আজ প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী অমলাশংকর-এর ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর ৯৪ তম জন্মদিনে ‘অদ্বিতীয়া’ ম্যাগাজিনের তরফ থেকে মৌমিতা তারণ মুখোমুখি হয়েছিলেন। শুনেছিলেন তাঁর থেকে নানা গল্প। আজ নৃত্যশিল্পীর জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ সেই সাক্ষাৎকার আবার ‘অদ্বিতীয়া’ ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত করা হল।
*******************************************************
চুরানব্বই বছরের মানুষটি আওড়ে যাচ্ছেন হেমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘কাঞ্চনমালা’, রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’। সামনে নেই কোনও খোলা বই বা খোলা খাতার পাতা। সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিটি শব্দ। ওঁর সামনে উপস্থিত আমি বাকশূন্য। এভাবে সেদিন শংকর পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটিকে পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এবার মুগ্ধ হওয়ার পালা আমার পাঠকদের।
আমার কৌতূহল মেটাতে অনেক প্রশ্ন সেদিন আমি তাঁর সামনে রেখেছিলাম। সেসবের জবাব তিনি দিয়েছিলেন খোলামনে। এই প্রবাদপ্রতিম মানুষটির বলে যাওয়া সেসব কথা আমি এখানে তুলে ধরছি আমাদের আলাপচারিতায় ঠিক যেভাবে উঠে এসেছিল সেভাবেই। টিপিক্যাল প্রশ্নোত্তরের আকারে নয়।
।। অমলিন অমলা ।।
মৌমিতা তারণ
গ্রামের ঘরে ঘরে হারিকেন জ্বলে উঠেছে। একটু আগেই সন্ধ্যে নামল। মা, কাকিমারা রান্নায় ব্যস্ত। সবকটি ঘরে জ্বালাবার মতো হারিকেন মেয়েটির বাড়িতে ছিল না। তাই কয়েকটি ছাড়া বাকি ঘরগুলো অন্ধকার। হঠাৎ বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। সাত বছরের মেয়ে অমলা বেজায় খুশি। বৃষ্টি মানেই ঘটনার ঘনঘটা। খড়ের ছাউনি থেকে জল পড়ছে — টপ টপ টপ। হারিকেনের আলো গিয়ে জাপটে ধরল সেই টপ টপ করে ঝরে পড়া জলকে। ও মা ! কী সুন্দর। ঝিকমিক করে উঠল ওরা। জলের ফোঁটা নয়, যেন হাজার তারার ঝিকমিকানি। মেয়ে তো অবাক ভরদুপুরের বৃষ্টিতেও এমন চমক থাকত। ফোঁটাগুলো আকাশ থেকে পড়েই উঠোনের জলে গোল গোল বাবলস হয়ে যাচ্ছে। কী করে এমন হয় মাথা কুটেও ভেবে পায় না ছোট মেয়েটি। আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে প্রকৃতির ভাষা বুঝতে অসুবিধে হয় না। যখন বৃষ্টি নামে, তাঁর চারপাশ যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রকৃতি তখন কত কথা বলে৷ পাখির ডাক শুনেই বুঝে যান কোন পাখি। প্রকৃতি যেন কথা বলে মেয়েটির কানে কানে। ফুলের ওই পাতলা পাঁপড়িগুলো কোন গুণী হাত অমন সুন্দর করে এঁকে দিল ! সুন্দর গন্ধই বা মাখালো কে ওদের শরীরে ! ভগবানের সৃষ্টি খেই পেতে দেয় না।
জীবন শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের ছোট একটি গ্রাম বাটাজোরে। সারা পৃথিবীর গন্ধ যেন উপচে পড়ে বাটাজোরের বাড়িতে। চোখের সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে নদী নবগঙ্গা। সব যেন জীবন্ত। নলিনী, ষোড়শীদের সঙ্গে হুটোপুটি দিনভর। আজ নব্বই পেরিয়ে এসে কোন অতৃপ্তি নেই মনে। ‘এ লাইফ অফ ডিভাইন ফুলফিলমেন্ট’ –নিজের জীবনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেন তিনি। জীবনে সবকিছু পেয়েছেন মনে করেন। ধনী পরিবারে জন্মাননি। মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা। সেই পারিবারিক ভ্যালুজ শরীরের প্রতিটি রোমে আজও বহমান। বলে কয়ে এই মূল্যবোধ কেউ শেখায়নি। চলতে, ফিরতে, হাসতে, খেলতেই শিখে ফেলা। তখন বোঝেননি গোটা জীবনকে মূল্যবান করতে গেলে এই সব মুল্যবোধ পাওয়াটা কত জরুরি। না জেনেই এই মেয়ে পেয়েছিল সেই ভ্যালুয়েবল ভ্যালুজ।
এ মেয়ের জীবনে বাবার ভূমিকা অপরিসীম। বৃষ্টি পরলেই বাবা বলতেন, ‘স্কুলে যেতে হবে না’। কী মজা তখন সব ভাইবোনের। এদিকে বাড়িতে তিন – চার মাসের চাল এসেছে। সেই চাল ভেতর বারান্দার মেঝেতে ছড়িয়ে দিয়ে বাবা বলতেন, ‘ভারতবর্ষের মানচিত্র বানাও’। হই হই করে ভাইবোনেরা লেগে যেত সে কাজে। কেউ বানাচ্ছে বিন্ধ্য পর্বত, কেউ হিমালয়। কেউ গঙ্গা নদী, কেউ বা মরুভূমি। বড়বেলায় এসে মেয়ে বুঝেছিল, ওটি আসলে বৃষ্টি দিনের খেলা ছিল না। ওটি ছিল খেলাচ্ছলে ভারতবর্ষের মানচিত্র শেখানোর একটি কৌশল। বাবার কথা বলতে গিয়ে অনেকদূর এভাবে চলে যান তিনি। বিলেত থেকে ব্যবসা করে ফিরলেন বাবা। ব্রাহ্মণরা নিদান দিলেন প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এরপর বাংলাদেশে স্কুল খোলেন বাবা। সাতটি গ্রামের লোকদের নেমন্তন্ন করে প্রায় পাঁচশো মানুষকে খাওয়ালেন। তবে সেই ভোজে কোনও ব্রাহ্মণকে নেমন্তন্ন করেননি তিনি। বাবার কথা বলতে গিয়ে সারা মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মেয়ের। বাবাই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কলকাতার সাহেব পাড়ায় জুয়েলারির দোকান খোলেন। না, ব্যবসা করা উদ্দেশ্য ছিল না। মানুষটি বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে সোনার দাম বাড়বে। সে সময় মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না। তাই মেয়েদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতেই জুয়েলারি ব্যবসার সূত্রপাত। বাবা ছিলেন ঋষি অরবিন্দর ভক্ত। অরবিন্দ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে এক অসাধারণ সুন্দর ভাষার অধিকারী ছিলেন তিনি। বিলিতি জিনিস ব্যবহারের কোনও প্রশ্নই ছিল না। কাঁচের চুড়ি ভাঙতেন বাবা। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত খদ্দর ছাড়া অন্য কিছু পরা বারণ ছিল। একবার এক বন্ধুকে বিলিতি শাড়িতে সাজতে দেখে আমাদের মেয়ের ইচ্ছে হয়েছিল অমন পোশাক পরার। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। একটু পরেই বুঝেছিলেন খদ্দরই তাঁর উপযুক্ত পোশাক। দেশ এখন স্বাধীন। পুরোপুরি খদ্দর হয়তো এখন পরেন না। তবে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন তসর ছাড়া আর কিছু পরার কথা ভাবেন না।
নিজের সাজসজ্জা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি কখনও। তবে স্বামীর নাচের পোশাক নিজের হাতে বানাতেন। ওদিকে স্বামীটি আবার নিজের হাতে বানাতেন স্ত্রীর নাচের পোশাক। গয়নাগাটি কোনওদিনই পরেন না। নাচের সময় নিজের মেকআপ নিজেই করতেন। কীই বা এমন মেকআপ ছিল। শুধু চোখের শেষাংশ মাথা পর্যন্ত টেনে দিতেন ওই চোখের কাজল দিয়েই। ছেলে আনন্দ বড় হওয়ার পর প্রথম লিপস্টিক লাগান। তবে হ্যাঁ যাবতীয় অহংকার ছিল মাথার একঢাল চুলে। জানালেন, “আমি যখন মাথা নাড়াতাম ময়ূরের পেখমের মতো আমার একরাশ লম্বা কালো চুল দুলে যেত।”
ভগবানে বিশ্বাসী এই মেয়ে কখনও গোমড়া মুখে থাকতে জানেন না। সদা হাস্যময়ী। অভিমান বা মন খারাপ করেন না। মাঝে মধ্যে সামান্য রেগে গেলেও ঠান্ডা হতে বেশিক্ষণ লাগে না। ১৯৬৫ সালে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় তৈরি হয়েছিল ‘উদয়শংকর সেন্টার ফর ডান্স’। আজও তা চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন শতবছর থেকে সামান্য দূরে থাকা এই নারী। কথা বলতে গিয়ে বারে বারেই ফিরে যাচ্ছিলেন ‘কল্পনা’ সিনেমার প্রসঙ্গে। বর্তমান সামাজিক সমস্যাগুলোর কথা সেই কবেই ‘কল্পনা’তে বলা হয়েছিল।
রোমা রঁল্যা, নেহরু, রবীন্দ্রনাথ — এই প্রণম্য মানুষগুলো এখনও মনের দরজায় উঁকি মারেন মাঝে মাঝে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত ভাবনাজুড়ে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি অপেক্ষা ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এই প্রজন্ম বেশি কৌতূহলী, এমনটাই তাঁর ধারণা। ভালো লাগে না এরকমটি। জওহরলাল নেহরু বললেন, রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য করতে হবে। উদয়শংকর প্রথমে রাজি ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৈরি হল ‘সামান্য ক্ষতি’। আডডা দিতে দিতেই ‘সামান্য ক্ষতি’র কোরিওগ্রাফির আইডিয়া পাওয়া গেল। তুড়ি মেরে উঠলেন উদয়শংকর। তিনি ‘তুড়ি’ মারা মানে সেটিই হবে। রবু মানে ভাই রবিশংকরও প্রস্তুত থাকতেন। ঝটপট এসে সুর দিয়ে দিতেন। কত কোরিওগ্রাফি যে এরকম তুড়ি মেরে সৃষ্টি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। একবার ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গেছেন। হোটেলে যখন পৌঁছলেন অনেক রাত তখন। ডিনার পাওয়া গেল না। কর্তা এসে বললেন, ‘ডিনার নাথিং’।কথাটি বলার মধ্যে একটি সুর ছিল। গিন্নীও বলে উঠলেন, ‘ডিনার নাথিং’। এভাবে সুর করে ‘ডিনার নাথিং, ডিনার নাথিং’ বলতে বলতে কখন যেন কর্তা – গিন্নী নেচে উঠলেন ‘ধিনাক না – তিন, ধিনাক না – তিন….।’ তখন আর কর্তা গিন্নী নন। তখন তাঁরা বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শংকর এবং অমলাশংকর।
সেই ধিনাক না -তিন আজও অমলাশংকরের সবকিছু জড়িয়ে রয়েছে। কচি কচি পাগুলো যখন নেচে ওঠে তিনি ফিরে যান নিজের ধিনাক না -তিন এর কাছে। পৃথিবীর বহু দেশে গেলেও তিনি গর্বিত থাকেন এই ভারতের মাটিতে। হেমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীরর ‘কাঞ্চনমালা’, রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ এই বয়সে এসেও আওড়ে যান অবলীলায়। সামনে থাকে না কোনও খোলা বই বা খাতার পাতা। সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে উচ্চারিত হয় প্রতিটি শব্দ। এমন অভিজ্ঞতায় সেদিন আমি বাকশূন্য ছিলাম। বললেন, “চোদ্দ বছর বয়সে আমি তিন হাজার সাহিত্য পড়ে ফেলেছিলাম। যে কোনও বই পড়ায় আমাদের কোনও বাধা ছিল না। বিদ্যাসুন্দর – এর মতো লাভ মেকিং বই বাবাই পড়তে দিয়েছিলেন।”
ঘুরে ফিরে আবার সেই বাবার কথাই চলে এল। আসলে একটি গাছ তখনই ফুলে, ফলে ভরে ওঠে যখন তার বীজটি থাকে নির্ভেজাল। বছর চারেক আগে আমায় দেওয়া এই সাক্ষাৎকারের শেষে মানুষটি একটি কথা বলেছিলেন, ‘জীবনে মূল্যবোধকে মূল্য দিও।’
এরপরেও আমার প্রিয় মানুষ, প্রিয় শিল্পী অমলাশংকরের সান্নিধ্যে এসেছি বেশ কয়েকবার। কখনও তাঁর বাড়িতে, কখনও নাচের স্কুলে, কখনও বা নাচের মঞ্চে বা গ্রীনরুমে। প্রতিবারই নজরে পড়েছে তাঁর এক স্নিগ্ধ রূপ। বুঝতে অসুবিধে হয়নি এর পেছনে রয়েছে সেই নির্ভেজাল মূল্যবোধ। একবার চেয়েছিলেন তাঁর অনেক না বলা কথা তাঁর মুখে শুনে আমি লিখি। কিন্তু সময়াভাবে সে কাজ আমি করতে পারিনি। আক্ষেপ তো সেজন্য রয়েই গেছে।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
এদেশে সোনাকে স্থিতি এবং ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...