jamdani

”তোমায় নতুন করে পাব বলে…”(পর্ব -২)

রূপক সাহা

কলকাতা থেকে খানিকটা পথ নৌকো সহযোগে এবং খানিকটা গরুর গাড়িতে করে নবীন ও সত্যচরণ খানাকুলে পৌঁছোল। বছর দশেক আগে এক রাতের জন্য নবীন খানাকুলে এসেছিল। তাও বৈদ্যবাটি থেকে পরিবারের সঙ্গে। গাঁয়ের নাম শাবলসিংহপুর। অনুকূলবাবুর বাড়িতে ঠিকমতো পৌঁছোতে পারবে কি না, তা নিয়ে নবীনের সংশয় ছিল। কিন্তু সে দেখল, সত্যচরণ ওই অঞ্চল হাতের তালুর মতো চেনে। কাছাকাছি কোনও গাঁয়ে নাকি তার আত্মীয়রা থাকেন, তাই যাতায়াত আছে। কথায় কথায় সত্যচরণ একবার বলেই ফেলল, মুণ্ডেশ্বরী নদীর জন্য বর্ষার সময় খানাকুল বানের জলে ডুবে যায়।

অনুকুলবাবুরা সম্ভবত আগেই খবর পেয়েছিলেন, জামাই বাবাজি আসছে। আপ্যায়নে তাই কোনও ত্রুটি রাখেননি। খেয়াঘাটে পালকি তৈরি। খেয়াঘাট থেকে যে লোকটি ওদের আনতে গেছিল, তার মুখে নবীন শুনল, খানাকুলে অনুকূলবাবুর এমন দাপট যে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়। এমনকী, আরামবাগের ইংরেজরাও আপস করে নিয়েছে। এদিকে উৎপাত করতে সাহস পায় না। কুসুমদের বাড়িতে পৌঁছেই নবীন বুঝতে পারল, বেশ বিত্তশালী পরিবার। প্রাসাদোপম বাড়ি, সংলগ্ন বাগানে ইতালিয়ান ভাস্কর্য। লোকজনে বাড়ি গমগম করছে। বয়স্ক মহিলারা এসে ওর সঙ্গে রঙ্গরসিকতাও করে গেলেন। আন্তরিকতার বহর দেখে নবীনের মনে অস্বস্তি শুরু হল। সত্যচরণকে সে ইঙ্গিত দিয়ে রাখল, রাত্রিবাসের কোনও প্রশ্ন নেই। যা বলার জন্য এসেছে, সেটা বলেই সে বেগুয়াবাজারে ফিরে যাবে।

সকালে জলখাবারের সময় কুসুমের মা এসে পাখার বাতাস করতে লাগলেন। যা কথাবার্তা, সত্যচরণের সঙ্গেই হচ্ছে। নবীনের গলা দিয়ে খাবার নামছে না। সে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে সত্যচরণের উদ্দেশে বলল, ‘আমাদের কিন্তু বেলাবেলি রওনা হতে হবে।’ শুনে কুসুমের মা আঁতকে উঠলেন, ‘সে কী বাছা! আজ যাওয়া হবে কী করে? কর্তামশাই আরামবাগ গেচেন গোরাদের নেমতন্ন করার জন্যি। কাল সাহেব-মেমরা সব আসবেন। গাঁয়ের নোকেরাও পাত পেড়ে খাবে। আমার একটাই মাত্তর মেয়ে। ঢাক-ঢোল না পিটিয়ে তাকে শউরবাড়ি পাঠাই কী করে? নোকে যে নিন্দে করবে!’

সত্যচরণ আমতা আমতা করে বলল, ‘না, মানে… আজ না গেলে কালেজে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।’ শুনে পাত্তাই দিল না কুসুমের মা, ‘না না বাছা তা হয় না। জোড়ে পাঠানোর আগে অনেক আচার-বিচার আচে। সে সব না হলে, মেয়ের অমঙ্গল হবে যে। কর্তামশাই এখুনি এসে পড়বেন। মনে হয় না, উনি তোমাদের আজ চলে যেতে দেবেন। তা ছাড়া, বৈদ্যবাটি থেকে পাইক-পেয়াদাদের পাটাচ্ছেন বেয়াইমশাই। তারাও এই এসে পড়ল বলে।’

 

কথাটা শুনে নবীন চমকে উঠল। বাবা তাহলে আঁটঘাট করেই আসরে নেমেছেন। পাইক পাঠানোর অন্য মানেও থাকতে পারে। সে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। কথাটা ভেবে নবীন মুষড়ে পড়ল। এমন সময় সত্যচরণ বলল, ‘ভাই নবীন, আমি যাই, আত্মীয়ের বাড়ি থেকে আমি একটু ঘুরে আসি। নদীর ওপারে চ্যাংড়া গাঁয়ে তাঁরা থাকেন। অনুকূলবাবুর সঙ্গে তুমি কিন্তু ভাই বুঝেসুঝে কথা বোলো। বুঝতেই তো পারছ, উনি ক্ষুন্ন হলে, এখান থেকে আমাদের ফিরে যাওয়া মুশকিল হবে।’

ফাঁকা ঘরে বিশ্রাম নেওয়ার সময় হঠাৎ সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকাটি চোখে পড়ল নবীনের। টেবলের ওপর পড়ে রয়েছে। এই অজ পাড়া-গাঁয়ে পত্রিকাটি দেখে সে খানিকটা অবাকই হল। প্রথম পাতায় মেডিকেল কলেজের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বেশ বড় করে ছাপা হয়েছে। জ্বালাময়ী ভাষায় গোরাদের বিরুদ্ধে বিষ উগড়ে দিয়েছেন সম্পাদক ভবানীবাবু। চোখে পড়ার মতো হেডিং। ‘হেয়ার সাহেব কি হিন্দু ধর্ম রসাতলে পাঠাইবেন?’ এরপর ছত্রে ছত্রে মাস্টারমশাই শ্রীমধুসূদন গুপ্তের নিন্দা, ‘হিন্দুধর্মে মৃতদেহ স্পর্শ করা পাপ বলিয়া বিবেচিত হয়। সনাতন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে কোথাও শবব্যবচ্ছেদের উল্লেখ নাই। তাহা সত্ত্বেও, একদল অকালকুষ্মাণ্ডকে শ্রীগুপ্ত সম্প্রতি শল্যবিদ্যা শিখাইয়াছেন। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হইয়া শ্রীগুপ্ত মহাশয় ধরাকে সরা জ্ঞান করিতেছেন। সমগ্র হিন্দুসমাজের পক্ষ হইতে আমরা ইহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি।’ মিথ্যে… ব্লাটান্ট লাই। মনে মনে বলল নবীন। ভবানীবাবুদের দাবি অনেকদিন আগেই নস্যাৎ করে দিয়েছেন মাস্টারমশাই। সাহেবদের উন্নত চিকিৎসাবিদ্যা জানার আগ্রহে তিনি ইতিমধ্যেই হুপার সাহেবের অ্যানাটমি গ্রন্থের সংস্কৃত অনুবাদ করেছেন। পুরনো পুথি ঘেঁটে তিনি এও আবিস্কার করেছেন, প্রাচীনকালে ভারতীয় চিকিৎসায় শবব্যবচ্ছেদ পদ্ধতির প্রচলন ছিল। মনুসংহিতায় তা লেখা আছে। তারপরই হেয়ার সাহেব দ্বিগুন উৎসাহে নেমে পড়েছেন শল্যবিদ্যার ক্লাসে হিন্দু ও মুসলিম ছাত্রদের টানতে। সমাচার চন্দ্রিকায় যে খবরটা নবীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল, সেটি হল, হিন্দু পণ্ডিতদের সঙ্গে ডিবেটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাতে তর্কযুদ্ধে নামবেন মাস্টারমশাই।

 

‘নবীন বাবাজীবন, কুশল তো?’

জলদগম্ভীর গলায় প্রশ্নটা শুনে নবীন ফিরে তাকাল। পরনে চুনোট করা ধুতি, গিলে করা বাহারি পাঞ্জাবি, হাতে ছড়ি। প্রায় ছ’ফুট লম্বা বয়স্ক মানুষটাকে দেখেই চিনতে পারল নবীন, ইনিই অনুকূলবাবু। উঠে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে সে প্রণাম করল। সোফায় বসে হাসিমুখে অনুকূলবাবু বললেন, ‘সমাচার চন্দ্রিকায় চোখ বোলানো হচ্ছিল বুঝি? হিন্দুসমাজের মাথারা এ কী অসভ্যতা শুরু করেছেন?’

এত দ্রুত নিজের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পাবে নবীন ভাবতেই পারেনি। প্রসঙ্গটা অনুকূলবাবু তুললেন দেখে সে বলল, ‘ওঁরা তো আমাকেও হুমকি দিচ্ছেন। বলছেন, গোমুত্র পান করে আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।’

‘সত্যচরণের মুখে আমি সব শুনেছি বাবাজীবন। সে আমার পিসতুতো দাদার ছেলে। তার মুখেই নিত্য তোমার খবর পাই। হেয়ার সাহেবের কাছে আমি একটা পত্র পাঠিয়েছি। তাতে লিখেছি, নবীন প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তোলার প্রয়াসে আপনি বিরত হবেন না। মেডিকেল কালেজ বিল্ডিং তোলার জন্য যদি অর্থের প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা আছি।’

বাঙালি সমাজের উন্মেষের জন্য ইংরেজি শিক্ষার কতটা দরকার, সে সম্পর্কে অনুকূলবাবু বলেই যাচ্ছেন। কান ভোঁ-ভোঁ করছে নবীনের। সত্যচরণ তাহলে কুসুমের আত্মীয়! এই কারণেই খানাকুলের এই অঞ্চল তার এত পরিচিত!

অনুকূলবাবু চলে যাওয়ার পর নবীন দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেল। হঠাতই সে দেখতে পেল, লাবণ্য ঘরে ঢুকছে। মুখে স্মিত হাসি, হাতে শরবতের গ্লাস। ‘লাবণ্য তুমি!’ বিস্ময় ছিটকে বেরোল নবীনের গলা থেকে। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে সত্যচরণ বলল, ‘আমাকে মাফ কোরো ভাই। সত্যি কথাটা অ্যাদ্দিন তোমার কাছে গোপন রাখতে হয়েছে বলে। হ্যাঁ, এই লাবণ্যই তোমার স্ত্রী কুসুম। কাকামশাই ওকে তোমার যোগ্য করে তোলার জন্যই আমাদের বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন। এখন যাচাই করে নাও ভাই, বোনটা তোমার মনোমতো হয়েছে কি না?’ কথাগুলো বলেই সত্যচরণ পর্দার আড়ালে চলে গেল। দ্বিরাগমন এমন মধুর হবে, নবীন তা ভাবতেও পারেনি।

…………………………………………………………………………………সমাপ্ত..…………………………………………………………………………..।

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes