jamdani

শুচিন্দ্রম: শাপগ্রস্ত ও বিপন্ন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ।।সমুদ্র বসু

সমুদ্র বসু

আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে বােঝায়। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকতা বিষ্ণু আর সংহারক মহেশ্বর- এই মিলেই ত্রিদেব। ভারতবর্ষে তাে তেত্রিশ কোটি দেবতার অনেক মন্দির আছে। কোনও মন্দিরের বাইরে বা গর্ভগৃহের সামনে দেখা যায় সুবিশাল নন্দীর মূর্তি, কোথাও দেখা যায় সুবিশাল হনুমান মূর্তি বা কোথাও দেখা যায় প্রণামরত গরুড় পাখির মূর্তি। আসলে এই বাহনগুলি মন্দিরের আরাধ্য দেবতা কে, তা বুঝিয়ে দেয়। নন্দীমূর্তি হলে শিব আর হনুমান বা গরুড়মূর্তি হলে বিষ্ণু বা রাম বা কৃষ্ণের মন্দির- এ কথা সহজেই বােঝা যায়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের একদম শেষ বিন্দু কন্যাকুমারী থেকে মাত্র ১৩ কিলােমিটার উত্তরে শুচিন্দ্রম মন্দিরে সুবিশাল নন্দীমূর্তি থেকে শুরু করে হনুমান ও গরুড় সবেরই সহাবস্থান। কেন এরকম হল? আসলে এই মন্দিরে একই সঙ্গে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর একই লিঙ্গে পূজিত হন। মন্দিরের স্থানীয় না ‘স্থানুমালায়ান’ মন্দির। স্থানু’ অর্থে ব্রহ্মা, ‘মাল’অর্থে বিষ্ণু আর ‘আয়ন’ অর্থে শিবকে বােঝানাে হয়। আজকের এই গল্প ভারতের এই ব্যাতিক্রমী মন্দিরের পুরাণকথা নিয়ে, যেখানে একই গর্ভগৃহে একই লিঙ্গে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের অধিষ্ঠান। ভারতবর্ষের অন্য কোথাও এই রূপ বিরল। 

এই গল্প বলতে গেলে প্রথমেই শুরু করতে হয় অত্রি মুনি ও তাঁর স্ত্রী অনসূয়ার কথা বলে। আমরা ছােটোবেলায় ভূগােলে পড়েছি যে বৈদিক সভ্যতার সাতটি ঋষির নামে আকাশে জ্বলজ্বল করে সপ্তর্ষিমণ্ডল। এই সাত ঋষি হলেন অত্রি, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ, বিশ্বামিত্র, গৌতম, জমদগ্নি ও ভরদ্বাজ। এঁদেরকে একত্রে সপ্তর্ষি বলা হয়। এই সপ্তর্ষির অন্যতম ঋষি অত্রি যাঁর, পতিব্রতা স্ত্রী অনসূয়া। আজকের শুচিন্দ্রম মন্দির যেখানে, পুরাকালে সেখানে ছিল গভীর অরণ্য। ভয়ঙ্কর জন্তু-জানােয়ারদের বাস ছিল সেখানে। কিন্তু সেই গভীর অরণ্যের মধ্যে একটি সুন্দর ফুল ফলে ঘেরা জায়গায় ছিল অত্রি মুনির আশ্রম। তিনি তাঁর স্ত্রী অনসূয়াকে নিয়ে থাকতেন সেখানে। অনসূয়া তাঁর স্বামী অত্রিকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করতেন। তিনি ছিলেন পঞ্চ সতীর একজন। এইভাবেই তাঁরা যখন শান্তির জীবন কাটাচ্ছিলেন তপােবনে, সেরকম এক সময়ে টানা অনাবৃষ্টি আনল অশান্তির ছায়া। যেখানে মাসে তিনবার অন্তত বৃষ্টি হওয়ার কথা, সেখানে একটানা অনাবৃষ্টি চিন্তিত করল অত্রিকে। তিনি বৃষ্টির প্রার্থনায় সূচনা করলেন এক যজ্ঞের এবং তপস্যা করলেন ব্রহ্মার। তপস্যায় সন্তুষ্ট ব্রহ্মা তাঁর সামনে আবির্ভূত হলে অত্রি তাঁকে অনাবৃষ্টির কারণ জিজ্ঞাসা করলে ব্রহ্মা কিছু উত্তর দিতে পারলেন না। তাই অত্রি এরপর শুরু করলেন বিষ্ণুর তপস্যা। বিষ্ণুও তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সামনে আবির্ভূত হলে অত্রি তাঁকে অনাবৃষ্টির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনিও কিছু উত্তর দিতে পারলেন না। অবশেষে শিবের তপস্যা শুরু করলেন অত্রি। কিন্তু এবারেও একই ফলাফল। মহেশ্বরও তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সামনে আবির্ভূত হওয়ার পর তাঁকে অনাবৃষ্টির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনিও কিছু উত্তর দিতে পারলেন না। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব- ত্রিদেব তখন অত্রির সামনে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে পরামর্শ দিলেন সুদূর হিমালয়ে গিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের তপস্যা করতে। 

অত্রি মুনি তখন তাঁর স্ত্রী অনসূয়ার কাছে বিদায় চাইলেন হিমালয়ে গিয়ে ইন্দ্রের তপস্যা করার জন্য। পতিব্রতা অনসূয়া এককথায় রাজি হলেন স্বামীকে ছাড়া ওই গহন বনে একা দিনযাপনের জন্য। স্ত্রীর এই কথায় অত্যন্ত খুশি হলেন অত্রি মুনি। অনসূয়া তখন তাঁর স্বামীর পা দুটি জল দিয়ে ধুয়ে সেই জল ভরে রাখলেন একটি কমণ্ডলুতে। অত্রি মুনি তখন তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। অনসূয়া জানালেন যে তাঁর স্বামীই তাঁর কাছে পরমারাধ্যা। আর তাই স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাঁর পা ধােয়া জলই হবে নিজের আশীর্বাদ ও রক্ষাকবচ। এরপর অত্রি গৃহত্যাগ করে রওনা দিলেন তপস্যার উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে একদিন আশ্রম কুটিরে আরও কয়েকজন মুনি-ঋষিদের নিয়ে হাজির হলেন নারদ মুনি। উদ্দেশ্য ছিল অনসূয়ার সতীত্বের ও ক্ষমতার পরীক্ষা নেওয়া। অনসূয়া তাঁদের আগমনের কারণ জানতে চাইলে নারদ উত্তর দেন যে গহন জঙ্গল পেরিয়ে এই অনাবৃষ্টির মধ্যে আসার ফলে তাঁরা সকলেই খুবই ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত। নারদ ভাবলেন, এতজনের খাবার-জল কী করে সংগ্রহ করবেন অনসূয়া। অথচ নারদকে অবাক করে দিয়ে অনসূয়া তাঁর রক্ষাকবচ অত্রির পা ধােয়া জল ছিটিয়ে বালি থেকে তৈরি করে ফেললেন নানা ধরনের সুখাদ্য। বিস্মিত হলেন নারদ ও অন্য মুনিরা। 

অনসূয়াকে আশীর্বাদ করে সেই জায়গা ত্যাগ করলেনারদ ও অন্য মুনিরা। এরপর তিনি পূর্বদিকে আরও তিন মাইল যাওয়ার পর একটি জায়গায় (বর্তমান নাম মারুঙ্গুর) লােহার কিছু কড়াইশুটি পেলেন। সেই লােহার কড়াইশুটি সংগ্রহ করে আবার স্বর্গলােকে ফিরে গেলেন দেবর্ষি নারদ। ফিরে গিয়েই নারদসুলভ কাজে মেতে উঠলেন তিনি। তিনি দেখা করলেন ত্রিদেবীর সঙ্গে, অর্থাৎ ব্রহ্মার স্ত্রী সরস্বতী, বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী এবং শিবের স্ত্রী পার্বতীর সঙ্গে। নারদ তাঁদের বললেন যে আপনারা কি কেউ এই লােহার কড়াইশুটিকে খাদ্যদ্রব্যে পরিণত করতে পারবেন? অত্যন্ত অবাক হয়ে তিন দেবীই জানালেন যে এ কাজ তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। নারদ তখন বললেন, আপনারা দেবী হয়েও এই কাজ করতে না পারলেও অত্রি মুনির স্ত্রী অনসূয়া তাঁর ক্ষমতায় এ কাজ করতে পারবেন। বিস্মিত হলেন তিন দেবী। যেমন ভাবা তেমন কাজ। নারদ সরাসরি আবার চলে এলেন অত্রি মুনির আশ্রমে। অনসূয়া তাঁর আগমনের কারণ জানতে চাইলে তিনি অনসূয়াকে ওই লােহার কড়াইশুটিগুলি দিয়ে সেগুলি আহারদ্রব্যে পরিণত করতে বলেন। অনসূয়া কিছুটা শঙ্কিত হয়ে তাঁর স্বামীকে স্মরণ করে আবার সাহায্য নিলেন কমণ্ডলুতে সুরক্ষিত স্বামীর পা ধােয়া জলের। সেই জল ছিটিয়ে লােহার কড়াইশুটিগুলিকে খাবার কড়াইশুটিতে পরিণত করলেন তিনি। নারদ আবার ফিরে গেলেন স্বর্গলােকে। 

এরপর নারদ মুনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের স্ত্রী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতীর কাছে গিয়ে অনসূয়ার ভূয়সী প্রশংসা করে বললেন, স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালে দেবী অনসূয়ার মতাে পতিব্রতা নারী আর কেউ নেই। মর্তমানবী অনসূয়ার এই প্রশংসা শুনে তিন দেবী ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লেন। শেষে কিনা এক মানবীর কাছে পরাভূত হতে হবে তাঁদের ! তিনজনই দেখতে চাইলেন কত শক্তি ধরে অনসূয়ার সঙ্কল্প। তখন তাঁরা নিজ নিজ স্বামীদের কাছে জেদ করতে লাগলেন অনসূয়ার সতীত্ব পরীক্ষা নিতে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বর তখন তিন দেবীকে অনেক বােঝালেন যে অনসূয়ার সতীত্বের পরীক্ষা নিতে গেলে অনৰ্থ হয়ে যাবেকিন্তু দেবীরা নিজ নিজ সঙ্কল্পে অনড় হয়ে রইলেনঅগত্যা অনসূয়ার সতীত্বের পরীক্ষা নিতে অত্রি মুনির আশ্রমে সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে এসে উপস্থিত হলেন ত্রিদেব।। 

তিন দেবতাই তখন ছদ্মদেশ ধারণ করেছেন। তাঁরা হয়েছেন তিন সন্ন্যাসী। পর্ণকুটিরে তাঁদের পদার্পণে অনসূয়া ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁদের সেবায়। তখন। ছদ্মবেশী ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর অনসূয়ার কাছে ভিক্ষারূপে ভােজন প্রার্থনা করলেন। কিন্তু এক অদ্ভুত শর্ত দিলেন তাঁরা। বললেন, আপনি যদি সর্বান্তকরণে সতী হন তবে নির্বস্ত্র হয়ে স্বহস্তে আমাদের ভােজন করান। অর্থাৎ ভিক্ষাদাতা যদি সম্পূর্ণ নগ্ন না হয়ে খাদ্য পরিবেশন করেন, তবে সেই খাদ্য তাঁরা গ্রহণ । করবেন না। শুনে অনসূয়া পড়লেন উভয় সঙ্কটে। একদিকে তিনি অতিথিদের সেবা থেকে বিরত থাকতে পারেন না, অন্যদিকে স্বামীর প্রতি বিশ্বাস, সততা স্থির রেখে পরপুরুষের সামনে নগ্ন হওয়াও অসম্ভব। দিব্য ক্ষমতার অধিকারী অনসূয়া উপলব্ধি করলেন যে এঁরা সাধারণ সন্ন্যাসী নন। ঐশী ক্ষমতাবলে তিনি জানতে পারলেন এঁরাই ত্রিদেব- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। এসেছেন তাঁর পরীক্ষা নিতে। বুদ্ধিমতী অনসূয়া নিয়ে এলেন স্বামীর পাদ-তীর্থম। যে জলে তিনি স্বামীর পদযুগল ধুয়ে দেন, কমণ্ডলুতে রাখা সেই জলের কিছুটা তিনি ছড়িয়ে দেন সন্ন্যাসীরূপী তিন দেবতার গায়ে। এরপরই হল আসল ম্যাজিক। সঙ্গে। সঙ্গে তাঁরা রূপান্তরিত হলেন তিন শিশুতে। দেখে অনসূয়ার মন ভরে গেল। তিনি তখনও মাতৃত্বের স্বাদ পাননি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে অনসূয়া তখন উপলব্ধি করলেন যে তাঁর স্তনে প্রবাহিত হচ্ছে অনাবিল দুগ্ধধারা। পরম স্নেহে ও বাৎসল্যে তিন শিশুকে তিনি স্তন্যপান করালেন। 

সকলের অগােচরে দেবর্ষি নারদ একদিন অত্রির আশ্রমে এসে দেখলেন ওই তিন শিশুকে মাতৃস্নেহে লালন পালন করছেন অসূয়া। নারদ সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে রওনা দিলেন অত্রি মুনির তপস্যাস্থলে। সেখানে গিয়ে নারদসুলভ ভঙ্গিমায় অত্রিকে বললেন যে আপনার স্ত্রী তাে তিনটি শিশুর লালনপালন করছেন দেখে এলাম। এ কথা শুনে বিস্মিত অত্রি মুনি তপস্যা ছেড়ে রওনা দিলেন নিজ পর্ণকুটিরের উদ্দেশে। ওই তিন শিশুকে দেখামাত্রই ক্রোধে উন্মত্ত অত্রি ভৎর্সনা করলেন তাঁর স্ত্রীকে। অনসূয়া তখন সমস্ত কথা জানালেন স্বামীকে। সব শুনে অত্রি বুঝলেন, পতিব্রতা স্ত্রী অনসূয়াকে অবিশ্বাস করা চরম অন্যায়। এদিকে স্বর্গে তিন দেবী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতী অপেক্ষায় বসে আছেন কখন ফিরে আসবেন তাঁদের স্বামীরা। নারদ এসে তাঁদের খবর দিলেন যে অনসূয়ার কাছে তাঁদের স্বামীরা অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর পরিণত হয়েছেন তিন শিশুতে। এ কথা শুনে স্বামীদের উদ্ধারে পড়িমরি করে মতে ছুটলেন তিন দেবী। পর্ণকুটিরে গিয়ে তাঁরা ক্ষমা চাইলেন অনসূয়ার কাছে। প্রার্থনা করলেন স্বামীদের ফিরিয়ে দেওয়ার। তখন তাঁদের কাছে সন্তান প্রার্থনা করলেন অনসূয়া এবং ত্রিদেব যাতে তাঁর সন্তান হয়ে জন্মায় সেই ইচ্ছা পােষণ করলেন তিনি। অনসূয়ার ইচ্ছায় আবার তিন শিশু পরিণত হলেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরে। তখন তিন দেবতার সম্মিলিত রূপ নিয়ে জন্ম হল এক শিশুর। এই শিশুর তিনটি মাথা ও ছয়টি হাত হল। এই সন্তানের নাম হল । দত্তাত্রেয়। যদিও দত্তাত্রেয় ত্রিমূর্তির সম্মিলিত রূপ, তবু তাঁকে বিষ্ণুর অবতার হিসাবেই গণ্য করা হয়। এভাবেই শুচিম হয়ে উঠল ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের সম্মিলিত ক্ষেত্র- কারণ এখানেই তাে তাঁদের চরম ফ্যাসাদে পড়তে হয় অনসূয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসে। 

এবারে দ্বিতীয় পুত্রলাভ কী করে হল, শােনা যাক সেই পর্ব। অত্রি-অসূয়ার সমকালীন বৈদিক সভ্যতার প্রতিষ্ঠান নগরে বাস করতেন এক ব্রাহ্মণ। তাঁর নাম কৌশিক। তিনি নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী সুমন্থি ছিলেন অত্যন্ত পতিব্রতা। তিনি কিন্তু পতিতালয়ে যাওয়া স্বামীর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। বিপ্র কৌশিকের কুষ্ঠরােগ হল। সেই অবস্থাতেও তিনি পতিতার কাছে যেতে উদ্যত হলেন। সতী স্ত্রী সুমন্থি তখন স্বামীকে পিঠে করে নিয়ে গেলেন পতিতালয়ে। যদিও কৌশিককে দেখে ঘেন্নায় দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল সেই বারাঙ্গনা। স্বামীকে পিঠে চাপিয়ে ফিরছিলেন সুমন্থি। তিনি খেয়াল করেননি পথে কাঁটাবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন ঋষি মাণ্ডব্য। এক নৃপতি তাঁকে ভুল করে শাস্তি দিয়েছিলেন। ভ্রান্তিবশত মাণ্ডব্যের গায়ে কৌশিকের পা লেগে যায়। কুপিত হয়ে অভিশাপ দিলেন ঋষি যে পরের সূর্যোদয়ে প্রাণ হারাবেন কৌশিক। শুনে বিহ্বল হয়ে পড়লেন সুমন্থি। তবে হার মানলেন না। তিনি উল্টে | চিৎকার করে বললেন, যদি আমি সতী স্ত্রী হই, তবে সূর্যদেবই যেন আর উদিত না হন। তাঁর অভিশাপ সত্যি হল। বন্ধ হল মর্তে সুযোর্দয়। উদ্ধারলাভে দেবতারা অনসূয়ার শরণাগত হলেন। অনসূয়া কথা দিলেন সুমন্থির স্বামী কৌশিক জীবিত থাকবেন। তখন সুমন্থির আদেশে আকাশে আবার উদিত হলেন সূর্যদেব। মুনির অভিশাপে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়াত হলেন কৌশিক, কিন্তু অনসূয়ার আশীর্বাদে আবার জীবন ফিরে পেলেন তিনি। এইভাবে অনসূয়ার ভূমিকায় সন্তুষ্ট হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা চন্দ্র অবতারে অনসূয়ার পুত্র হয়ে জন্ম নিলেন। এই চন্দ্রই হল অত্রি ও অনসূয়ার দ্বিতীয় পুত্র। 

এবারে আসা যাক অত্রি ও অনসূয়ার তৃতীয় পুত্র দুর্বাসার কথায়। দুর্বাসা মুনি প্রবল ক্রোধের জন্য পরিচিত। ঋষি দুবাসা শিবের অংশাবতার হিসাবে খ্যাত। দুবার্সা শব্দের অর্থ, যার সঙ্গে বাস করা যায় না। একবার ব্রহ্মা এবং শিবের মধ্যে কোনও এক কথাতে মনমালিন্য হয়। এই সংঘাতের ফলে শিব এত ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন যে, দেবতারা তাঁর ভয়ে পালাতে আরম্ভ করেন। এই সংবাদে শিবের পত্নী পার্বতী ক্ষুন্ন হন এবং মহাদেবের সঙ্গে বাস করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। এরপর ঋষি অত্রির পত্নী অনসূয়ার গর্ভে নিজের তপােগ্নি স্থাপন করেন মহাদেব। মহাদেবের এই তপােগ্নি থেকেই ঋষি দুর্বাসার (যার সঙ্গে বাস করা যায় না) জন্ম হয়। যেহেতু মহাদেবের ক্রোধের ফলে তাঁর জন্ম হয়েছিল, সেই জন্য ঋষি দুর্বাসা সামান্য কথাতে ক্ষুন্ন হয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতেন বলে জানা যায়। 

শুচিন্দ্রম মন্দিরের আরও একটি মিথ আছে। শুচি + ইন্দ্ৰম = শুচিন্দ্রম। অর্থাৎ এখানে দেবরাজ ইন্দ্র শুচিশুদ্ধ হন। শুনে নেওয়া যাক কী হয়েছিল তাঁর। ব্রহ্মার মানসকন্যা ছিলেন অহল্যা। অহল্যাকে বহুদিনের জন্য গৌতম মুনির কাছে রেখে যান ব্রহ্মা। সংযতচিত্ত গৌতম অতি যত্ন সহকারে তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ করে তাঁকে পবিত্র নিষ্কলঙ্ক রাখেনপ্রজাপতি ব্রহ্মা এতে সন্তুষ্ট হয়ে অহল্যাকে দান করেন গৌতমের কাছেগৌতম মুনির ধর্মপত্নী হলেন অহল্যাগৌতমের সঙ্গে অহল্যার বিয়েতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন দেবরাজ ইন্দ্র। কারণ, তিনি মনে করেছিলেন অহল্যার মতাে সুন্দরী নারী একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। একদিন গৌতম স্নান করবার জন্য আশ্রম থেকে অন্যত্র গেলে দেবরাজ ইন্দ্র গৌতমের রূপ ধারণ করে অহল্যার কাছে উপস্থিত হন এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গম প্রার্থনা করেনঅহল্যা দেবরাজকে চিনতে পেরেও সেই সময় কামার্ত ছিলেন বলে দুর্মতিবশে তাঁর দ্বারাই কামনা পরিতৃপ্ত করেন। ইন্দ্র সেই স্থান ত্যাগ করবার আগেই সেখানে উপস্থিত হন গৌতম। ইন্দ্রকে দেখে ক্রুদ্ধ গৌতম অভিশাপ দেন, ইন্দ্র নপুংসক হবেনসঙ্গে সঙ্গে খসে পড়ে ইন্দ্রের অণ্ডএরপর ইন্দ্র পিতৃদেবের কাছে নিজের দুর্দশার কথা জানালে তাঁরা মেষ উৎপাটন করে ইন্দ্রের দেহে যােগ করেনগৌতম এরপর অহল্যাকে অভিশাপ দেন, সহস্র বছর তােমাকে এখানে অদৃশ্য অবস্থায় বায়ুভুক হয়ে অনাহারে অনুতপ্ত হৃদয়ে জীবনযাপন করতে হবে। একদিন যখন রামচন্দ্র এই গভীর অরণ্যে আসবেন, তখন সেই অতিথি সৎকার করে তুমি পাপমুক্ত হবেগৌতমের কথা অবশ্য অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল তারপরএদিকে শাপগ্রস্ত ইন্দ্র বর্তমান শুচিন্দ্রম যেখানে সেই স্থানে গহন জঙ্গলের ভিতর বসে তপস্যা করেছিলেন ভগবান শিবেরসেই জঙ্গলের নাম ছিল জ্ঞানারণ্যএরপর শিবের বরে শুচিসিদ্ধ হয় দেবরাজের। সেই থেকে স্থানটির নাম শুচিন্দ্রম। 

অত্রি মুনিঅনসূয়ার পাদস্পর্শে পুণ্যভূমি শুচিন্দ্রম মন্দির। দ্রাবিড়ীয় শিল্পসম্ভারে ভরপুর গােপুরমটির উচ্চতা প্রায় ১৪০ ফুটএকটির উপর একটি, এইভাবে তিনটি কলস বসানাে মন্দিরচূড়ায়তার উপরে ত্রিশূলঅসংখ্য দেবদেবীর ভাস্কর্যে ভরা মন্দিরের সর্বাঙ্গচূড়ায় একদিকে সুশােভিত রামায়ণের নানা কাহিনীর মূর্তি আর অন্যদিকে মহাভারতেরষােড়শ শতাব্দীতে নির্মাণ হয় মন্দিরটিএকখণ্ড পাথর খােদাই করে বের করা সাতটি মিউজিক্যাল স্তম্ভ শুচিন্দ্রম মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণমন্দিরের ভিতরে অবস্থিত বীর হনুমানের ১৮ ফুট উঁচু মূর্তিটি বিশেষভাবে নজর কাড়ে। অত্রি মুনি বা অনসূয়ার গল্প সত্যি হােক বা না হােক, মন্দির নির্মাণে দ্রাবিড়ীয় শিল্পরুচি যে আজও অদ্বিতীয়, তা মন্দিরটি ভালােভাবে পরিদর্শন করলেই উপলব্ধি করা যায়। 

ছবি- গুগল

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes