একটা অফিস ছিল ওর। সুমি একদিন লাট্টুকে বলেছিল, তুমি কী কী কর। বল, লুকিও না প্লিজ, ওরা তখন পুরীতে। ভাল হোটেলে। অনেকটা বিয়ার ছিল পেটে, তবুও, মুখ খুলল না লাট্টু। বলেছিল অনেক কিছু করি, তুমি বুঝবে না।

খারাপ কিছু কর না তো?

লাট্টু গেয়ে উঠেছিল- কী ভাল, কী মন্দ সে তার হিসেব করি না…।

গন্ডগোলটা লাগল সুমির বি এড পড়া নিয়ে। সুমিও নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিল। কারণ, লাট্টুর কাজকর্ম রহস্যময় লাগছিল। আর ভিতরে ভিতরে ভয় তৈরি হচ্ছিল। তখন বি এড করার কথা ভেবেছিল, বি এড করে স্কুলের চাকরির পরীক্ষায় বসবে ভেবেছিল। সুমির শাশুড়ি, শ্বশুর এবং লাট্টু তিনজনই আপত্তি করেছিল খুব। লাট্টু বলেছিল কেন? চাকরির কথা ভাবছ কেন? আমার কি কমতি আছে কিছু? কত চাও হাত খরচা! মাসে ক’বার ফেসিয়াল করতে চাও? কোথায় শপিং করতে চাও? টাকার অভাব আছে কিছু? গাড়িও ছিল। দুটো। একটা লাট্টু ব্যবহার করত, আরেকটা বাড়িতে থাকত। সুমির শাশুড়ি বোনের বাড়ি, দক্ষিণেশ্বর, এখানে-ওখানে যেতেন। সুমির শ্বশুরমশাই রোববার রোববার বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলত। তাসের পর একটু মদ্যপান। বিয়ের পর একটু অবাক হয়েই সুমি ওর শাশুড়িকে বলেছিল, বাবা মদ খান? সাত্ত্বিক শাশুড়ি বলেছিল, পুরুষ মানুষ ও-সব করবে না? হপ্তায় একদিন তো…।

বি এড-এর ফর্ম ছিঁড়ে ফেলেছিল লাট্টু।

সুমি বলেছিল, এম এ পাস করলাম, কেন চাকরি করব না! তা হলে এম এ পাস বিয়ে করেছিলে কেন?

লাট্টু বাঁহাতের বুড়ো আঙুল আর মাঝের আঙুলের কায়দায় শব্দ করে বলেছিল, টুসকি মারলে এম এ পাস চলে আসবে। বাজারে গাদা গাদা এম এ পাস মেয়েছেলে গিজগিজ করছে। তোমার এম এ ডিগ্রি দেখে বিয়ে করেছিলাম নাকি? বিয়ে করেছিলাম তোমার এ-সব দেখে। লাট্টুর হাতটা সুমির বুকের দিকে তাক করা। তা ছাড়া তুমি এর আগে ছেলে চরাওনি- সেটা বুঝে। সতীচ্ছদ ছেঁড়া মেয়েকে বিয়ে করতে চাইনি। তোমার সতীচ্ছদ আমি ছিঁড়েছি, আমি। তার পরই দরজাটা বন্ধ করে খাটে নিয়ে ফেলল লাট্টু। তখন সকাল দশটা সাড়ে দশটা। কোনও বাধা না মেনে ধর্ষণই করেছিল বলা যায়। ঘোচাচ্ছি তোমার চাকরি, ঢুকিয়ে দিচ্ছি, বলতে বলতে কুকুরে মতো কোমরের কাজ করছিল। এর আগে সঙ্গমকালীন সাবধানতা নিত লাট্টু। বলত দুটো বছর একটু আনন্দ করে নি, তার পর বাচ্চা-টাচ্চার কথা ভাবা যাবে। ইয়োরোপ যাব, বুঝলে, সুইৎজারল্যান্ড। বরফের উপর রোপওয়ে চড়া, আইফেল টাওয়ারে উঠব, ভেনিস যাব…। রোজ হনিমুন হবে। রোজ। সে দিনের পর থেকে রোজই ধর্ষণ চলত। বাপের বাড়ি আসতে দিত না। তার পর একদিন পালিয়েই এসেছিল বলা যায়। লাট্টুকে বলে দিয়েছিল আর যাচ্ছি না। সেবার বি এড-এর ফর্ম জমা দেওয়ার দিন পার হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন পর বুঝল সুমি গর্ভবতী। সেই ছেলে কণাদ। অনাকাঙ্ক্ষিত। ছেলেটা হওয়ার পর সুমির শাশুড়ি, শ্বশুর দু’জনই দেখতে এসেছিল। গলায় সোনার চেন পরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ছেলে নিয়ে ফিরে যেতে। ফর্মুলাটা ছিল- বাচ্চা যখন হয়ে গেছে আর চাকরি-বাকরির দিকে মন দেবে না। সুমি যায়নি। ছেলেটা যখন সাড়ে তিন বছরের, ওরা নিয়ে গেল। দিতে কি মন চায়? সাড়ে তিন বছরে অনেক মায়া, অনেক কুহক। সুবিমলই বুঝিয়েছিল। বলেছিল, পৃথিবীটা আসলে নিষ্ঠুর। প্রকৃতির মূল চালিকা শক্তি তো নিষ্ঠুরতা। দেখ না প্রজাপতিটাকে কেমন খেয়ে নেয় টিকটিকি। টিকটিকিকে সাপ। জলের মাছগুলো খাচ্ছি, গাছের ফলগুলো খাচ্ছি। আসলে বাচ্চাটাই মূল কথা। প্রকৃতি বাঁচতে বলে। এরই মধ্যে দুধের ওপরের সরের মতো আদর ভালবাসা, হাসি-কান্না। যখন আমরা দুধ খাই, সর সমেতই খাই। তোকেও তো বাঁচতে হবে। আমাদের বয়েস হয়েছে। যেতে তো হবেই। তুই একলা থাকবি কী করে? খারাপ শোনালেও বলি, ছেলেটাকে ওদের দিয়ে দে।

ওকে ছাড়তে কি আমাদেরও ভাল লাগছে? কিন্তু, পৃথিবী বড় কঠিন। ঝাড়া হাত-পা হয়ে যা। ছেলেটাকে দিয়েই দে।

গায়ত্রীরও নীরব সম্মতি ছিল।

ওদের ঘরে নাকি ছেলে হয় না। লাট্টুর চার দিদির পর লাট্টু হয়েছিল। লাট্টুর বাবাও একমাত্র পুত্র। লাট্টুর পাঁচজন পিসি। পিসিদের ঘরেও ছেলে হয়নি। ওরা খুব যত্নে রাখবে।

ছেলে যখন দুধ খাচ্ছে, তখনই আবার বি এড-এর জন্য চেষ্টা করেছিল সুমি। ভর্তি হল। সুমি বাচ্চাকে ওর

মায়ের কাছে রেখেই কলেজে যেত। বি এড হল। এর পর চাকরির চেষ্টা। চাকরিও হল। বাচ্চাটাকে দেখতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু, ইচ্ছেটাকে মারতে পেরেছে। বার দুয়েক গিয়েছিল। দেখল যত্ন করে করে বেশ মোটা বানিয়ে ফেলেছে ওরা। শেষবার ঢুকতে দেয়নি বাড়িতে। লাট্টু আবার বিয়ে করেছে।

ডিভোর্সটা নেওয়ার পর এতটা বছর কাটল। বিয়েটা আগেভাগেই করে ফেলেছিল। ভুল। কত ভুল মানুষ করে। মানুষ মাত্রই ভুল করে। একটা অসচ্ছল পরিবারের মেয়ে মোটরসাইকেল, পারফিউম আর রূপ দেখে ভুলে গিয়েছিল। সুবিমল খুব একটা বড় মাপের চাকরি করত না। বোনটোনদের বিয়ে দিতে হয়েছে। ভাড়া বাড়িতে থাকত। শেষ জীবনে এই দু’কামরার ফ্ল্যাট। শেষজীবনেই মেয়ে, নাতি-সমেত পুরী গিয়ে নাতিটার মাথায় জগন্নাথের ছড়ি স্পর্শ করিয়ে আনা। যেটুকু নাতিসুখ শেষ জীবনেই, বিচ্ছেদও। জীবন শেষের দিকে যায়। তবু ডিউটি শেষ হয় না। কর্তব্য করতে হবে, ফল কী হবে কে জানে? ফলের কথা ভেব না। মেয়ের বিয়ে দেওয়াটাও ডিউটি। দেখেশুনে বিয়েটা তো দিতেই হবে।

                                                   

বক্স নম্বরই দিয়েছিলেন সুবিমল। মোবাইল দেননি। মোবাইলে অত সড়গড় নন। প্রাথমিক বাছাই করে মেয়েকে বলবেন এবার তুই দ্যাখ। যারা চিঠি লিখেছে বেশির ভাগই ডিভোর্সি। কেউ লিখছে প্রতারিত, কেউ লিখছে বউ-এর মাথা খারাপ ছিল, ‘মানসিক ব্যাধি থাকায় ডিভোর্স সম্পন্ন হইয়াছে’। পাত্রের বাবাই লিখছে বেশি। বিপত্নীকও কয়েকজন ছিল। কয়েকজন পাত্র নিজেই চিঠি লিখেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার পূর্বতন স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে পরলোক গমন করেছেন। একটি কন্যাসন্তান আছে, তিন বৎসর বয়স। মূলত মাতৃহারা কন্যাসন্তানের জন্যই আবার বিবাহ করতে চাই। নিজের শরীরের যেন কোনও চাহিদা-টাহিদা নেই। সবই মেয়ের জন্য। সবই বাৎসল্যরস। ভণ্ডামি আর গেল না। যারা বিপত্নীক কিংবা ডিভোর্সি নয়, তাদের কারুর পায়ে সামান্য খুঁত আছে, কিংবা গায়ে সামান্য সাদা দাগ আছে। কিংবা দুর্ঘটনায় একটি হাত। মানে

ডিভোর্সি মেয়ে হওয়াও একটি খুঁত। সুতরাং…। একজন ব্যবসায়ী ছিল। বয়স ৪৬। অনেক হয়েছে, ব্যবসায়ী আর নয়। একজন লিখেছে— আমি একটি আধ্যাত্মিক আশ্রমের সঙ্গে জড়িত। এতদিন পানিগ্রহণ করি নাই। আমাদের গৃহী হতে বাধা নাই। কিন্তু বিবাহের পর পুরুলিয়ায় আমাদের আশ্রমেই থাকতে হবে…। দু-একজন বেকার ছেলেও লিখেছে। বাছাই-টাছাই করে দুটো বিপত্নীক, একটা ডিভোর্সি আর একটা বেকার মোট পাঁচটা চিঠি সুমিকে দিল। বেকারের চিঠিটা পড়ে বেশ ভাল লেগেছিল সুবিমলের।

চিঠিটা ছিল এরকম— মান্যবরেষু,

বিজ্ঞাপন দেখলাম। আমি নিজে বি এস সি পাস করি কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে। পাস করার এক বছরের মধ্যে একটা চাকরি পাই। কিন্তু, দুই বছরের মধ্যে আমাদের কোম্পানি লকআউট ঘোষণা করে, তার পর বেশ কিছু ছাঁটাই করার পর কোম্পানি খোলে। আমি প্রোডাকশনে ছিলাম। আমাদের সংস্থা কাচ তৈরি করত। আমি ছাঁটাই হই। তার পর আর চাকরি জোগাড় করতে পারিনি। বাড়িতে টিউশনি করি। টিউশনি করে যা আয় হয় সেটা মন্দ নয়। আমি স্কুল লেভেলে বিজ্ঞান বিষয়গুলি পড়াই। আপনার কন্যা কী বিষয় পড়ান আমি জানি না। যদি সুযোগ থাকে বাড়িতে টিউটোরিয়াল ক্লাস খুলতে পারি। যদি স্কুলের পর দু-একটি ক্লাস নিতে পারেন

ভালই হয়। আমার পিতা কয়েক বৎসর হল পরলোক গমন করেছেন। আমার পিতা সরকারি চাকরি করতেন, সেই কারণে মা কিছুটা পেনশন পান। আমার মা খুবই ভাল মানুষ। এখনও সক্ষম। আমি জানি, তাঁর পুত্রবধূকে অনাদর করবেন না।

আরও বলি, ইতিমধ্যে আমি বি এড পাস করেছি, কম্পিউটার ট্রেনিং করেছি, সেইসঙ্গে দু’বার এস এস সি পরীক্ষাতেও বসেছি। পরীক্ষা তো খারাপ হয়নি, কিন্তু চাকরি হয়নি। আমার বয়েস এখন চৌত্রিশ। আরও একবার বসার সুযোগ পাব। আমার নিজের সম্পর্কে সবই জানালাম- যদি দরকারে চিঠির উত্তর দেন, বা ফোন করেন, আমি গিয়ে দেখা করব। পাত্রী দেখতে নয়, আপনারাই বরং পাত্র দেখবেন। আপনাদের মেয়ে যোগ্যতাসম্পন্না। নানা কারণে বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে। মানুষের জীবনে নানা ধরনের জটিলতা আসে, বিপর্যয় আসে। ওটাকে ধর্তব্যের মধ্যেই মনে করি না।

সুমি বলল বেশ সুইট চিঠি। ওকেই আসতে বলে দাও। কথা বলে দেখ। গায়ত্রী বলল, একদম বেকার ছেলে কি ভাল? বরং একটা ডিভোর্সি হলে খারাপ কি? ডিভোর্স কি কেউ শখ করে করে। তিতিবিরক্ত হয়ে তবে না কেউ ডিভোর্স করে। আর একবার যার জীবনে এ-সব হয়েছে তারা সমঝে চলে। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নেয়, যেন আবার এ-সব না করতে হয়। ঠেকে শেখা যাকে বলে আর কি।

সুবিমল বলে- সুমির ওপর ছেড়ে দাও।

সুমিতা বলে- ওই বেকারটাকেই আসতে বল।

– তুই থাকবি তো? তুই কথা বলবি কিন্তু।

                                                   

ছেলেটার নাম হর্ষবর্ধন।

নাম হর্ষ, বর্ধন উপাধি।

ছেলেটা বেশ বিনয়ী বিনয়ী দেখতে। বেশিক্ষণ চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। গায়ত্রী জিজ্ঞাসা করল মা-কে নিয়ে আসতে পারতে তো। হর্ষ বলল- মা-কে আনিনি কারণ মা দুঃখ পাবেন। মাকে বলিনি কিছু। আপনারা তো আমাকে পছন্দ করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। যদি কথা এগোয়, প্রাথমিকভাবে বেকার ছেলেটিকে মেনে নেন, তখন নয় মাকে বলা যাবে।

এর আগে চেষ্টা করেছিলে নাকি?– সুবিমল জিজ্ঞাসা করে।

-করেছিলাম। চাকরি করেন, এমন পাত্রীপক্ষকেই অ্যাপ্রোচ করেছিলাম। নার্স, মহিলা পুলিশ এমন অনেককে। আমার খাওয়াটা নিশ্চিন্ত করতে হবে তো? কোনও জবাব আসেনি। এর পর ডিভোর্সি ধরেছি। সুমি বলল, আমার নাম সুমিতা। বাংলা পড়াই।হর্ষ সত্যিই হর্ষোৎফুল্ল হয়ে বলল, বাঃ। আমি সায়েন্স সাবজেক্টটা সামলে নেব, আপনি ল্যাঙ্গোয়েজ গ্রুপটা।

সুমি বলল, সে না হয় হবে। কিন্তু, ডিভোর্সি।

-জানি তো।

-কেন ডিভোর্স হল জিজ্ঞাসা করবেন না!

-সে আর জিজ্ঞাসা করার কী আছে! মতের মিল হয়নি তাই।

-কেন মতের মিল হল না জিজ্ঞাসা করবেন না?

-সে আর জিজ্ঞাসা করে কী হবে। দু’জন মানুষের মধ্যে কী সবকিছু মিল হয়?

-যদি আপনার সঙ্গে মতের মিল না হয়?

চলে যেতে বললে চলে যাব। আমার তো কোনও ‘সে’ নেই। আমি তো কৃপাপ্রার্থী।

-আপনার মায়ের কি শুচিবাই আছে? ছোঁয়াছুঁয়ি?

-ও-সব তো বুঝি না। মাছটাছও রান্না করেন। এক ফ্রিজেই থাকে। উনি অবশ্য নিরামিষই খান ।

-আপনি চাকরির জন্য জ্যোতিষীর কাছে যাননি কখনও?

-গিয়ে কী লাভ? গাদাখানেক খরচ করাবে…।

-বাড়িতো কাছেই, তাই না? সুবিমল জিজ্ঞাসা করে।

-হাঁটা পথে মিনিট পনেরো। আমার সাইকেল আছে। সাইকেলটা আমার বাবার। বাবা খুব জিনিসপত্রের যত্ন করতেন। আর খুব আদর্শবাদীও। সেলস্ ট্যাক্সে চাকরি করতেন। কিন্তু, তেমন তো পয়সাকড়ি করেননি। বাবার অফিসের একজন বস ছিলেন। অবাঙালি। উনি নাকি খুব কড়া এবং সৎ ছিলেন। বাবার কাছে শুনেছি, ওর নাম ছিল হর্ষবৰ্দ্ধন মেহেতা। ওর নামেই আমার নাম রাখলেন। আর দেখুন, আমি কিছুই হতে পারলাম না। না অসৎ, না সৎ। না কড়া, না নরম।

-কেন সৎ নন বলছেন?

-কারণ, সৎ হতে গেলে তো ক্ষমতা লাগে। আগে চাই পাওয়ার। তার পর তো পাওয়ার মিস ইউজ করার প্রশ্ন। মনমোহন সিং সৎ। সবাই বলে। কিন্তু, রাইটার্স বিল্ডিং-এর একজন বেয়ারাও সৎ হতে পারে, কিন্তু, আনআইডেন্টিফাইড।

ওর কথাবার্তা সুমিতার মন্দ লাগছিল না। সুমিতা এবার বলে ফেলল- আমার কিন্তু একটা ইস্যু আছে। ছেলে। আমার সন্তান।

হর্ষর মুখে বিষাদ-মেঘ দেখা গেল। শুধু সুমিতা নয়, সবাই লক্ষ্য করল।

-কত বড় ছেলে? ছেলেটি মাথা চুলকে জিজ্ঞাসা করল।

প্রায় পাঁচ বছর।

-ও। ঠিক নির্লিপ্ত ‘ও’ নয়। একটু শ্বাস মেশানো ও হ্‌ হ্‌।

-এর পরও কি আপনি রাজি আছেন?

হৰ্ষবর্দ্ধন মাথা চুলকে বলল— ও আমাকে কী ডাকবে?— মানে ব্যাপারটা সেট্‌ল করে আর কি….

সুমিতা বলল, কী ডাকলে আপনার সুবিধা হয়?

হর্ষ বলল— বাবা যদি ডাকে, একটু এমব্যারেসিং লাগবে। আমি তো আসলে ইয়ে না, মানে বাবা না, আঙ্কেল বলতে পারে।

সুমিতা বলে— সে না হয় হবে। তবে এটাও ভাবুন, আমরা যখন শ্বশুরবাড়িতে যাই তখন যিনি আমার মা নন, তাঁকে মা ডাকি, যিনি আমার বাবা নন, তাঁকে বাবা ডাকি, তার বেলা!

হর্ষ বলল— সে তো হয়েই আসছে, আমার মা-ও বলেছিল। তার মা-ও বলেছিল। কিন্তু, আমার বাবাকে তো অন্য কেউ বাবা বলেনি…

ব্যাপারটা অন্য দিকে যাচ্ছে দেখে সুবিমল বলল ও-সব ডাকাডাকির গল্প আসছেই না। বাচ্চাটা তো আমাদের কাছে থাকে না। ওর বাবার কাছেই থাকে।

ও…। এই ‘ও’ টা অন্যরকম। যেন অনেকটা সমস্যা মুক্তির ও।

হর্ষ আর কোনও কথা বলছিল না এর পর। যে প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক— ‘আগের বিয়েটা ভেঙে গেল কেন?— এই প্রশ্নটা ও করল না। তখন সুমিতাই ছোট করে বিয়ে ভাঙার কারণটা বলে দিল।

হর্ষ শুনল। শুনে বলল— আমার ক্ষেত্রে এ-সব সমস্যা নেই। কারণ, আমার তো কোনও জোর নেই। আপারহ্যান্ড নেবার কোনও ক্ষমতাই নেই, অধিকারও নেই। আমি তো সাহায্যপ্রার্থী মাত্র। সব জেনেও যদি কেউ আমাকে বিয়ে করে…।

8

সুমিতা হৰ্ষবৰ্দ্ধনকেই পছন্দ করল। বলল, লোকটা সরল, সাদাসিধে। ওতেই চলে যাবে। বেশি গ্ল্যামারওলা, টাই-পরা বর দরকার নেই আমার। বিয়েটা হল। রেজিস্ট্রি বিয়ে। কোনও ঘটা নয়। স্কুলের কলিগদের বলেছিল সুমি, ছেলেপক্ষের দশ-বারো জন। ছেলেটা সত্যিই ভাল। সুমি এ বাড়িতেই থাকে। শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়নি ওকে। হর্ষ টিউশনি সেরে রাত্তিরে চলে আসে সুমির বাড়ি। বাজারটা করে, জলখাবার খেয়ে, ওর বাড়িতে চলে যায়। ওর টিউশনির কারখানা শুরু হয়। রাত্তির সাড়ে আটটা পর্যন্ত কারখানা চলে। তার পর সুমির বাড়ি। রাত্রে ওখানেই খায়, দিনের বেলা নিজের বাড়িতে। সুমি সুখী। এ জীবন মন্দ কী। রবিবার টিউশনি বন্ধ। কোনও রবিবার নাটক দেখতে যায়, কোনও রবিবার গঙ্গার ধারে এমনি এমনি। হর্ষ রান্নাবান্নাও জানে। কী

সুন্দর কড়াইশুঁটির কচুরির পুর করল একদিন। বেলতে পারে না অবশ্য, পোস্ত দিয়ে চিকেন করল। এমনকী শুক্তোও করল। বলল, বেকার লোক কিনা, মায়ের সঙ্গে থেকে থেকে শিখে গেছি। মা-কে রিলিফ দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে রান্নাটা করি তো।

এমন ছেলে হয় নাকি?

সকালে বাজারটা করে, বাজারের টাকাটা নেয় না।

ও বলে— চাকরি-বাকরি না করতে পারি, রোজগার তো করি। কাঁচা বাজারটুকুর জন্য টাকা দেবেন না।

ভালই বাজার করে। চিতল-ইলিশ-কই এ-সব দামি মাছটাছ আনে না ঠিকই। কিন্তু, বেশ তাজা, জ্যান্ত মাছ আনে।

সুমি সুখী ৷

একদিন খবর কাগজে বেরুল পাসপোর্ট জালিয়াতি চক্রে কয়েকজন ধরা পড়েছে। তার মধ্যে আছে খগেন বিশ্বাস ওরফে লাট্টু। পুলিশ সন্দেহ করছে এরা আরও বহু রকম জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত। লাটুর অফিস তল্লাশি

করে অনেক রবার স্ট্যাম্প, কালার জেরক্স মেশিন ইত্যাদি পেয়েছে। সুমি খবরটা পড়ল। কিন্তু, একবারও বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে মনে হল না। ওর ভিতর থেকে কেমন এক নিঃশব্দ আর্তনাদ বেরিয়ে এল। খবরটা কাউকে বলল না।

দুঃখ পাচ্ছে কেন? সুমি নিজেকেই প্রশ্ন করেছিল।

খবরটা চাপা থাকল না। সুবিমল গায়ত্রী সবাই জেনে গেল। হর্ষও। হর্ষ বলেই ফেলল— একটা বাজে লোককে বিয়ে করে ফেলেছিলে। বোঝনি।

কিছুদিন পর জামিনে ছাড়া পেয়েছিল লাট্টু, কিন্তু ততদিনে ওর সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করে দেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সুমিতাদের বাড়িতেও এসেছিল পুলিশ। সুমিতা বলেছিল, ও জানত লাট্টু অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করে।

ছাড়া পাওয়ার তিন দিন পরই লাট্টু খুন হয়ে গেল রাস্তায়। গুলিতে ঝাঁঝরা শরীর। টিভি চ্যানেল তোলপাড়। বলছে প্রমাণ লোপের জন্য ওই চক্রের থেকেই লাট্টুকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। টিভি দেখাচ্ছিল মৃত মুখ। ওই মুখে এক সময় কত চুম্বন চিহ্ন ছিল সুমিতার। সুমিতা দেখল, রক্তজমাট মুখটা। কতদিন পর। একবারই। তার পর টিভি খোলেনি কয়েক দিন। একদিন লাটুর মা এল বাড়িতে। বিধ্বস্ত। বলল সবই জানেন। আমাদের সব শেষ। এখানে আর থাকব না। বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব। আপনাদের বাচ্চাটাকে আপনারা নিয়ে নিন। আমাদের বাঁচান।

লাট্টু ধরা পড়ার পর সুমির ভিতর থেকে যে আর্তনাদটা উঠে এসেছিল, এখন তার মানে বুঝল সুমি। কারণ বুঝল। ভিতরের অন্তরাত্মা বলে উঠেছিল— আমার ছেলেটার এবার কী হবে?

কণাদ এখন এখানে। ওর বাবা নেই। অচেনা মা। সুমি চেষ্টা করছে নিজেকে চেনাতে। সুমি ওকে আদর করছে, পড়াচ্ছে, ঘুম পাড়াচ্ছে…। কিন্তু, ইতিমধ্যে সুমির পেটেও বাচ্চা এসেছে।

হর্ষ সুমির জন্য ফল নিয়ে আসে, হেল্থ ড্রিঙ্কস নিয়ে আসে ৷

আজ রবিবার। হর্ষ সকাল বেলা এক গ্লাস কমপ্লান করে টেবিলে রাখল। সুমির পাশে বসে আছে কণাদ।

সুমি ওটা হর্ষর দিকে ঠেলে দিল।

হর্ষ কণাদের দিকে খরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

সুমি সেই দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে কণাদকে বলল– সোনা এটা খেয়ে নাও।

কণাদ বলল– না, এটা তোমার।

– না, তোমারও নয়, আমার সন্তানের জন্য, যে এখন…।

এত কড়াভাবে কথা বলে না হর্ষ।

সুমি বলল, দু’গ্লাস আনলেই তো হত।

হর্ষ বলল— অন্যের বাচ্চার জন্য বানাতে পারব না। একটাই এনেছি, তোমাকেই খেতে হবে।

সুমিতা ও হর্ষ।

মাঝে একটা পানীয় পূর্ণ গেলাস।

সুমিতা ও হর্ষ।

মাঝে একটি তৃতীয় ব্যক্তির ঔরসজাত সন্তান। সুমিতা কি বীজক্ষেত্র মাত্র!              

Related Posts