ছােটোবেলায় একটা কবিতা পড়েছিলাম, প্রিয় মানুষ মারা যাবার কয়েক ঘন্টা পর তার শরীর আর ঘরে রাখা যায় না, কারণ দুর্গন্ধ বেরােয়। এইটুকু বলে সেই কবি, রণজিৎ দাশ প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাহলে প্রাণ কি মূলত এক সুগন্ধ, যা আমরা যতদিন বেঁচে থাকি, ততদিন আমাদের ভিতরে থাকে ?
সুগন্ধের অন্বেষণে মানুষ ঘুরে বেড়ায় জন্মাবধি। এক মালির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যে বৃদ্ধ বয়সে, অশক্ত শরীরে ফুল ফোটানাের কাজ করে যেত পাড়ার ক্লাবের একচিলতে জমিতে। কেউ তাকে এক পয়সাও পারিশ্রমিক দিত না সে কাজের জন্য। তবু দিনরাত্রি ফুল ফোটানাের কাজে ব্যস্ত থাকত সেই লােকটি। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেউ আপনাকে চাকরিও দেয়নি, কেউ আপনাকে বলেওনি, তবু কেন দিনরাত এই কাজ করে চলেন? সেই ভদ্রলােক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বহুদিন ধরে ফুলের গন্ধে বাস করেছি তাে, ফুলের গন্ধ ছাড়া বাঁচতে পারি না।’
আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এইরকম কিছু না কিছু গন্ধ রয়ে গেছে। বিকেলে কচুরি-শিঙাড়া কিংবা তেলেভাজা ভাজে যে লােকটি আর যারা তার হাতের শিল্পের গন্ধে গন্ধে হাজির হয়— দু’তরফের কাছেই এই শিঙাড়া, কচুরি বা তেলেভাজার গন্ধ ছাড়া বিকেল একেবারে নিরর্থক।
আবার সেই যে লােককথায় ছিল যে মেছুনির কথা, দুগ্ধফেননিভ সুগন্ধি বিছানায় শুতে দিলেও যার ঘুম আসে না যতক্ষণ না তার মাছের ঝুড়ি তার বিছানার কাছে এনে রাখা হয়। ওই মাছের গন্ধই যে তার জীয়নকাঠি। ওকে ছাড়া সে ঘুমােবে কী করে?
এক সংগীত শিল্পীর কথা পড়েছিলাম, যিনি নিজের হারমােনিয়ামে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তেন রেওয়াজের শেষে। অত শক্ত কিছু মাথার নীচে থাকলে ঘুম আসে কী করে, এই প্রশ্ন ছিল অনেকেরই! তার উত্তর ছিল খাসা। তিনি বলতেন যে ওই হারমােনিয়ামের ভেতর থেকে সুরের গন্ধ ভেসে আসে। সেই গন্ধের সামনে কোনও কিছুই শক্ত বা কঠিন থাকে না।
এইরকমই কত হাজার গল্প ছড়িয়ে আছে গন্ধের, যা আমাদের জীবনে টেনে নিয়ে যায়, ধারণ করে রাখে। মােবাইল আসার অনেক আগে পাড়ার বলটুদা নিজের একতলা ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াত, কারণ ঠিক তখনই ছাদে ভেজা কাপড় মেলতে আসবে রাখিদি। রাখিদির আসতে কোনও দিন । সাড়ে বারােটা, কোনওদিন একটা, আবার কোনওদিন দেড়টাও হত। কিন্তু বলটুদার ব্যাটে-বলে টাইমিং পারফেক্ট ছিল সব সময়। রাখিদি সিড়ি দিয়ে ছাদে পা রাখা মাত্রই দেখত বলটুদা দাঁড়িয়ে আছে নীচের রাস্তায়। কীভাবে টের পাও আমি কখন ছাদে উঠি?’ রাখিদি নাকি একবার পুজোর প্যান্ডেলে জিজ্ঞেস করেছিল বলটুদাকে।
-তােমার ভেজা চুলের গন্ধটা চিনি যে, ওটাই বলে দিয়ে যায় তুমি কখন ছাদে উঠছ। বলটুদা জবাব দিয়েছিল।
সেই জবাব অবশ্য ভাগ্য পালটাতে পারেনি, আধা বেকার বলটুদাকে রাস্তাতেই দাঁড় করিয়ে রেখে রাখিদি ইঞ্জিনিয়ারের গলায় মালা দিয়েছিল। ঠাকুরের হাতের লুচি-মাংস-পােলাও-এর গন্ধে ম-ম করেছিল পাড়া, কবজি ডুবিয়ে খেয়েও এসেছিল অনেকেই। শুধু আমাদের মতাে কেউ কেউ যারা যেতে পারেনি তারাই হয়তাে টের পেয়েছিল রেকর্ডারে বাজা সানাইয়ের শব্দ কেমন যেন ভিজে ভিজে, হয়তাে সেই সানাইয়ের সুরেই মিশে গিয়েছিল রাখিদির ভিজে চুল আর বলটুদার ভিজে চোখের গল্প।।
আবার অন্যরকম গন্ধের গল্পও কি নেই? আলবাত আছে। রবীনদা মারা যাবার তিন বছর পরেও তিতুদি রবীনদার ঘরটা সেই একইরকম অগােছালাে করে রাখত, আর যখনই সময় পেত সেই ঘরে ঢুকে বিছানার ওপর অগােছালাে হয়ে পড়ে থাকা রবীনদার শার্ট, প্যান্ট, সােয়েটার, পা-জামার গন্ধ নিত। মানুষ চলে যাবার এতদিন পড়েও কি মানুষের গন্ধ থাকে তার ব্যবহৃত জামা-কাপড়ে! তিতুদিকে সেই প্রশ্ন করে উত্তর পায়নি কেউ। শুধু কখনও-সখনও ওর বাচ্চা ছেলেটা টিউশন পড়তে গিয়ে ওর আন্টিকে বলে দিত, ‘রাত্রিবেলা আমায় ছেড়ে অন্য ঘরে গিয়ে শােয় মাঝে মাঝে, বাবার জামাকাপড়গুলাে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে। ওই পুরােনাে জামাকাপড় থেকে সত্যিই কোনও গন্ধ হয়তাে উঠে আসে না, তবু একটা জিনিস তাে নিশ্চিত যে তিতুদি বিচ্ছেদের গন্ধ সহ্য করতে পারেনি। তাই নিজের সবটুকু কল্পনা দিয়ে একটা প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিল।
গন্ধ কি শুধুই বিচ্ছেদের থাকে, মিলনের নয়? তাই কখনও হতে পারে? বাসর ঘরে পান কিংবা সিগারেটের ভেতরেও লেগে থাকে এক অন্যরকম আমেজ। বাইশ বছরে দুটো বাচ্চা নিয়ে বিধবা হয়ে মানুষের বাড়িতে বাসন মেজে, ঘর ঝাঁট দিয়ে যার জীবন চলত সেই কমলামাসি দত্তদের বাড়ির ছােটোছেলের ফুলশয্যার পরদিন নতুন বর-বউয়ের ঘর পরিস্কার করতে ঢুকে একেবারে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়েছিল পাঁচ মিনিট। কী হলটা কী! তুমি একেবারে পাথর হয়ে গেলে কেন?’ বাড়ির অন্য কাজের লােকের এই প্রশ্নের উত্তরে ফিক করে হেসে ফেলে কমলামাসি বলেছিল, ‘সােহাগের গন্ধ নিচ্ছি গাে!’ সােহাগের গন্ধ নিজের শরীরে পাবার ইচ্ছে কার না থাকে, কিন্তু সােহাগের গন্ধের প্রতি সবাই সমান সহনশীল নয়।
রামশরণ সাউয়ের ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতাই হয়েছিল একবার। দু’টি অল্পবয়সি ছেলে-মেয়ে নেমে গেছে, আমি উঠতে যাচ্ছি ট্যাক্সিতে, আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে রামশরণ একটা প্লাস্টিকের বােতল থেকে একটু জল ছিটিয়ে দিল পেছনের সিটে। তুমুল অবাক আমি। ট্যাক্সিতে উঠে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলাম, তখন নাম জানি না এই ড্রাইভারের। বলিয়ে মাত, লড়কা-লেড়কি যে কর রাহা থা অন্দর, পুরা ট্যাক্সি গন্দা কর দিয়া। ওই সােহাগের দৃশ্য সহ্য করে নিলেও সােহাগের গন্ধ সহ্য হয়নি রামশরণের, তাই গঙ্গাজল ছিটিয়ে পবিত্র করে নিচ্ছিল সে নিজের ট্যাক্সিকে। কিন্তু গঙ্গাজলের ছিটে পড়লেও ট্যাক্সির ভেতরে জেগে ছিল ছেলেটির ডিওডােরান্ট আর মেয়েটির পারফিউমের গন্ধ। উদ্ধত যৌবনের সুবাস কি অত সহজে মেটে?
তবে সােহাগের চেয়েও বড় নেশা বােধহয় সাফল্যে। আর সাফল্যের যে একটা আলাদা গন্ধ আছে কেই-ই বা না জানে! খেলার মাঠে গােল করার পর যখন একটা ঘেমাে জার্সিকে জড়িয়ে ধরে দশটা ঘেমাে জার্সি, তখন ওই ঘামের ভেতর দিয়ে সাফল্য ভাগ হয়ে যায়। একজনের অর্জন হয়ে দাঁড়ায় একটা দলের গৌরব। উলটো দিকে হেরাে টিমের প্লেয়াররা যে যার মতাে মাথা নীচু করে বসে থাকে বা শুয়ে পড়ে মাঠে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরতে দেখা যায় না তাদের। কী আর করা! সাফল্যের গন্ধের ভাগই সবাই চায়, ব্যর্থতার গন্ধের ভাগ কেউ নয়। সাফল্য আর ব্যর্থতা দিয়ে পৃথিবীতে যা যা মাপা যায় না, তার মধ্যে সবচেয়ে আগে আসবে মায়ের কোল। মায়ের কোলের গন্ধ বাচ্চা অনেক বড় হয়েও চেনে, কারণ সে যতই বড় হােক, মায়ের কাছে তাে সেই বাচ্চাই। সে গন্ধ এতই অবিনশ্বর যে মৃত্যুর পর সবকিছু পুড়ে গেলেও নাভি কখনও পােড়ে না। সেই নাভি ভাসিয়ে দেওয়ার মুহূর্তে সন্তান টের পায় যে প্রকৃতির গন্ধ আসলে মায়েরই গন্ধ। যে মাকে সে হারিয়েছে সেই মা-ই ছড়িয়ে আছে আকাশের মেঘে, বৃষ্টির সোঁদা গন্ধে।
বৃষ্টির দুপুরে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ কাকে না পাগল করে! তার সেই গন্ধ রান্নাঘর থেকে যখন ভেসে আসে বসার ঘর বা বারান্দায়, তখন ঘরে দু’টো মানুষ থাকলেও লাঞ্চ বা ডিনার হয়ে দাঁড়ায় ফিস্ট। কিন্তু ধরা যাক অনেক লােক ঘরে আর মুখে অন্যরকম কিছু গন্ধ নিয়ে ঢুকেছে কেউ, তখন বউয়ের থেকে কিংবা শাশুড়ির থেকে মুখের গন্ধ লুকোনােই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড়াে চ্যালেঞ্জ। পেটে থাক ভদকা বা হুইস্কি বা রাম, পা টলমল করুক সামান্য, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও গন্ধ যেন না বেরােয়। নাইন-টেনের ছেলেদের সমস্যা একটু অন্য হলেও অনেকটা এই রকমের। প্রথম সিগারেট খাবার পর তাদের পেয়ারা পাতা চিবিয়ে খেতে হয় বাড়িতে যেন গন্ধ না পায় কেউ।
আবার যেখানে সমস্ত গন্ধ বা দুর্গন্ধ অ্যালাউড, সেইরকম একটা খুপড়িতেও একজন কল গার্ল সন্ধেবেলা দুটো ধূপকাঠি জ্বালায় তার ঘরের ঠাকুরের ছবির সামনে। তার সেই দুঃসহ জীবনযাত্রার ভেতরে ওই সুগন্ধটুকুই তার প্রতিবাদ।
আমরা যারা লেখালেখি করি আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়াে সুগন্ধ কি? বলাই বাহুল্য নিজেদের নতুন ছাপা বইয়ের গন্ধ। লেখক হবার আগেও যখন শুধু পাঠক ছিলাম তখনও নতুন বইয়ের গন্ধ আমাকে পাগল করত। কত কত দিন নতুন টেক্সট বইয়ে মুখ ডুবিয়ে থেকেছি ভেতরে ভরে নেব বলে। আজও ওই গন্ধই আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ ‘বাকি কথা পরে হবে’ বের করার দায়িত্ব নিয়েছিল আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু শুভঙ্কর। কাগজ কেনা থেকে ডিটিপি, প্রেস থেকে বাঁধাই, সবটাই ওর হাতে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলাম আমি। সেই সময়টা শুভঙ্করের খুব টালমাটাল যাচ্ছিল, কারণ তখন তাঁর স্ত্রী মৌমিতা সন্তানসম্ভবা। শুভঙ্কর সে কথা একবারও বুঝতে না দিয়ে যতদূর সম্ভব নিখুঁতভাবে করে যাচ্ছিল আমার বইয়ের কাজ। দমদমের প্রেস থেকে বইটার প্রথম কপি আমার হাতে তুলে দেবে কথা দিয়েও এক শীতের সন্ধ্যায় আমার কাছে আসতে পারেনি শুভঙ্কর। রাতে ল্যান্ড লাইনে ফোন করে বলল, ‘মৌমিতাকে হঠাৎ করে ভরতি করতে হয়েছে, তাের বই আমার কাছেই আছে, তুই কাল সকালে হাসপাতালে চলে আসতে পারবি?’ পরদিন যখন আমি হাসপাতালে পৌঁছেই ততক্ষণে শুভঙ্কর আর মৌমিতার সন্তান পুপলু, আমাদের পৃথিবীর অংশ হয়ে গেছে। সদ্যোজাত সন্তানের সামনেই আমার হাতে আমার সদ্যোজাত কবিতার বই তুলে দেয় শুভঙ্কর। আর দু’দিক থেকে তাঁর সুগন্ধ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। ছাড়ে না আর।
প্রকাশিত-অদ্বিতীয়া ম্যাগাজিন
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
এদেশে সোনাকে স্থিতি এবং ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...