jamdani

হংসমিথুন

ইন্দিরা দাশ

পুলিনবাবু একটু হকচকিয়ে গেলেন। বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করে চলেছেন তিনি এই মাসের টেলিফোনের বিলটা অনলাইন পেমেন্ট করার জন্য, কিন্তু এই কম্পিউটার নামক পাজি জিনিসটাতে এত রকম কারিকুরি করতে হয় যে তিনি ক্রমশ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলেন। পর পর তিন খেপে চা খাওয়ার জন্য গিন্নির থেকে কিছু গঞ্জনাও শুনতে হল। অথচ রূপম বাইরে থেকে ফিরে, কম্পিউটার নিয়ে বাবার ব্যস্ততার কারণটা জেনে নিয়েই কী যে দু-চারবার কালাে কালাে বােতামগুলাে টিপল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সাদা পর্দা জানান দিল যে নির্ধারিত মূল্যের। বিজলি বিল জমা পড়ে গিয়েছে। টিং টং করে সামনে রাখা মুঠোফোনও সে বার্তা জানিয়ে দিল।

ইদানীং পুলিনবাবুর নিজেকে কিছুটা সেকেলে মনে হয়। মনে হওয়ার কারণও তাে রয়েছে বিস্তর। সরকারি চাকরির আদ্যিকালের অফিসে কোথায় এতশত যন্ত্রপাতি ছিল! এই মােবাইল যন্ত্রটিই তাে উনি এই কিছুদিন আগে কিনেছেন স্ত্রী-পুত্র আর অল্পবয়সী সহকর্মীদের পীড়াপীড়িতে। বেশ ছিল ডিপার্টমেন্টের এক ধারে একখানা কালেকুলাে গাবদা টেলিফোন। কিড়িং কিড়িং শব্দে সেটা পিয়ন আবদুল্লার ঘুমটুম ভাঙিয়ে দিত। অফিসের কার ফোন কল এসেছে, হাঁক ছেড়ে জানিয়ে দিত আবদুল্লা, মােটামুটি বােধহয় আশপাশের বিল্ডিংয়ের অধিবাসীদের কান অবধি পৌঁছে যেত সে খবর। ফাইলের পেছন থেকে সেনবাবু উঠে দাঁড়াতেন টাক চুলকোতে চুলকোতে, অথবা শঙ্কর নতুন বিয়ে করা। বউয়ের কণ্ঠস্বর শােনবার আনন্দে তিড়িং লাফ দিয়ে উঠেই পকেট চিরুনিটা দিয়ে একটু চুলটা আঁচড়ে নিত, অথবা গদাইবাবু উঠতেনই না।‘ও গদাইদা’, ‘আরে ও মশাই’, ‘উফ, কী ঘুম রে বাবা’ এই সব বিচিত্র ক্যাকোফোনির মধ্যে কাতুকুতু দিয়ে শুধু আবদুল্লাই ঠেলে তুলতে পারত। গদাইদাকে। আজকালকার মতাে এত শশব্যস্ত থাকত নাকি সবাই! বেশ একটা শান্তির আবহাওয়া থাকত অফিসে। তা নয়, এখন পকেটের মধ্যে, নয়ত টেবিলের পাশে, অথবা কাজের ড্রয়ারেই এসে হাজির হয় জোর তলব, “কি গাে, ভুলে মেরে দিয়েছ তাে তিন্নির মেয়ের জন্মদিনের গিফটের ব্যাপারটা? আমি ঠিক জানতুম’, অথবা, বাজার খুঁজে চিমসে পটলগুলাে নিয়ে এসেছ তাে খেয়াল করে খানিকটা পােস্ত কিনে। আনতে পারলে না! পটল-পােস্তই নয় বানিয়ে রাখতাম, কী তালকানা মানুষ রে বাবা! দয়া করে আসার সময়ে কিনে এনে উদ্ধার কোর! কী যন্ত্রণা, বাড়ি থেকে পালিয়েও বাড়ির মালকিনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই! তা ছাড়া রয়েছে দৈনিক বায়নাক্কা, কচি কচি ছেলেমেয়েগুলাে বােধহয় শুধু পুলিনবাবুকেই সাহায্য করার জন্য প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে, নইলে প্রতিদিন বড়াে বড়াে অঙ্কের টাকা ধার দেওয়ার জন্য এতবার করে ফোন করে কেন নানা জায়গা থেকে! এই বিতিকিচ্ছিরি যন্ত্রের জ্বালাতনে পুলিন চক্কোতির প্রাণ ওষ্ঠাগত। অথচ গিন্নি ব্যাপারটা কী করে যেন খানিকটা বােধগম্য করে ফেলেছেন। ছেলে পছন্দ করে মা-র মুঠোফোনটি কিনিয়ে ছিল। অম্বুজা দেখতে-শুনতে অপেক্ষাকৃত কমবয়সী লাগলেও কী হবে, আসলে তাে পুলিনবাবুর যখন ফাইনাল ইয়ার, তখনই প্রেসিডেন্সিতে ঢুকেছিল। সাকুল্যে বছর তিন-চারেকেরই তাে তফাত। তাও সে দিব্যি বরাভয় মার্কা হাসি ছড়িয়ে বােতাম টিপে ফোনে দুনিয়া জয় করে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাড়িতে। ইদানীং আবার হােয়াটসঅ্যাপ না কী এক জিনিসে মাঝেমধ্যেই পুরনাে বান্ধবীদের সঙ্গে ফোনে হাসি হাসি মুখে বসে বসে আড্ডা মারে! রূপম বাবাকেও এ ব্যাপারটা বােঝানাের চেষ্টা করেছিল বটে। দূর দূর, ও সব বালখিল্য ব্যাপার-স্যাপারের জন্য সময় কোথায়। পুলিনবাবুর! সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের অ্যাকাউন্টেন্টের কি অত সময় আছে এ সব হাতবাক্স নিয়ে খুটখুট করার বা গপ্পে মজে থাকার! কত রকম। মগজবাজি করতে হয়, কত যে দায়িত্ব নিতে হয়, তার এরা কী জানে!

কিছুদিন হল নানা কথা ভুলে ভুলে যান বলে গিন্নির কাছে বকুনি খেতে হচ্ছে পুলিনের। রূপটা এমন পাজি, কিছুদিন ধরে খিটমিট আর অশান্তি দেখে নানা নম্বর দেখে নানা নম্বর সাজিয়ে কী এক বিটকেল খেলা আবিষ্কার করে ফেলল পুলিনবাবুর মুঠোফোনে। বাবার স্মৃতিশক্তি চাঙ্গা। রাখার জন্য সে প্রাণপণে সেই খেলা শেখাতে চেষ্টা করতে শুরু করল। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে চা খাওয়ার পর রূপমের বাড়ি ফেরার দরজার ঘন্টি শুনেই তার খাটের তলায় ঢুকে পড়ার কথা মনে হত।

‘ছাড়, ছাড় রে রূপ, তাের বাবার দ্বারা ও সব খেলাটেলা হবে না। আমার কপালে এই দুর্গতিই থাকবে বাপ! বাজারের থলিতে কালােজিরের বদলে পাঁচফোড়ন, সাপ্তাহিক বর্তমানের বদলে ছাইপাঁশ স্পাের্টস ম্যাগাজিন আর ধুপকাঠির বদলে মােমবাতির প্যাকেট, এই নিয়েই গােটা জীবন কাটালাম। আর খেলবে কে, উনি! কোনও দিন তাে লুডাে খেলাতেও জিততে দেখলাম না!

গজগজ করতে করতে অম্বুজা থানকুনি পাতার রস নিয়ে এলেন বাটিতে করে। ওতে নাকি পুলিন চক্কোত্তির স্মৃতিশক্তি টগবগিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কতবার গিন্নির আঁচলে থানকুনির রসটা ঠোটের থেকে মুছে, অল্প হেসে, হাত ধরে আস্তে আস্তে বলেছেন পুলিন, “সারাদিন কী এত কাজ কাজ কর? বলি আগে তাে দু’দণ্ড পাশে বসতে, তােমার গানের গলাখানা কী খাসা ছিল বলাে তাে? কলেজ সােশ্যালের সে সব দিন…। ‘আরে ভীমরতি হল নাকি বুড়াের, ছাড়াে দেখি, গ্যাসে দুধ চাপানাে। গানের ‘গ’ আর এখন আমাতে নেই, কদর করলে নাকি তুমি! অম্বুজা হাত ছাড়িয়ে বেড়িয়ে যান।

সত্যিই সময় নেই, কারও সময় নেই পুলিন নামে মানুষটার জন্য। ছেলেটা বাবাকে খুবই ভালােবাসে, তা বােঝা যায়। কিন্তু এম এসসি পাশ। করার পর থেকে সে দিন-রাত হয় কম্পিউটারের সামনে বসে তার পি এইচ ডি-র ব্যবস্থা করতে চিঠিপত্র লিখছে, অথবা সে মােবাইলে ব্যস্ত। অথচ মায়ের সঙ্গে যােগসাজশ করে মাইক্রোয়েভ কেনার সময় সে ঠিক পায়। যন্ত্র এনে, তার পুঁথিপত্র পড়ে, তার নাড়িভূঁড়ির খবর জেনে। নিয়ে, বানিয়েও ফেলল চিকেন রােস্ট আর বেকড ভেজিটেবল! উৎসাহের আতিশয্যে মায়ে-পােয়ে মিলে পুলিনবাবুর কোলেস্টেরল ।

রিপাের্টের শ্রাদ্ধ করতে করতে সেদিনই আরও রন্ধন প্রণালি খুঁজতে বসল ইন্টারনেটে। রাত বারােটা নাগাদ তাদের মনে করিয়ে দিতে হল যে পরের দিন যদি অফিস যেতে হয় তা হলে রাতের খাবার তক্ষুনি খাওয়া দরকার।

‘দেখলি রূপ, তাের বাবার কাণ্ড! একটু কৃতজ্ঞতা নেই গাে! আরে আমরা মা ব্যাটা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি তােমার খাবারের চার্ট বানাতে, আর তুমি কিনা খালি খাই-খাই করে বেড়াচ্ছ!’অম্বুজা বলে উঠল।

খ্যাকখ্যাক করে হেসে ফেলল ছেলে আর পুলিনবাবুর থালাতে ভাতের সঙ্গে এসে হাজির হল গাওয়া ঘি আলুভাজার বদলে সেই নতুন কাচের বাক্সে সেদ্ধ সবজি, যাদের সবুজ রঙ দেখেই চারপেয়ে ঘাসখেকো প্রাণীদের সঙ্গে নিজের একান্ত আত্মীয়তা অনুভব করলেন পুলিন। ছেলের প্রশংসায় অম্বুজা সব সময়েই পঞ্চমুখ। রান্নার যন্ত্রটা এনেই তার পুঁথিপত্র পড়ে ফেলে, কম তেলের মুরগিটাও এমন দারুণ বানিয়ে ফেলল রূপম, জননীর আশ্চর্য হওয়ার কারণ তাে থাকবেই! অবশ্য বেড়ে যাওয়া কোলেস্টেরলের খাতিরে পুলিনবাবুর পাতে দুখানা নলির টুকরাে ছাড়া মুরগির আর কিছুই তাে পড়ে না। বিতিকিচ্ছিরি স্বাদ সােনামুখ করে গলাধঃকরণ করে ছেলের মাথায় আর্শীবাদের হাত-টাত বুলিয়ে পুলিন মনে মনে রােববারের ডিনারের বাপান্ত করলেন সেদিন।

ছেলেটারই বা এত বেশি বুদ্ধি হতে গেল কেন! ঐ যে নিজের শ্বশুরমশাইকে ধরে বসেছিল অম্বুজা, বাবা, ডাক্তার দেখেশুনে বলেছেন সিজারই করবেন, তা একটা ভালাে দিনক্ষণ আপনিই ঠিক করে দিন না, আপনার কুষ্টিবিচারে পাড়ার কত মানুষের কত উপকার হয়েছে! স্নেহের পুত্রবধূর হাত থেকে পানের খিলিটি নিতে নিতে গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলােক, ‘ভালাে যােগ তাে আছে মামণি, তবে তুমি বল কী চাও, সন্তান রাজা হবে, নাকি বিদ্বান?

না না বাবা, আমার পলিটিক্সের নেতা চাই না, স্বদেশ-বিদেশ দু’জায়গাতেই যেন সে সম্মান পায়, সে ছেলেই হােক বা মেয়েই হােক, অম্বুজা কথা আদায় করে শ্বশুরমশাইয়ের কাছে। সেই সময় অনুযায়ী জন্মগ্রহণ করেই কি ছেলেটার এমন ক্ষুরধার বুদ্ধি হয়ে গেল! স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় রূপম ডিস্টিংশন তাে পেয়েছেই, এবার রিসার্চের ব্যাপারেও তােড়জোড় করে সে নিজেই এগােচ্ছে।

তা ভালাে কথা, কিন্তু ছেলে শহর ছেড়ে বাইরে কোথাও পড়তে চলে গেলে তাে মা হত্যে দিয়ে পড়বে। একদিনের জন্য অম্বুজা ছেলেকে ছাড়া থাকতে পারেনি জীবনে। এমনকি নিজের মায়ের স্ট্রোকের সময় সেবা করতে বাপের বাড়ি গেল যখন, ছেলেও সঙ্গে চলল। তার পর তার স্কুল কামাই বন্ধ করতে পুলিনের শ্বশুমাতাকে সঙ্গে নিয়েই ফেরত এল অম্বুজা। যা-ই হােক, ভাগ্যিস বয়স্কা মহিলা কিছুদিনের মধ্যে অনেকটা ভালাে হয়ে প্রত্যাগমন করেছিলেন। ভারতবর্ষের অন্য কোনও প্রান্তে যদি রূপমকে যেতে হয়, অম্বুজাও না সঙ্গে রওনা দেয়, ছেলেকে ছাড়া থাকতে হলে তাে কেঁদে কেঁদে বােধহয় মরে যাবে সে। কদিন আগে স্পেন না কানাডা, কোথাকার প্রজেক্টের কথা বােধহয় বলেছিল রূপ। সেদিন রাতে ছেলের মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে টপটপ করে অম্বুজার চোখের বড়াে বড়াে জলের ফোটা গড়িয়ে পড়েছিল বােধহয় রূপমের গালে। ছেলেও মা-অন্ত প্রাণ, ধড়মড় করে উঠে বসে মার চোখ মুছিয়ে বলে বসল, “না না গাে মা, আরে তােমাদের বলাই হয়নি, আমি তাে এখানে সায়েন্স কলেজেই একটা খুব ভালাে পি এইচ ডি প্রজেক্ট পেয়ে গিয়েছি গাে। ফুল স্কলারশিপ, বাবাকেও আমার পড়াশােনার জন্য আর একটুও খরচা করতে হবে না এখন থেকে। একদম আমার মনের মতাে রিসার্চের সাবজেক্টটা। গাইড তাে আমার পুরনাে প্রফেসর। ক’বছরের মধ্যে কাজ শেষ হলে ইউনিভার্সিটিতেই আমার চাকরি পাক্কা। কী দারুণ ব্যাপার বল তাে বাবা, একই শহরে একসঙ্গেই থাকতে পারব আমরা!’

চোখটোখ মুছে ততক্ষণে চাঙ্গা হয়ে উঠে বসেছেন পুলিন-জায়া, ‘বলিস কী রে! সেটা তাে দারুণ হবে। তাের বাবার যা অবস্থা! দ্যাখ না তিন দিন ধরে টিভির রিমােটটা বিগড়িয়েছে, মানুষটা কিছুই করতে পারে না! মাতৃবৎসল ঐ রাতেই বিছানা ছেড়ে এক দৌড়ে হাজির হল বসার ঘরে, আর অবাক ব্যাপার, খুট খুট করে কী সব নেড়েচেড়ে ঠিক করে ফেলল। জিনিসটাকে! হাসিতে গদগদ অম্বুজা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বরাবরের মতাে বললেন, ‘দ্যাখাে দেখি, রূপ ছাড়া আমাদের কি একটা দিনও কাটবে গাে!’ কাটবে না হয়ত, অথচ পুলিনবাবুর ট্রান্সফারের সরকারি হুকুমের চিঠি এসে পড়ে রয়েছে টেবিলের ওপর। ছেলের সাফল্যে সদা-গর্বিত মায়ের সময় কোথায় সেই শমন-চিঠির প্রতি নজর দেওয়ার! অথচ রূপমের জন্মের আগেও তাঁরা স্বামী-স্ত্রীই তাে ছিলেন। পুলিনবাবুর এখনও মনে পড়ে, নতুন চাকরি আর সীমিত পয়সাকড়ির ভরসায় মধুচন্দ্রিমার জন্য পুরীর সমুদ্র অবধি এগােতে পেরেছিলেন তিনি। দামি হােটেল নয়, সমুদ্রের কাছাকাছি ছােটোখাট নেহাত সস্তা হলিডে হােমে উঠেছিলেন তাঁরা। নতুন বউয়ের হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হয়েছিল সে কদিনও, কিন্তু তাও মাঝরাতে সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর জ্যোৎস্নার নাচ দেখতে দেখতে সৈকতে বসে পুলিনের কাধে মাথা রেখে কী চমৎকার গান গেয়েছিলেন অম্বুজা, ‘তুমি যে আমার, ওগাে তুমি যে…’। ঠিক সন্ধ্যা মুখার্জির মতাে না হলেও পুলিনবাবুর কানে সে গানের প্রতিটি কথা আর ঝাউবনে ভেসে বেড়ানাে সুর চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল। সে কথা এখনও কখনও উল্লেখ করে ফেলেন পুলিন, বিশেষ করে বিবাহবার্ষিকীটিকিতে।

‘দূর, আদিখ্যেতা! তােমার এখনও এ সব মনে আছে?’বলে মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান গিন্নি, পুলিন লজ্জার খাতিরে বলে উঠতে সময় পান না, এখন এই বয়সে আর একবার অমনতর জ্যোৎস্নারাতে অম্বুজাকে নিয়ে ঢেউয়ের কাছাকাছি যেতে চান তিনি। সব কিছুই কি এত বদলে গেল! এত বদলে যেতে পারে! মানুষটা তিনি একটু রসকষহীন ঠিকই। উচ্ছ্বাস, উদ্বেগ, উল্লাস সব কিছুরই প্রকাশ তার

হয় কম, কিন্তু স্ত্রীকে তিনি অত্যন্ত ভালােবাসেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করে বিশাল ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, গাড়ির মালিক না হতে পারলেও ছােট্ট ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন অম্বুজারই পছন্দমতাে। গৃহপ্রবেশের দিন গুটিকতক বন্ধুবান্ধব এসেছিল। একহাতে রান্না সেরে বিকেলে গা ধুয়ে একটা কচি কলাপাতা রঙের ঢাকাই পড়েছিল অম্বুজা, মনে আছে পুলিনের। “আরে, শাড়িটা তােমায় দারুণ মানিয়েছে, বলে উঠেছিলেন তিনি।

‘তাও তাে মনে করে রাখােনি যে এটা তােমারই দেওয়া, আমাদের দশ নম্বর বিবাহবার্ষিকীতে! অম্বুজার গলায় অল্প একটু চাপা অভিমান কানে লেগেছিল। অপ্রস্তুত পুলিন তাড়াতাড়ি আনাড়ি হাতে গিন্নির খোঁপায় বেলফুলের মালাখানা জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে নিজের মােটা। মােটা আঙুল দিয়ে মালা আর চুলের মধ্যে জড়িয়েটড়িয়ে গিঁট ফেলে একাকার করে ফেললেন। ভাগ্যিস নতুন ফ্ল্যাটের আনন্দে অম্বুজার মুড ভালাে ছিল, প্রশ্রয়ের হাসি হেসে সাবধানে মালা খুলে বেডরুমের একধারে টেবিলে কাচের বাটিতে জলে ভিজিয়ে রেখেছিলেন তিনি। পুলিন সব কাজ ঠিকঠাক করে উঠতে পারেন না, যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতেও তিনি খানিকটা অপারগ, তা তিনি মানেন। কিন্তু ছেলেটার বড়াে । হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দাম সংসারে যেন ক্রমশই কমে আসছে। বাবা হিসেবে ছেলেকে নিয়ে তারও অসীম গর্ব। এমন ধীমান, ভদ্র, অমায়িক ছেলে আজকাল কটা দেখতে পাওয়া যায়! তবু প্রায় প্রতিটি কাজেই কোথায় যেন মনে হয় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি একেবারে হেরে বসে আছেন। এই তাে কদিন আগে বছরের শেষ রাতে শখ করে বিরিয়ানি রান্না করা হল বাড়িতে। মাঝরাতে পেটব্যাথায় কাতর হয়ে গিন্নিকে ডাকতেই হল তাঁর। সমস্ত দিনের পরে ক্লান্ত ছিল অম্বুজা। বয়েসটা ওরও তাে বাড়ছেই, কমছে না। পুলিন সাতান্ন পেরােলে সেও তাে। পঞ্চাশের পর আরও কিছু বছর পার করেছে।

‘ভালােমন্দ রান্না না হয় কিছু হল, তবু খাওয়াদাওয়া একটু বুঝেশুনে না করলে রাতবিরেতে আমারই জ্বালাতন হয়ে মরতে হয়। তা ছাড়া কতবার রূপ বলে ওর সঙ্গে মর্নিংওয়াকটা শুরু করতে। নেয়াপাতি সাইজ থেকে পেটে যে এত্ত বড়াে ফুটবল তৈরি হয়ে গেল, বলি সে হুঁশ আছে’, জোয়ানের আরক খাওয়াতে খাওয়াতে শুনিয়ে দিল বউ।

কোথায় একটু পেটে হাতটাত বুলিয়ে উঁহু-আহা করবে, তা না অসুস্থ মানুষকে খাওয়াদাওয়ার খোঁটা! অথচ কিছুদিন আগেই রূপ নতুন বাইক থেকে পড়ে গিয়ে অল্প চোট পেল। বাইক কিনতেই বারণ করেছিলেন পুলিন। তখন কিন্তু চোখের জল ফেলে একসা হয়েছিল এই মহিলাই। ডাক্তারের কাছে নিয়ে পরপর কিছুদিন ব্যান্ডেজ-ড্রেসিং করাতে তখন তাে তার অনীহা দেখা যায়নি একটুও !

এ সব চিন্তা করতে করতে জিভ কাটেন পুলিনবাবু এক-আধবার। ছিঃ, কী অদ্ভুত চিন্তাধারা তার, নিজেরই আত্মজকে হিংসে করছেন নাকি তিনি! না না, তা নয়, একদমই নয়। কিন্তু অম্বুজা বােঝে না যে এ বয়সে পৌছেও স্ত্রীকে চোখে হারান পুলিন। কেন যেন সে বড্ড শীতলতা বাড়িয়ে দিয়েছে সম্পর্কের মধ্যে। নাকি বাতিল হয়ে যাচ্ছেন পুলিনবাবু! শারীরিক সম্পর্ক তাঁদের মধ্যে কমই হয়, আগ্রহ নেই অম্বুজার। একটি পুত্রসন্তানের জন্ম তাকে মাতৃগর্বে সম্পূর্ণা তৈরি করেছে। তার জীবন ছেলেকে কেন্দ্র করেই বয়ে চলেছে। অবশ্য এ ব্যাপারে তেমন কোনও দাবি নেই পুলিনবাবুর। রাতে ঘুমের গভীরে পাশে শােয়া পঁচিশ বছরের চেনা মানুষটির হাত মাঝেমধ্যে অসাবধানে তার বুকের ওপর লতিয়ে থাকলেও তার বেশ লাগে। পরদিন সকালটাও যেন সেই খুশিতেই আলাে-রােদ্র হয়ে থাকে। অফিসে মেজাজ ফুরফুরে থাকে। অম্বুজা কি। জানে না বা বােঝে না এই স্পর্শের ম্যাজিক কতটা কাজ দেয়! হয়ত বােঝার সময়ই তার নেই, হয়ত বুঝতেই চায় না সে। সাতপাঁচ ভেবে ট্রান্সফারের অর্ডারটা বেডরুমের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন পুলিনবাবু। কথাটা জানালে আবার না জানি কী বকুনি খেতে হবে হােম মিনিস্টারের কাছ থেকে। কিন্তু ঘরদোর পরিষ্কারের বাতিকটা তাে গিন্নির আজকের নয়, পরদিন অফিস থেকে ফিরতেই চায়ের কাপের। সঙ্গে সেই চিঠির কাগজটা নাকের সামনে নাচিয়ে প্রশ্ন ছোঁড়া হল, ‘বলি, আজকাল আর কী কী লুকোনাে হচ্ছে আমার থেকে, শুনি? খাবি খেতে খেতে পুলিন ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলেন, “চিন্তা করাে কেন, কোলেস্টেরলের ওষুধ তাে আমি রেগুলার খাচ্ছি, ডাক্তার সরকার এই সেদিনও দেখে বললেন হার্ট-টার্ট এখন আর ঝামেলা করবে না কিছুদিন, বাইপাস হওয়ার পর অত রিস্ক আর থাকে না। আর । ট্রান্সফারটা নিলে তােমাকে আরও একটু আরামে রাখতে পারব যে গিন্নি, না নিলে যে নিজের থেকে রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাড়িতে বসতে হতে পারে।

থুতনির থেকে আদরের আঙুল অগ্রাহ্য করে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠল অর্ধাঙ্গিনী, ‘খুব হয়েছে, আর সাহস দেখাতে হবে না বীরপুরুষের। নিজের দেখাশােনা যে তুমি কত করতে পারবে তা কি আমার আর জানা নেই? এ বাড়ি ছেড়ে একদম কোথাও যাওয়াটাওয়া হবে না, শুনে রাখাে। ভালাে করে। একা একা সংসারের সব দায়িত্ব আমার ওপর চাপিয়ে চম্পট দেওয়ার চেষ্টায় রইলে চিরটা কাল।

‘আরে, ঘাবড়াও কেন অমু, রূপটা তাে এখন আর পড়াশােনার জন্য কলকাতার বাইরে যাচ্ছে না। তা ছাড়া, ঐ যে ঐদিন শুনলে না খেয়াল করে? ওর তাে চাকরির ব্যবস্থাও এখানেই হয়ে যাবে। তােমরা মায়ে-পােয়ে কাটিয়ে দিও না বাকি দুটো বছর। আমি অফিসের কোয়ার্টারে থেকে, মেসে দুটো খেয়ে ঠিক ম্যানেজ করে বেঁচে থাকব। একটু কি গলা ধরে এল পুলিনের! |

ছেলেরও খবরটা শুনে খুব একটা ভালাে লাগল না মনে হল। রাতে শােয়ার আগে বা পরে কারও সঙ্গে কারও আর কথা হল না। সেদিন থেকে পরপর দুদিন মুখে কুলুপ এঁটেছেন পুলিন-গৃহিণী। শুধু ছেলের সঙ্গে কাগজপত্র নিয়ে গম্ভীর মুখ করে কী সব কথাবার্তা বলেন তিনি আজকাল। পুলিন অফিস থেকে ফেরার পর দেখতে পান তারা ব্যস্ত, তার সঙ্গে কেউই বিশেষ কথা বলে না। পুলিনবাবু আস্তে আস্তে রিটায়ারমেন্টের পর নিজস্ব কনসালটেন্সির স্বপ্নটা মুছে ফেলেছেন মন থেকে। সেই কবে চাকরিতে ঢুকেছেন! ইচ্ছে ছিল এতগুলাে বছর পরের হুকুম মেনে চলার পর, অবসর হলে নিজস্ব অধিকারে নিজের পছন্দমতাে কিছু কাজ করবেন তিনি। ঘরের টান তার বরাবরই বেশি। সন্ধের পর বাড়ি ফিরে চেনা হাতের চায়ের স্বাদ তাকে সারা জীবন টানে। সংসারের একটা অদ্ভুত মায়া আছে, পুরনাে ধােয়া তােয়ালে যেমন নরম, তেমনই সুন্দর পুরনাে সম্পর্কের স্পর্শ। এমন সম্পর্কের একটা আলাদা সুগন্ধও আছে, ঠিক যেমন একটা গন্ধ বেরােয় প্রতি শীতে রােদে দেওয়া প্রাচীন লেপ-কম্বলে। তবুও সে সমস্ত ওম ছেড়ে বহুদূরে চলে যাবেন তিনি। সাচ্ছল্য বাড়বে, হয়ত একটা গাড়ি কেনার সামর্থ্য হবে। গাড়ির রংটা অবশ্য হতে হবে নীল, প্রিয় একটি মানুষ নীল রঙ যে বড্ড ভালােবাসে। আর নিজস্ব বিজনেস, তার কথা আপাতত ভুলে থাকাই ভালাে। নির্দিষ্ট দিন কাছাকাছি আসছে, অথচ অম্বুজার হেলদোল নেই, গােছগাছের আগ্রহ পর্যন্ত নেই তার। কী যেন কী ব্যস্ততায় প্রায় রােজই আজকাল বাইরে যায় সে! কাজের মেয়েটা তাে এই রােববার বলেই ফেলল, ‘বউদিমণির কী যে হইয়েছে, আজকাল কাপড় কাচার সাবানটাও বের করে দিতে ভুলে ভুলে যাচ্ছে! মা গাে মা, গত দু’দিন তাে আমি দরজায় বেল দিয়ে দিয়ে ফিরে গেছি বেলা এগারােটায়!’

জিজ্ঞেস করবেন করবেন ভেবেও করেন না পুলিন। নানা বিল জমা করার তারিখগুলাে, কাছাকাছি ওষুধের দোকানের ফোন নম্বর, মাসকাবারি খরচার হিসেব বােঝাবেন বলে তিনি সেদিন সন্ধ্যায় তৈরি হয়ে বসেছেন। গুমােট গরম আষাঢ়ের এই প্রথম সপ্তাহেও। অম্বুজা জলখাবার এনে বেডরুমে ছােট টেবিলটায় রাখল অভ্যেসমতাে। তার পর সামনাসামনি বসল পুলিনের কথা শুনতে।

আধখানা কথা শুনেই উঠে চলে গেল সে। কী অদ্ভুত ব্যবহার! একটু ধৈর্য হারালেন পুলিনবাবু। আরে ঝামেলা কিছু হলে ভুপাল থেকে অতদূর উড়ে এসে সামাল দিতে পারবেন নাকি পুলিন! সেই জন্যই তাে সব বুঝিয়ে দিয়ে যাওয়া। মহিলা শুনবেও না মন দিয়ে, তার পর ফোনে নানা । কথার বিবরণ শােনাবে। বকুনিই তাে আজকাল বেশির ভাগ শুনতে হয় পুলিনের। কিন্তু ততক্ষণে মােটাসােটা কী একটা কাগজের প্যাকেট এনে হাতে ধরাল অম্বুজা!

‘আরে ব্যাপারটা কী হে অমু, এ আবার কী!’ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন পুলিন, ‘একটু বসে আমার কথাগুলাে তাে শুনে নাও, যাওয়ার আগে আমার যে আরও অনেক কাজ রয়েছে গুছিয়ে তােলবার।

‘আর গােছাতে হবে না কিছু’, গিন্নির কথায় হতবাক পুলিন।‘তােমার বাজার খরচ, প্রতি বছরের পুজোর বাজারের টাকা যা দিয়েছ, আর আমার পােস্ট অপিসের টাকা মিলে এতটা জমিয়েছি বিয়ের পর থেকে এত বছরে। লাখ পনেরাে তাে হবেই। রূপ হিসেব করে বলেছে। চাকরি জীবনের শেষ দু’বছরের জন্য আর বিদেশবিভঁয়ে গিয়ে থাকতে হবে না আমায় জ্বালাতে। আমায় ঝামেলায় ফেলার তােমার সব ধান্দা আমি। জানি। ভুলে যেও না বিয়ের পঁচিশ বছর হয়েছে, আর তার আগে প্রেমের বছর তিন, হাড়ে হাড়ে চিনি তােমায় আমি বুড়াে। ভি আর এস নিয়ে সামনের হপ্তায় ওদের মুখের ওপর চিঠিটা ফেলে আসবে। বাইরের ঘরের পাশে ছােটো ঘরটায় সাজিয়ে দেব তােমার কনসালটেন্সির অফিস। অ্যাকাউন্টেন্সিতে গােল্ড মেডেল দেখেই তাে বিয়েতে এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল আমার বাবা। যাবে কোথায় আমি থাকতে! আর এইটাও ধরাে না হয়।

পুলিনবাবুর হাঁ করা মুখ আরও বড়াে হাঁ করিয়ে আঁচলের তলা থেকে বের হল গয়নার বাক্স। ব্যাঙ্কের ভল্টে গিয়েছিল এই মহিলা! যে কিনা বিয়ের পর এতগুলাে বছরে একবারের জন্যও পুলিনকে ছাড়া ব্যাঙ্ক-মুখাে হয়নি নিজের অ্যাকাউন্ট দেখতে বা ধনরত্ন দেখেশুনে রাখতে! নেহাত জলে তাে পড়ে নেই গাে আমরা, টাকা শেষ হলেও আমার এই ভরি পনেরাে সােনা কি কাজে দেবে না ?’ কঠিন মানবীর গলার স্বর একটু বােধহয় এবার কেঁপে উঠল।

দু’চোখের মুক্তোর ফেঁটা মুছিয়ে দিচ্ছেন পুলিন, ছােট্ট কপালের পাশের কঁচা-পাকা চুলগুলাে সরিয়ে দিতে দিতে ভাবতে থাকলেন তিনি, এত সাহসিনী, এমন শক্তিমতী হয়ে গেল অমু কবে থেকে! কবে থেকে ভালােবাসার দাবির ব্যাপারে এভাবে মনঃস্থির করতে শিখল সে! নাকি ফল্গুধারার মতাে যে স্রোত চিরদিন বয়ে এসেছে, তাকে পুলিনই অনুভব করতে পারেননি! সহধর্মিণী, সহমর্মী, চিরসঙ্গী মানুষটিকে বুকের । গভীরে টেনে নিতে কী আশ্চর্য সুখ, কী অবাক প্রশান্তি, আস্বাদন করতে করতে বহুদিনের চেনা নরম দু’হাতের প্রার্থিত আলিঙ্গনে ধরা দিলেন পুলিনবাবু। বাইরে আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি নামল বুঝি।

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes