jamdani

উচ্চাশা (পর্ব – ১)

মন্দাক্রান্তা সেন

 

একসময় বছর চারেক আমায় বাড়ি ছেড়ে বাইরে থাকতে হয়েছিল। বাড়ির কথা ভেবে আমার মনকেমন করত। আর সত্যি কথা বলি, আমাকে সবচাইতে বেশি করে বিষণ্ণ করত দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কোণটা। লাল টুকটুকে সিমেন্টের তৈরি সিঁড়ি। দোতলায় ওঠার ল্যান্ডিং-এর মাঝখানে বিরাট জানলা। সেখান দিয়ে বাইরের আলো পেতে মুখিয়ে থাকা পাতাবাহার। এক কোণে বিরাট বিষ্ণুপুরের মাটির ঘোড়া। অন্য কোণে মায়ের হাতের তৈরি ফুলদানিতে শ্বেত শিমুলের ফল। আমার ঘর নয়, লাইব্রেরি নয়, আমি সুন্দর একটা মনকে একা একা লালন করি ওই কোণে বসে।

করি বললাম বটে, কিন্তু কথাটা হবে করতাম। এখন আর বসার সময় পাই না। তবু ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ওঠা-নামার পথে ওই কোণ আমার দিকে তাকিয়ে কড়ুণ মধুর হাসে।

এই সিঁড়ি তো ওপরে যায়, নামব কোন সিঁড়ি বেয়ে? ছাদে পৌঁছে ফুলের টবগুলির সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা করা তো আক্ষরিক অর্থে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা… তারপর নীচে ঘরে নামব কীভাবে? হা-হা, এ এক চিরন্তন সমস্যা। অরণ্যের দিনরাত্রি-র অসীম বলে… যত উঠবে, তত নামবে…  যত উঠবে… তত নামবে। এ সিঁড়ি আমার লাল টুকটুকে আজন্মের আপন সিঁড়ি নয়, এ সিঁড়ি তবে কী!

প্রায় সবাই-ই সেই অন্য সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চায়।

 

আরও আরও আরও ওপরে। সেই ওপরটা ঠিক কেমন? আরও প্রাপ্তি, আরও সুযোগ, আরও আর্থিক উন্নতি, আরও খ্যাতি, আরও সম্মান। এর পেছনে কাজ করে উচ্চাশা। হ্যাঁ, তখন সিঁড়ির ওই সুন্দর ধাপগুলি এক-একটি উচ্চাকাঙ্খার ধাপ হয়ে যায় যা বেয়ে উঠতে উঠতে উচ্চাকাঙ্খী মানুষও একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যারা লিফটে চেপে ওঠে, আপাতভাবে তাদের কাছে হেরে যায়। কিন্তু, লিফট খারাপ হলে।

এই তবে সরে গেলাম আসল কথাটা থেকে। এসে গেল লিফট-এর আর ‘আপাতভাব’-এর প্রসঙ্গ। উচ্চাকাঙ্খী মানুষ যে ঠিক কী চায়, তা জেনে বা না জেনে, আমার কিন্তু মনে হয় লিফট-এর বদলে সিঁড়ি বেয়ে ওঠাই ঠিক। ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য। তারা বোঝে ওপরে ওঠা কতটা কঠিন। সিঁড়ি বেয়ে উঠলেও, তাদের পা-গুলি সাধারণত মাটিতে থাকে। ধীরুভাই অম্বানি যেমন উঠেছিলেন, উঠেছেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি।

 

লোকে বলে, আমিও নাকি লিফটে করে ওপরে উঠেছি। কথাটা অস্বীকার করব না। আমায় একতলা থেকে বহুতলে উঠিয়ে দিয়েছিল আনন্দবাজার গোষ্ঠী। তারপরে নানা কারণে তাদের সঙ্গে আমার মতবিরোধ ঘটে। সম্পর্ক ছিন্ন হয়। উচ্চাশার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার আকুলতা থাকলে তাদের সঙ্গে থাকার নিজের তথাকথিত ‘সুবর্ণ সুযোগ’ আমি হারাতাম না। আমার বন্ধুবান্ধবরা আমাকে মূর্খ অথবা পাগল ভেবেছিল, কিন্তু আমার সিঁড়ি আমাকে অন্য কোথায় যেন নিয়ে যায়… হয়তো আমার প্রকৃত ‘আমি’র দিকে। কোনও প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় না থেকেই আমার অস্তিত্ব আমি অটুট রেখেছি, কেননা আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। আসলে, উচ্চাশারও তো রকমফের আছে! আমার কাছে এ সিঁড়ি সুযোগ-প্রাপ্তিযোগ-অর্থ-খ্যাতি-র উচ্চাশার নয়, এ সিঁড়ির ধাপ আমার লেখার এক একটি পঙক্তি।

ব্যাপারটা চিরকালই ছিল, কিন্তু বর্তমানে চোখে পড়ে সিঁড়ির ব্যবহার খুব বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। লিফটের ব্যবহার এখানে কম। কারণ সিঁড়িই পদে পদে আকাঙ্ক্ষাকে উন্মোচন করছে। ওই সিঁড়ি বেয়ে কোনও ক্ষমতা-কেন্দ্রের কাছে পৌঁছনো ইদানীং বেশ প্রতিযোগিতার ব্যাপার। প্রতি ধাপে ধামা ধরতে হবে, লিফটে করে উঠলে যা সম্ভব নয়। এই সিঁড়ি বেয়ে উঠে অনেকে ক্ষমতা-কেন্দ্রের বেশ কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তারা নানারকম সুযোগ-সুবিধে পাচ্ছে। যেমন ঢালাও আর্থিক প্রাপ্তি, প্রায় অস্তিত্ববিহীন ‘কমিটি’র উচ্চপদ, নির্বাচনে জয়লাভ করে জনগণের প্রতিনিধিত্ব(!)… ইত্যাদি। এক্ষেত্রে সিঁড়ি বেশ সোজা, ধুরন্ধর লোভীরা জানে পরবর্তী পদক্ষেপ কীভাবে কোথায় রাখতে হবে! তবে এক্ষেত্রে বিপজ্জনক ব্যাপার হল, বেশ খানিকটা ওঠার পর যদি পা পিছলে যায়, তখন নিজেকে আর সামলাতে পারা যায় না, কেন-না তখন নীচের সিঁড়িটা কখন ধ্বসে পড়ে গেছে!

চলবে…

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes