jamdani

উচ্চাশা (পর্ব – ২)

মন্দাক্রান্তা সেন

একটা চিটফান্ড গোষ্ঠীর হাতে মানুষের ভালো করার সুযোগ ছিল। কিন্তু তা হল না। জনগণের টাকা নিয়ে তারা লিফটে চেপে বসে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। আর যারা তাঁদের ব্যাঙের আধুলিটি দিয়ে দু’টি টাকার মুখ দেখবে ভেবেছিল, সংসারের কঠিন সিঁড়িটি বেয়ে এক-দু’ধাপ ওপরে পা রাখতে পারার স্বপ্ন দেখেছিল, তারা ওই সিঁড়ির মুখেই হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। এ সিঁড়ি ওপরে ওঠে না, শুধু নীচে নামে, নামতে থাকে।

মনে হয় অগ্রজ এক কবির কথা। তাঁর মতাদর্শের সঙ্গে আমার মতাদর্শের মিল ছিল। তবে আমি তাঁর সিঁড়ির প্রতি উৎসাহের কথা জানতাম। হঠাৎ দেখলাম, তাঁর মতাদর্শকে তিনি সিঁড়ির কোণে পানপরাগের থুতুর মতো ফেলে দিলেন, পা ফেললেন অন্য আর এক সিঁড়িতে। এ-বিষয়ে তিনি আদৌ তাঁর মতাদর্শকে ধরে বসে থাকার মতো অবার্চীন ‘ভুল’ করেননি। মনে হয় আদপে তাঁর কোনও মতাদর্শই ছিল না, ছিল কেবল ভণ্ডামি আর লোভ। একটি সিঁড়ির ছাদ অবধি পৌঁছে, তিনি নতুন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চেষ্টা করলেন। তাতে তিনি যতটুকু সফল হয়েছেন, তার থেকেও বেশি ধিক্কৃত হয়েছেন। আমাকে তিনি টেক্সট… করেছিলেন, তাতে বলেছিলেন,… জানি তোমাদের হতাশ করেছি, কিন্তু আমার কবিতা তো কোনও দোষ করেনি। কিন্তু ভেবে দেখেছি, তিনি করেছেন, বরাবর করে এসেছেন। তাঁর কবিতাগুলি বোধহয় ঠিক কবিতা নয়, ওগুলো এক একটা উচ্চাশার ধাপ। হয় এদিকে নয় ওদিকে। দেশের শাসকের দিক বদলের সঙ্গে সঙ্গে চিলেকোঠার হাওয়া- মোরগের মতো ঘুরতে থাকে তাঁর লেখা।

 

এখন কথা হচ্ছে, মানুষ ও তার আত্মাকে এ সিঁড়ি ঠিক কোথায় নিয়ে যায়? ওপরে, না নীচে! স্বর্গে, না পাতালে? রাবণ স্বর্গে যাওয়ার সিঁড়ি বানাতে চেয়েছিলেন। সফল হননি। সফল হওয়া যায় না। শুধু সচেতন মানুষের মাথার মধ্যে, হয়তো বাঁ অবচেতনেই, এই উচ্চাবচতা কাজ করে… তুমি মানুষ হিসেবে কোথায় পৌঁছতে চাও? পৌঁছনোর চেষ্টা করতে চাও? কী তোমার কাঙ্খিত গন্তব্য? কী তোমার নিয়তি? তুমি কি ঠিক জানো তা ওপরে, না নীচে?

সামান্য তত্ত্বকথা, যা আমার আয়ত্তে, তা তো হল। এবার একটু ব্যক্তিগত কথায় ফিরি। একটা গপ্পো। আমার জীবনসঙ্গী অরিনের সঙ্গে আমার প্রাথমিক আকর্ষণের শুরুতে সিঁড়ির একটা বড় ভূমিকা আছে। আমরা আমার লাইব্রেরিতে আড্ডা দিতাম। তখনও আমি সেভাবে ওর প্রেমে পড়িনি, পড়ব-পড়ব করছি। একদঙ্গল বন্ধুবান্ধবের চেয়ে ওকে আলাদা করে চিনছি। তাই দলবদ্ধতাকে এড়িয়ে মাঝেমাঝে আমরা দু’জনে একান্তে গল্পসল্প করতাম। সেদিন একটা ব্যাপার নিয়ে আমি ওর ওপর রেগে যাই। ওকে চলে যেতে বলি। রাগের থেকেও বেশি ছিল অভিমান ও অবুঝপনা। আমি লাইব্রেরির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছি। হঠাৎ মা দরজা ধাক্কাল… মিঠি (আমার ডাক নাম), এই মিঠি, দরজা খোল, অরিন পড়ে গেছে।

 

ব্যাপার হল, আমাদের একতলার সিঁড়ির বালব-টা কেটে গেছিল। একদম অন্ধকার। মা দোতলার সিঁড়ির ওপর থেকে বলতেও গেছিল যে নীচতলায় আলো নেই, সাবধানে নামিস। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ও সিঁড়ির ধাপ না বুঝতে পেরে পড়ে গেছে, আর উঠতে পারছে না। ওর সহ্যশক্তি অসীম, কিন্তু ওর মুখ থেকে একটা কাতরোক্তি বেরিয়েছিল, মা ওপর থেকে যেটা শুনতে পায়। পেয়ে নীচে নেমে দ্যখে ও বসে পড়েছে, উঠতে পারছে না। মা তখন আমার দরজা ধাক্কায়। ও সত্যি সত্যি আমায় একা রেখে চলে যাবে, এটা বোধহয় আমি ভাবিনি, একটা সর্বগ্রাসী বিষাদ আমাকে ঘিরে ধরেছিল। মা’র ডাক শুনি আমি তৎক্ষণাৎ লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে নীচে নেমে গেলাম। চোটের জায়গাটা তখনই বেশ ফুলে গেছে। বরফ ছোঁয়াতেই ও উহ করে উঠল। মা বল, কোনওরকমে ওপরে চল, এখানে অন্ধকারে তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

-না কাকিমা, ওপরে যাব না, একটা ট্যাক্সি নিয়ে হস্টেলে চলে যাব।

-মানে? এই পা নিয়ে তুই উঠতেই পারছিস না, আবার হস্টেলে ফিরবি কী করে? আর এই গলির মধ্যে ট্যাক্সি পাবি কোথায়? চল কোনও রকমে ওপরে চল, আমরা ধরছি।

ব্যাপার হল, সেরকম হলে আমিই একটা ট্যাক্সি ডেকে আনতে পারতাম। কিন্তু ইচ্ছে করল না। আমার রাগ তখন নিম্নমুখী, ও কারও সাহায্য না নিয়ে রেলিং ধরে এক পা’ইয় লাফাতে লাফাতে ওপরে উঠল। তারপর বিছানায়। পরের দিন এক্স-রে করে দেখা গেল, ডান পায়ের পাতার হাড়ে ভালোমতো চিড় ধরেছে। ওর মা- বাবা থাকেন মেদিনীপুরে, আর ও ওর চাকরির কারণে কলকাতায় হস্টেলে থাকে। সেখানে কে ওকে দেখবে? তাই ও আমাদের বাড়িতেই রয়ে গেল। আমার প্রেমে পড়া শুরু হল, শুরু হল আমার মা-বাবার ওর প্রতি প্রসন্নতা। আমার প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর, আমার আর বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না। আমি শুধু ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। মা-বাবা আমাকে সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করলেন। তাই আমি বলি, আমার বিয়েটা একই সাথে লাভ-ম্যারেজ ও অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ! যার ঘটক অথবা অনুঘটক হল ওই অন্ধকার সিড়ি!

সে সিঁড়ি বেয়ে আমরা ক্রমশ পরস্পরের হাতে হাত রেখে উঠছি, যার প্রতিটি ধাপে আছে পরস্পরকে, মানুষকে, আরও আরও আরও ভালবাসতে পারার, বিশ্বাস করতে পারার উচ্চাশা।

……………………………………………………………………..সমাপ্ত..………………………………………………………………………………………।

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes