১
নদীর মন ভালো নেই। ওদিকে শঙ্খ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হয়রান – সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাও, নাহলে কদিন বাপের বাড়ি ঘুরে এসো। মা’ও অনেকদিন ধরে বলছে, অন্ততঃ একবেলার জন্য আয়.. দুটো ভাত খাব একসঙ্গে…
ধ্যুৎ কিস্যু আর ভালো লাগে না। এত চারিদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার। ডিপ্রেসিং ওয়েদার, মন খারাপ করা লোকজন আর বোকা বোকা কথাবার্তা।
স্বপ্ন–র সঙ্গে প্রায়ই এ নিয়ে কথা নয়। ওর স্বভাবটা ভীষণ বিন্দাস, অনেকটা শঙ্খর মতো। অথচ কোথাও যেন একটা দুজনের স্বভাবের মধ্যে সূক্ষ্ম সরলরেখা, থুড়ি পার্টিশন। একজন বেশ উচ্চকিত অন্যজন অনেকটা ভীতু, টিমিড প্রকৃতির। একজন মাছ পছন্দ করে অন্যজন মাংস…
দূর দূর এটা কোন উদাহরণ হল? পার্কারের পেলব নিম্নাঙ্গে আলতো কামড় দিতে দিতে মোটামুটি স্বল্প প্রতিষ্ঠিত একজন গল্পকার ভাবতে থাকেন… এরপর কী.. তারপর নদী শঙ্খ আর স্বপ্নর সঙ্গে কী ত্রিকোণ প্রেমের একটা জ্যামিতি আঁকবেন নাকি, ওটা ভীষণই একটা ক্লিশে ব্যাপার স্যাপার!
রাজারহাটের এই অঞ্চলটায় বিশেষ লোকজনের আসা যাওয়া নেই। ঝাঁ চকচকে মাল্টিপ্লেক্স সংলগ্ন এই ওনারশিপ ফ্ল্যাটটা রাহুলেরা বুক করেছিল যখন, তখন দামটা বেশ সস্তা ছিল। এখন সেটা বছর পাঁচেক পরে বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়েছে। উফ্ জায়গার দাম এতটা আকাশ ছুঁয়েছে যে সাধারণ মানুষের পক্ষে…
ডোরবেলের টিং টং আওয়াজটা শুনেই মনে হোলো নিশ্চয় রাহুল এসেছে। ও সাধারণত পরপর তিনবার ঘন্টি বাজায়। ব্যস তাহলে হয়ে গেল। টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র আর পেন দেখলেই বাবুর মেজাজ একেবারে তিরিক্ষে হয়ে যাবে। ঠিক বলবেই, এই কথাটা।
–‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে যত্তো সব!’
পাশের ফ্ল্যাটের নন্দাদি এসেছে। সত্যি ভদ্রমহিলার কোনো কাজ নেই। আশেপাশের ফ্ল্যাটে কে এল, কে গেল সেই নিয়ে তীক্ষ্ণ নজর।
আচ্ছা, গল্পের মধ্যে যদি কোনো এক জায়গায় নন্দাদিকে বসানো যায়। তাহলে, নন্দাদি সম্পর্কে কে হবেন, নদীর আত্মীয়া, পড়শী না বন্ধু! কিম্বা স্বপ্ন, শঙ্খের সঙ্গে সম্পর্কিত কোন মোহময়ী!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নন্দাদির সঙ্গে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেলল গল্পকার। ‘চতুষ্কোণ সংবাদ’ থেকে বেশ মোটাসোটা সাম্মানিক দেয় গল্প লেখার জন্য। এ বিষম দায়! যেমন তেমন বিষয় নিয়ে এখানে লেখাটা বিশেষ সমীচীন নয়।
আসলে, নন্দাদির সঙ্গে যেচে কথা বলার উদ্দেশ্য ওঁর চরিত্র, লাইফস্টাইল বা যাপনপর্ব নিয়ে কিছু ধারণা করা – যেটা গল্পের প্রয়োজনে অত্যন্ত দরকারী। কিন্তু ভদ্রমহিলার কাছ থেকে সেভাবে কোন ইন্টারেস্টিং তথ্য পাওয়া গেল না। তা কী আর করা যাবে!
এবার, আবার এককাপ চা খেয়ে লেখায় বসতে হবে। আচ্ছা, স্বপ্ন, শঙ্খ নদী এরাও তো কিছু খাবে? কী খাবে তোমরা? চা এর সঙ্গে টা–ও?
মনে মনে প্রশ্ন করল গল্পকার। একজন বলল, চা। অন্যজন চুপ করে রইল। নদী রান্নাঘরে চা বানাতে গেল।
রাহুল এসেছে। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ও আজ এসে উপস্থিত। বিরক্ত লাগল গল্পকারের, উফ্ আবার সেই ন্যাকামি করতে হবে – কি গো চা খাবে তো? সঙ্গে আর কি কি দেবো বল। বিকেলে জলখাবার বেশি খেলে তো ডিনার ঠিকঠাক খেতেই পারবে না।
রাহুল অফিস থেকে ফিরে আসতে না আসতেই হৈ হৈ শুরু করে দিল। ওর নাকি পরের মাস থেকে ইনক্রিমেন্ট হবে। স্টাফ থেকে অফিসার হয়েছে আগেই, এখন থেকে বসের পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করবে। তাই কাজের সময়টাও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। একপক্ষে ভালই হয়েছে, ও আর বেশী এটা সেটা বলে জ্বালাতে পারবে না। লেখার ক্ষেত্রে বিশেষতঃ মনোযোগটা এত বেশি লাগে যে, কারোর উপস্থিতিটা বিশেষ সহ্য হয় না।
রান্নাঘরে বিস্তর কাজ। ঠিকে কাজের মেয়েটি একবেলা রান্না করে চলে যায়। মোটামুটি বিকেলের পর থেকে বেশ ফ্রি টাইম। যা ইচ্ছে কর, সেখানে খুশি যাও, যা মনে আসে বলো … কেউ তোমার ব্যক্তিগত কাজে বাধা দিতে আসবে না।
তিতলি দার্জিলিং–এ একটা হোস্টেলে থাকে। ক্লাস ফোর অব্দি মায়ের কাছেই ছিল, এ বছর একটা ভালো কনভেন্টে চান্স পেয়েছে।
রাহুল এখন ওয়াশরুমে গেছে। তারপর ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসবে। সামনে বসানো থাকবে ধূমায়িত চায়ের কাপ আর কিছু টুকটাক বিকেলের স্ন্যাক্স।
প্রতিদিনের মতো আজও ওর বিছানায় ছেড়ে রাখা অবিন্যস্ত ট্রাউজারের পকেট থেকে শুরু করে, ফুলস্লিভ ফরমাল শার্টে লিপস্টিকের দাগ আছে কিনা চেক করার পালা। বাকি আছে ওয়ালেট। সেখানে দু চারটে পাঁচশো দুশো একশো–র নোট ছাড়া আজ যোগ হয়েছে একটা চিরকূট, যেখানে খুদে হাতের লেখায় একটা ফোন নম্বর লেখা। ভাল করে পড়ার চেষ্টা করতে গেলেও পড়া যাচ্ছে না – কেমন যেন দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। চশমাটা সত্যি এবার পাল্টাতে হবে।
রাহুল বলে, সারাদিন বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে গুঁজে তুমি তোমার চোখের সঙ্গে নিজেকেও একদিন হারিয়ে ফেলবে।
তা যে যা বলে বলুক, কিছু সৃষ্টি করতে গেলে নিজেকেও তার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে বৈকি। এ টু জেড জানতে হবে, পড়তে হবে.. আরও আরও …
যাক্ বিস্তর তদন্ত করেও নিষিদ্ধ বা গোপনীয় কিছু তাহলে পাওয়া গেল না। আচ্ছা, রাহুল যে রোজ একটা ছোট্ট নোটবুকে কিসব টুকে রাখে.. তার মধ্যেও তো রহস্য থাকলেও থাকতে পারে! হবেও বা –
কিন্তু আজ আর এ মুহূর্তে এসব নিয়ে ভাববার মোটে সময় নেই। রাহুল এখনই স্নান করে বেরোবে।
২
টেবিলের ওপর যত্ন করে সাজানো আছে একটা ফ্লাস্ক, টি ব্যাগ আর সুগার কিউব। ঠিক তার পাশে এক গ্লাস জল, ঢাকা দেওয়া।
ফ্রিজের ভেতর থেকে কাজের মাসির তৈরী করা পকোড়াগুলো বের করে মাইক্রোওয়েভে ঢুকিয়ে দিল রাহুল। অন্যদিন হলে মিত্রা বলতো, যাও তো… আমাকে রান্নাঘরে বিরক্ত কোরোনা। কাজ করতে দাও। তারপর হাসিমুখে কী কী সব বানিয়ে যেন বরের মুখের সামনে ধরতো।
রান্নাটা ওর কাছে একটা প্যাশন। বিশেষ করে, টুকটাক জলখাবারের রেসিপিতে অগ্নিমিত্রা চৌধুরী একেবারেই সিদ্ধহস্ত। মা, ওঁর বৌমার হাতের রান্না খেতে বেশ ভালোবাসতেন। জীবনের শেষ দিন অবধি ও খুব সেবা করেছিল মায়ের। বাবা খুব অল্প বয়সে মারা যান, তাই ওঁকে চোখেই দেখেনি মিত্রা।
তিতলির কেমন লাগছে বোর্ডিং–এ কে জানে! ওর বাবার থেকে মা ছিল বেশি কাছের জন – স্কুল থেকে ফিরে এসেই মা মা বলে হাঁক পেড়ে কত গল্পগাছা করত।
নন্দাদি পড়শী হলেও বেশ তাঁর মধ্যে বেশ একটা মাতৃসুলভ হাবভাব আছে। আসলে অলোকদা মারা যাবার পরে ভদ্রমহিলা স্বামী হারিয়ে একা হয়ে গেছেন বাচ্চাকাচ্চা নেই তো! কে কখন পাশের ফ্ল্যাটে আসছে, যাচ্ছে .. সব খবর ওঁর নখদর্পনে। এতে মিত্রাদের অবশ্য কম সুবিধে হতো না। যখন তখন বেরিয়ে গেলেও তিতলিকে রেখে যেত নন্দাদির জিম্মায়। কিন্তু এখন আর তাঁর বিশেষ কোনো কাজ নেই মনে হয়! তিতলি বোর্ডিং–এ ভর্তি হবার পর থেকেই বেচারী মনমরা শূন্য চোখে রাহুলের দিকে আজকাল তাকিয়ে থাকেন। এমনকি মিত্রার দিকেও – কিন্তু সেসব এখন স্মৃতির পাতায়।
আচ্ছা, মিত্রা কী রাহুলের অসাক্ষাতে ব্রিফকেশ, ওয়ালেট কিংবা পার্সোনাল ল্যাপটপ চেক করত? নাহলে ল্যাপটপ থেকে কিছু কিছু ডকুমেন্ট কিভাবে মিসিং বা অলরেডি ডিলিটেড দেখাচ্ছে কেন?
পার্সে একটা চিরকূটে সৌমনার লেটেস্ট ফোন নাম্বারটা লেখা ছিল। সেটা কোথায় গেল?
ডক্টর মিত্র বলেছিলেন, মিসেস চৌধুরী স্লাইটলি সিজ্রোফেনিক। ওঁকে একটু সাবধানে হ্যান্ডেল করবেন। আসলে সন্দেহবাতিকতা ব্যাপারটা ওর জন্মগত। ওর মা শোনা যায়, এতটা সন্দেহপ্রবণ ছিলেন যে, ওর বাবা ফ্রাসস্ট্রেশনে সুইসাইড করেন। যদিও মিত্রা এসব ঘরের স্ক্যান্ডাল নিয়ে কথা বলাটা একদমই পছন্দ করত না। ওর শুধু একটাই পছন্দের বিষয় ছিল, তা হল লেখা। আর অবসরে মাঝে মাঝে রান্না করা।
পাতার পর পাতা.. লিখত.. লিখেই চলত, আর নিজের পয়সায় বই ছাপাত। কী যে পেত সে ও–ই জানে। শুধু মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করে কি করে জানি হাঁড়ির খবর বের করার চেষ্টায় থাকত তারপর সেটাই হয়ে যেতে গল্পের প্লট। এই যেমন নন্দাদির এত ব্যক্তিগত কথা ও জানতো যে, ওর স্বামীও বুঝি জানত না।
গল্প লেখা ব্যাপারটা আবার রাহুলের দুচক্ষের বিষ। মানুষের জীবন দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে কত কায়দাকানুন, সে আবার কিসব যেন হিজিবিজি কেতাদুরস্ত ভাষায়! দূর দূর যত্তো সব গারবেজ ব্যাপার স্যাপার, একেবারে পয়সার শ্রাদ্ধ। একগাদা গল্প জমে গেলে গুটিকতক বই ছাপিয়ে লোককে বিলিয়ে দেওয়া, এর মধ্যে গল্পকারের কী স্যাটিসফ্যাকশন থাকতে পারে, ঈশ্বর জানেন! এর নামই আসলে রাহুলের কথামতো, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।
মিত্রাকে অবশ্য এ ব্যাপারে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না, ও এতটা অন্তর্মুখী যে ওর পক্ষে এটা করা ছাড়া আর কিছুই করার উপায় নেই। যাহোক, একটা ব্যাপারে রাহুল একটু নিশ্চিন্ত ছিল যে, সস্তায় পাওয়া এই ধ্যারধেরে গোবিন্দপুরে এসে মিত্রার কোন কষ্ট হচ্ছিল না ও দিব্যি লেখাপত্তর নিয়ে নিজের মতো ফুরফুরে ছিল। কাউকেই ডিসটার্ব করত না, এমনকি করবেও না। কিন্তু হঠাৎ ওর যে কী হলো!
৩
একেকটা সম্পর্কের রঙ একেকরকম। নদী সেকথা জানতো তাই চোখ বুঁজলে শঙ্খকে একটা ধূসর অবয়বের মধ্যে কল্পনা করত। স্বপ্নের রঙ অবশ্য লাল কিছুটা ঔদ্ধত্য, কিছুটা ভোগের মিশ্রণ।
আচ্ছা নদী কোন রংটা পছন্দ করে ধূসর না, লাল? শঙ্খ না স্বপ্ন?
নাঃ কিছুই যেন আর মাথায় আসছে না। কলম স্থির। পেনের পেলব শরীরটা যেন একটু ভারী, বয়সের ভারে, নাকি গল্পকারের বত্রিশ পাটির অত্যাচারে! একটু পরেই শৌনক আসবে, মিত্রার ছেলেবেলার বন্ধু। দেখা যাক কী হয়।
এখন লাটাইয়ে সুতো গোটাবার পালা। সম্পাদক বলেছেন, আড়াই হাজার শব্দ .. না তার বেশী হলে তো দপ্তর থেকে ফোন আসবে – বিস্তর ঝামেলা। রাহুলও গল্পটা কোথাও ছাপা হল না বলে পিছনে লাগবে – নাহলে ওর মুখে তো সেই এক কথা ‘ঘরের খেয়ে’… অথচ মিত্রা এম. এ. পাশ। ও একটা চাকরী তো করতেই চেয়েছিল, কিন্তু রাহুল পছন্দ করে না বলে…
৪
মিত্রার লেখা শেষ গল্প এটাই। ইসসস… কিভাবে যে ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র ও ছড়িয়ে রাখত! সাধারণত সৃষ্টিশীল মানুষরা কিঞ্চিৎ আগোছালো স্বভাবের হয় ঠিক তেমনি ও। অথচ ওর রান্নাঘরটা আবার ততোধিক গোছানো। আশ্চর্য! একজনের মধ্যে যেন দুটো সত্তা কিরকম করে জানি পাশাপাশিভাবে বাস করত।
রাহুলকে হঠাৎ সেদিন মিত্রা ফোন করে বলল, শৌনক আমাদের বাড়ি আসবে তোমার অনুপস্থিতিতে… আপত্তি নেই তো?
–আরে, আমি আবার আপত্তি করব কেন, তোমার বন্ধু – তুমি তাকে যেভাবে ট্রিট করতে চাও করো আমার কী?
তাছাড়া সৌমনাও সেদিন রাহুলকে ডিনারে ডেকেছিল। বলেছিল,
–প্লিজ আজকের রাতটা আমি একেবারে একা, আমার কাছে থেকে যাও –
আচ্ছা এমন নরমসরম, সুন্দরী বুদ্ধিদীপ্ত মহিলাকে কী না করা যায়! ব্যস সারারাতটা রাহুল সেখানেই কাটালো।
৫
জানলার বাইরে থেকে যতদূর চোখ যায় – অন্ধকার আর অন্ধকার। ষোল তলার ওপর থেকে এখন শুধু দেখা আছে টিপটিপ জোনাকির মতো রাস্তার আলোগুলো। কটা বাজে তখন? মনে হয় দুটো না কি তিনটে … কে জানে!
আজকাল সময়টা যে কিভাবে কেটে যায়!
শৌনক একইভাবে বুককেসের ভেতরে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। কী সুন্দর দেখতে ওকে, মিত্রার বয়ঃসন্ধির ফ্যান্টাসী ছিল একসময়। কুমার গৌরবের মতো মিষ্টি চেহারা … টুকটুকে ঠোঁট –
সেই লোকটাই যে কোনদিন মিত্রাকে এভাবে দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেল করতে পারে – তা জানার অতীত ছিল।
ভালোমানুষের মতো মুখ করে ও মিত্রার সব কথা, রাহুলের পরকীয়ার কথা মিত্রার প্রতিশোধের চাল… ষড়যন্ত্র সব… সব… জেনেছিল, তারপর পুরোনো প্রেমিকের ভেক ধরে এসে সর্বস্ব লুটে নেবার অভিসন্ধি করেছিল মনে মনে। ভাগ্যিস মিত্রা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছিল আগে থেকেই।
স্বপ্নর স্বভাবটাও অনেকটা শৌনকের মতো। তুলনায় শঙ্খ অনেকটা স্মার্ট। কিন্তু তা বলে রাহুলের মতো বিশ্বাসঘাতক নয়! রাহুল কী আসলে শঙ্খ… আর স্বপ্ন কী শৌনক? কে জানে! চরিত্রদুটো আজকাল বেশ জ্বালাচ্ছিল মিত্রাকে, কেন জানিনা স্বস্তি পাচ্ছিল না সে ।
৬
ছি ছি ছি … মিত্রা যে এমন কাজ করতে পারে কেউ ভাবতেই পারেনি। শৌনক নামের ভদ্রলোকটির সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল, একথা আগেই বলেছে। কিন্তু এটা বলেনি, যে সে ওর কলেজের বয়ফ্রেন্ড ছিল। সৌমনার কাছে ও একদিন সবকিছু স্বীকার করে – রাহুল এভাবেই জানতে পারে ও স্ত্রীর আসল রূপ।
সৌমনা ছাড়া এখন পৃথিবীতে ওর আর আর কেউ নেই। পেশায় মনোচিকিৎসক। মিত্রাকে চিকিৎসা করত। শৌনক ওরও নাকি পরিচিত। ওরা পড়শী। লোকমুখে শোনা, লোকটা স্কাউন্ড্রেল, চরিত্রহীন আর অকৃতদার। বিস্তর দুর্নাম আছে – ছিঃ এমন একজনের সঙ্গে মিত্রার সম্পর্ক ছিল একথা ভাবতেও বুঝি কষ্ট হয়। রাহুল প্রায় যেত সৌমনার বাড়ি, থাকত। কিন্তু ছেলেটার সঙ্গে একদিনও দেখা হয়নি।
আর হবেও না কোনদিন। মিত্রা ওকে বাড়িতে ডেকে খুব বিচ্ছিরীভাবে মাংস কাটার ছুরি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে সেদিন.. তারপর নিজেও…
পুলিশ যখন মিত্রার বুককেসের ভেতরে দলা পাকানো ছিন্নবিচ্ছিন্ন ওই লাশটাকে টেনে বের করে আনল, তখন আতঙ্কে চিৎকার করে বলে, উঠেছিল রাহুল,
–হা ঈশ্বর, তুমি আমাকে রক্ষা করেছ, এমন ঠান্ডা মাথার খুনীর সঙ্গে আমি কিভাবে যে প্রায় একযুগ ধরে ঘর করলাম, অথচ একদিনের জন্যে কিচ্ছুটি বুঝতে পারিনি! সৌমনা অবশ্য আগেই এ ব্যাপারে আমার চোখ খুলিয়েছিল। তখন সেভাবে বুঝতে পারিনি। তবে এখন বুঝেছি মানসিক রোগগ্রস্ত লোক সত্যিই কতটা সাংঘাতিক আর পাশবিক হতে পারে!
৭
বেশ করেছি খুন করেছি। আমার বন্ধুত্ব আর ভালোমানুষীর সুযোগ নিয়ে শৌনক আমাকে ব্ল্যাকমেল করত। ওদের পেছনে লাগানো টিকটিকিটা খবর দিয়েছিল যে, রাহুল আর সৌমনার সঙ্গে সম্পর্কটা ক্রমশ গভীর হতে হতে আকাশ ছুঁয়েছিল। তাহলে আমি কী নিয়ে থাকতাম সারাজীবন! শঙ্খ নদী আর স্বপ্নকে নিয়ে! কিম্বা অন্য কোন চরিত্রযাপনের মধ্যে নিয়ে –
তিতলিকে রাহুল প্রায় জোর করে আমার অমতে বোর্ডিং–এ পাঠিয়েছিল। আর আমি? আরও একলা হয়ে গেলাম। কী নিয়ে থাকব, কী নিয়ে বাঁচব আমি। মন বলল, শৌনক তোর বন্ধু নয়, ও শত্রু। তাই ওকে একদিন বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে আমার বিষ মেশানো চিকেন কষা খাইয়ে অজ্ঞান করে মাংস কাটার ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করে ওর হাত, পা, মুখ আলাদা আলাদা করে… আহা এই লেখাটা পড়ে কিন্তু কারোর শিউরে ওঠার কিছু নেই, যদি ওগুলো আলাদা করে না কাটতাম তাহলে আমার বুককেসের মধ্যে ঢোকাতে পারতাম না যে!
কথাগুলো মিত্রা খুব যত্ন করে গুছিয়ে ওর ডায়েরীতে লিখে গেছিল। আরও অনেককিছু লেখা ছিল সেখানে … যেগুলো এখন প্রমাণ হিসেবে পুলিশের জিম্মায়।
৮
পুলিশ ইনন্সপেক্টর চক্রবর্তী এইমাত্র একটা মেল করলেন। যেখানে অগ্নিমিত্রার কেসটা নিয়ে ডিটেলে আরও অনেক কিছু লেখা আছে। ও নাকি আত্মহত্যা করার আগে ওর ডায়েরীতে একজায়গায় লিখেছিল যে, সৌমনাকে ও খুন করতে নাকি শৈানককে সুপারি দিয়েছিল।
ওহ্ মাই গড, ভাবা যায়! অগ্নিমিত্রার মতো একজন সাধারণ মাপের গৃহবধূ আসলে এতটা বীভৎস মানসিকতার ছিল!
রাহুল মনে মনে বলল, ভালোই হয়েছে তিতলিকে ওর কাছ থেকে আগেভাগেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
আজই ওর লেখা যত জঞ্জালগুলো পুড়িয়ে তবে আমার শান্তি।
৯
ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি। নদী সুইসাইড করেছে। শঙ্খ ওর বিয়ে করা বর হয়েও ও একদিনের জন্যও তাকে বোঝবার চেষ্টা করেনি।
স্বপ্ন চিরকাল দুঃস্বপ্নই রয়ে গেল। স্বপ্ন, নাকি চরম শত্রু সে।
চিকেন কষার শেষ কামড়টা দিতে দিতে গল্পের শেষটা এরকমই ভাবছিল মিত্রা। কিন্তু মুখটা ক্রমশ তেঁতো.. আরও তেঁতো হয়ে যেতে লাগল। বুককেসের পেছন থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে ক্রমশ মিত্রার গোলাপি নাইটি, অন্তর্বাস ভেদ করে ওকে গোগ্রাসে গিলে নিল এই নোনতা থকথকে বস্তুটা।
–হা ঈশ্বর মুক্তি দাও, মুক্তি দাও – শত্রুকে মেরেছি, এবার আমিও মরবো।
টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা স্তুপীকৃত কাগজ, পেন – আর কেতাদুরস্ত একগ্লাস ভর্তি জল… এই সব ঘটনার সাক্ষী ছিল। কিন্তু তারা কেউ মুখ খোলেনি এক মুহূর্তের জন্যেও। নন্দাদি বলেছিল, আসলে তারাও হয়ত প্রতিশোধ নিচ্ছিল রাহুলের ওপর।
আচ্ছা, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ কথাটা রাহুল কী মিত্রাকে না বললেই পারত না? ও যদি আরেকটু বোঝবার চেষ্টা করত স্ত্রীকে?
কিন্তু এ সবই অবশ্য নন্দাদির নিজস্ব মতামত। আপাতত রাহুল ওর স্ত্রীর শেষ শিরোনামহীন গল্পটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে। যাহ্ যত্তো সব জঞ্জাল… উড়ে যাক, পুড়ে যাক, মরুক গে যাক।
অগ্নিমিত্রা এখন বিদেহী। ও শত চেষ্টা করেও রাহুলকে বোঝাতে পারল না যে, ও পাগল নয়। ছবির ফ্রেমের মধ্যে আবদ্ধ শরীরটার একটা মাত্রই কাজ – তা হল দেখে যাওয়া দেখে যাওয়া শুধুই। সেলুলয়েডের চলমান দৃশ্যগুলো যেমন একের পর এক সরে যায় ঠিক তেমনিই। আসলে কারোর থাকা বা না থাকাতে পৃথিবীতে কিছুই এসে যায় না। আগে যা ছিল এখনও তা আছে, পরেও হয়ত তাই থাকবে, শুধু ফুৎকারে অদৃশ্য হয়ে যাবে মানুষ। এটাই ভবিতব্য।
১০
মৃতের ছবি ঘরেতে টাঙিয়ে রাখাটা শুভ নয়, কোন একজন বাস্তুবিদের কথামতো তাই তার ঠাঁই হল বাক্সবন্দী অবস্থায় গ্যারেজের এককোণে একটা গুদামঘরে।
দ্বিতীয় পক্ষ সৌমনাকে পাখিপড়ার মতো রাহুল বুঝিয়েছিল, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোটা’ একরকম মূর্খামি।
সৌমনা তাই বাধ্য মেয়ের মতো ওর বরের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। মা বলে দিয়েছেন, মেয়েদের জিদ ধরতে নেই – এর ফল পাগলামি, নয়ত মৃত্যু। ঠিক যেমন মিত্রার ক্ষেত্রে…
বিলাসবহুল ‘আশীর্বাদ’ আবাসনের টাওয়ার টু–এর ষোলোতলার বাসিন্দা মিসেস সৌমনা এখন সুদৃশ্য গ্রীলঘেরা জানলার ওপারে উড়তে থাকা মেঘগুলোকে দেখতে দেখতে ভাবে, মেয়েদের আরও কি কি করতে নেই – এ ব্যাপারে ডু অ্যান্ড ডোন্টস–এর একটা তালিকা পৃথিবীর দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখলে কেমন হয়!
এই আইডিয়াটা মাথায় আসতেই নিজের মনেই সে ফিকফিক করে হাসতে লাগল।
নন্দাদি এইতো সেদিনই রাহুলের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করছিল।
–সৌমনার হাসিটা কিরকম যেন পাগলের মতো। ও নিজের মনে কথা বলে, হাসে। মিত্রাও হাসত.. কিন্তু সৌমনা যেন কিরকম… আরোও অন্যরকম। সুস্থ মানুষ কোন কারণ ছাড়াই কিন্তু এভাবে হাসতে পারে না।
চোয়াল দুটো শক্ত করে রাহুল নন্দাদিকে সমর্থন জানাল।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...
আজও এই শহরের সরু অলি-গলি তাকে নস্ট্যালজিক করে তােলে। তাই...