জিনাত ক্যানভাসে তুলির ফিনিসিং-টাচটা দিয়েই বাথরুমে ঢুকল। আলাদিনের সঙ্গে চ্যাটের পর আর ঘুম আসেনি। তাই ভােরবেলা থেকেই ক্যানভাসে হাত দিয়েছিল। একদিক থেকে ভালােই হয়েছে। ছবিটা শেষ করা গেছে। নাহলে আজও শেষ হত না। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে ভাবল, যেকোনাে জিনিসের নেগেটিভ দিক যেমন আছে, খুঁজলে তার পজিটিভ দিকও দেখতে পাওয়া যায়। গতকাল শায়নের ঝগড়া রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে ভােরবেলা থেকে কাজ করিয়ে ছবিটা কমপ্লিট করিয়ে নিল। জলের নীচে দাঁড়িয়ে মনের গুমোট ভাবটা কেটে গেল। বেশ ফুরফুরে লাগছে। হঠাৎ চোখ পড়ল আয়নায়। জলভেজা শরীরটা কী সুন্দর লাগছে! নিজেকেই যেন চিনতে পারছে না। আলিয়া ভাটের মতাে মনে হচ্ছে। ক্যানভাস এগজিবিশন গ্যালারির চক্করে নিজের দিকেই যেন তাকাতে ভুলে গিয়েছিল। স্নান করে ঝটপট রেডি হয়ে ট্যাক্সি নিল। ড্রাইভারকে বলল, “একাদেমী অফ ফাইন আর্টস চলাে”। বিকেলে আর্টিস্ট ফোরামের বিক্ষোভ আছে। আসাম সরকার চল্লিশ লক্ষের বেশি মানুষের নাম নাগরিক পঞ্জিতে তােলেনি। তারা নাকি অনুপ্রবেশকারী। প্রায় অর্ধেক শতাব্দী তারা এদেশে বাস করছে। কেউ সেনাবাহিনীতে কাজ করেছে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছে আজ হঠাৎ করে তারা নেই- রাজ্যের বাসিন্দা হয়ে গেল? তাদের পূর্বপুরুষের শরীরে লেগেছিল দেশভাগের যন্ত্রণা, শিকড় ছেড়ার কষ্ট। আজ নতুন করে আবার উচ্ছেদ করতে হবে? কাঁটাতারই সব? এ পৃথিবী মানুষের নয়? সরকারের মানবিক মুখ থাকবে না? সেদিন এইসব প্রশ্ন তুলে খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল অরিন্দমদা। আর্টিস্ট ফোরাম ডাক দিয়েছিল বিক্ষোভের।। ট্যাক্সি থেকে নামতেই মিতুল জিজ্ঞেস করল, দেরি করলি কেন? ফোনও রিসিভ করছিস না, বুঝতে পারছি না কখন আসবি, আদৌ আসবি কিনা! ‘ফোন করেছিলি! কই! “দ্যাখ।”
জিনাত দেখল, সত্যিই অনেকগুলাে মিসডকল। তার মধ্যে শায়নের পাঁচটা। ভােরবেলা কাজে বসার সময় সাইলেন্ট মােড করে দিয়েছিল, তারপর রিংটোনটা ঠিক করা হয়নি। কোনাে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ঘটার কথাও নয়। এটা প্রতীকী বিক্ষোভ। বিক্ষোভের পর সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। ঋদ্ধিমা সুজয় মিতুলের সঙ্গে চা নিয়ে বসল জিনাত। হঠাৎ দেখতে পেল শায়ন হাত নেড়ে পুষ্পলের সঙ্গে কথা বলছে। গতকালই পুস্পলকে স্ট্রিট- লাফাঙ্গা বলে গাল পাড়ল, আর আজকে তারই সঙ্গে দিব্যি গল্প করছে! অবাক হল জিনাত। শায়নের তাে অফিসে থাকার কথা। এখন এখানে কেন! আইটি সেক্টরে তাে দশটা পাঁচটার ডিউটি নয়। পুষ্পলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে। জিনাতের অভিমান হল। যেন দেখতেই পায়নি এমন মুখ করে চা খেতে থাকল। কিছুটা কাছে এসেই পুস্পল বাজখাই গলায় হাঁক দিল, জিনাত, গুরু আ গয়া। তুই কেটে পড়। শায়ন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। এই চেহারা দেখলে কে বলবে মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির আইটি ইঞ্জিনীয়ার! মুখটা এখন ভ্যাবলার মতাে। পুষ্পল বােধহয় কিছু একটা আন্দাজ করল। বলল, কী ব্যাপার রে? ফোল্ডারে ভাইরাস ঢুকে গেছে মনে হচ্ছে, ডাটা ওপেন হচ্ছে না! হেসে উঠল ঋদ্ধিমা, ‘পুষ্পল, তুই একটা জিনিস!’ শায়ন তড়িঘড়ি বলল, ‘ওর শরীর ঠিক নেই। ডাক্তারের অ্যাপাে আছে। তারপর জিনাতকে লক্ষ্য করে বলল, “চল, শিগ্নির। ডাক্তার বেরিয়ে গেলে প্রবলেম হয়ে যাবে। সবার সামনে একটা অপ্রস্তুতের হাসি হেসে উঠে দাঁড়াল জিনাত। অক্লেশে নির্জলা মিথ্যে চালিয়ে দিয়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করাল শায়ন। ট্যাক্সিতে উঠে শায়ন ড্রাইভারকে বলল, ‘অ্যাক্সিস মল। অ্যাক্সিস মলের বারে বসে শায়ন বলল, “কী খাবি? জিনাত খানিক স্বাভাবিক হল। বলল, ‘স্মার্টভ নে। ‘ওটা তাে প্রায়ই খাই। আজ একটা হুইস্কি ট্রাই করি। শায়ন বলল ওয়েটারকে ডেকে বলল, ‘শিভাসরিগ্যল দুটো করে। সঙ্গে আইস। জিনাত আগে কখনাে হুইস্কি খায়নি। কিন্তু খুব স্মুদ বলে অসুবিধে হল না। চোখ লালচে হয়ে উঠেছে। চিলি চিকেনের একটা টুকরাে মুখের ভিতর চালান করে শায়ন বলল, “কী রে ঠিক আছিস তাে? ‘হুম…’ শায়ন ওয়েটারকে রিপিট করতে বলল। তারপর জিনাতের দিকে ডানহাতে দুটো আঙুল বাড়িয়ে বলল, ‘একটা ধর। জিনাতের গলায় বিস্ময়, “কেন?” “আহ, ধর না। জিনাত শায়নের বাড়িয়ে দেওয়া দুটো আঙুলের একটা ধরল। সঙ্গে সঙ্গে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল শায়নের মুখ। তারপর বলল, “কবে করব? ডেট ফিক্স কর। জিনাত যেন আকাশ থেকে পড়ল, “কী করবি? কীসের ডেট? ‘বিয়ের। ‘তুই কি পাগল হয়ে গেলি? ‘তুই তাে এইমাত্র বললি!’ ‘আমি! কই, কখন? ‘ওই তাে একটা আঙুলে ছিল বিয়ে পরে করা যাবে। অন্যটায় ছিল দেরি করা ঠিক হবে না। জিনাত হেসে উঠল। বললম ‘পাগল একটা! ‘হাসছিস কেন! আয়াম সিরিয়াস। জিনাতের মুখটাও হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ‘আয়া, সিরিয়াস টু, শায়ন। বাট ইট উইল টেক টাইম…’ ‘হােয়াই! ‘সবে কাজ শুরু করেছি। পায়ের নীচে মাটিটা একটু শক্ত হােক। দেন…’ ‘আমার টাকা কি তাের নয়?
‘সে কথা নয়। টাকাপয়সাটাই সব নয় জানি, কিন্তু এটা জরুরি। প্রত্যেক মানুষের আত্মসম্মানের জন্য ইকনমিক স্টেবিলিটিটা ম্যাটার করে। ‘ধর, তেমন কোনাে স্টেবিলিটি তাের এল না, তখন? শায়নের কথায় হেসে উঠল জিনাত। তারপর ইয়ার্কি করে বলল, “তাহলে আর কী! মাঝেমধ্যে দুজনে এইরকম বেব, মালফাল খেয়ে বাড়ি চলে যাব। তাছাড়া তুই এমন ভাবছিসই বা কেন যে আমার ইকনমিক স্টেবিলিটি আসবে না? জিনাতের ইয়ার্কিতে সাড়া দিল না শায়ন। সে যথেষ্ট গম্ভীর। বলল, ‘হতে তাে পারে। ‘আমার স্বপ্ন আছে, শায়ন। আমি শুধু ইকনমিক্যালি দাঁড়াব না, কিছু ভালাে কাজ করব। ভালাে ছবি আঁকব। পৃথিবীর মানুষ আমার ক্যানভাসকে ভালােবাসবে। ‘সব স্বপ্ন কি সত্যি হয় ? ‘হয়তাে হয় না। হয় না বলে স্বপ্ন দেখতে তাে অসুবিধে নেই! স্বপ্ন ছাড়া বেঁচে থাকা আসলে মৃতের জীবন। যে মুহুর্তে মানুষের স্বপ্ন ফুরিয়ে যায় সেই মুহুর্তেই মানুষ মরে যায়। শরীর সচল থাকে, কিন্তু তা আসলে মৃতের নড়াচড়া। বেশ রাত হয়েছে। দুজনেই উঠে পড়ে। কারও মুখে কোনাে কথা নেই। যেন দুজন নদীর দুপারে। মাঝের সাঁকোটা আচমকাই ভেঙে গেছে! বার থেকে বেরিয়ে চলমান সিঁড়িতে পাশাপাশি দাঁড়ায়। সিঁড়ি নামতে থাকে নীচের দিকে।
চলবে…..
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
এদেশে সোনাকে স্থিতি এবং ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...