চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল অনেক। সারা পৃথিবীর তথ্য ছাঁকনি দিয়ে ছেকে রথীনদা আমায় বােঝাত, কীভাবে ভােট হয়। কেমন করে লােকে জেতে নির্বাচনে।
আমি বারবার বলতাম, হাওয়া। হাওয়ায় জেতে।।
রথীনদা চায়ে চুমুক দিয়ে মিটিমিটি হাসত।
-সত্যি রথীনদা। হঠাৎ করে একটা লােক, কয়েকটা ঘটনার উপর ভর দিয়ে লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে ওঠে। আর তারপর অজস্র লােক ভাবতে থাকে সেই সুপারহিরাে তাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। এখন এই ইন্টারনেটের রমরমায় ভার্চুয়াল যােগাযােগটা তাে সত্যিকারের যােগাযােগের থেকে বেশি ছাড়া কম নয়। আমার টিউবওয়েল খারাপ হলে কে সারিয়ে দেবে তা ভেবে লােকে ভােট দিতে যায় না। লােকে ভােট দেয় একটা ইমেজকে। আর সেই ইমেজের প্রতি টানটা হাওয়াতেই গড়ে ওঠে।
রথীনদা একটু চুপ করে থেকে বলত, তাের কথাটা ফেলে দেওয়ার মতাে নয়। কিন্তু ব্যাপার কী জানিস তাে বাবলু, হাওয়া যেমন আসে, হাওয়া চলেও যায়। পড়ে থাকে সংগঠন। এবার এই সংগঠনটা দুটো ইটের মাঝখানে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করতে হয়। যত বেশি সম্ভব বাড়ি গিয়ে। বলতে হয় যে, পাশে আছি। আপনার যে কোনও বিপদে সাধ্যমতাে সাহায্য করার জন্য, পার্টির তরফে আমরা আছি। তবেই মানুষের বিশ্বাস পাওয়া যায়।
রথীনদা ‘সংগঠন’ করতে শেখাত আমাকে। শেখাত, কীভাবে পার্টির সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকটা কর্মীর মনে বিশ্বাস দিতে হয় যে সে না থাকলে পার্টিটা মুখ থুবড়ে পড়বে। আমার প্রথম প্রথম হাসি পেত দাদার কথা শুনে। বাজারের দোকানিদের ষাট পাওয়ারের ইলেকট্রিক বাল্বটা একশাে পাওয়ারের করে দেওয়ার মধ্যে ভােটে জেতার চাবিকাঠি আছে?
রথীনদা বলত যে আছে’ আর আমি সেই কথা পুরােপুরি বিশ্বাস না করেও রথীনদার সঙ্গেই থাকতাম কারণ লােকটার বাড়ি গেলেই বুঝতাম যে হাওয়া অনেকসময় থাকতে আসে, চলে যেতে নয়। এই বােধ রথীনদার বউ নীপা বৌদিকে দেখে বেশি করে হত। একজন মহিলা যার মধ্যে। | এতটা আবেদন, যার হাসিতে শুধু মুক্তো ঝরে না, ইলেকট্রিক বাল্বও বিদ্যুৎ ছাড়া জ্বলে ওঠে, সে অত সাধারণভাবে থাকে কী করে? নিঃসন্তান । রথীনদার বৌদি ছাড়া কেউ তেমন ছিল না। কিন্তু যেটা দেখে অবাক হয়ে যেতাম তা হল, অত আকর্ষণীয়া একজন মহিলার স্বামী হয়েও রথীনদা কী আশ্চর্য উদাসীন থাকত বৌদির ব্যাপারে। অবহেলা করত না তাই বলে। কিন্তু অনেকদিন রাত্রি সাড়ে এগারটা, বারােটা অবধি দু’কামরার। ভাড়াবাড়িতে বসে থেকেও রথীনদাকে বৌদির জন্য এতটুকু উতলা হতে দেখিনি।
এমন কিচু বয়সও তাে ছিল না রথীনদার। বেয়াল্লিশ- চুয়াল্লিশ হবে ম্যাক্সিমাম। ভােটের সময় বৌদি ঘুমিয়ে পড়ত আর রথীনদা রাত্রি একটা দেড়টা অবধি পার্টি অফিসে বসে ভােটার লিস্ট তৈরি করত। আমাকে পাশে বসিয়ে বাড়ি ধরিয়ে লেখাতে ‘এফ’ নয়তাে ‘এ’।‘এফ’ মানে ফর’, আর ‘এ’ মানে এগেনস্ট। কারা আমাদের বিপক্ষে ভােট দেবে আর কারা আমাদের পক্ষে ভােট দেবে, খানিকটা জ্যোতিষীর মতােই বলে দিত রথীনদা। কোন ভােটগুলি এদিক থেকে ওদিকে যাবে আর কোনগুলাে ওদিক থেকে আসবে এদিকে, বলে দিত তাও।
বুথকেন্দ্রিক ভােটের ফলাফল যখন আসত, দেখতাম মিলে গেছে রথীনদার হিসেব। যে বুথে রথীনদার হিসেবমতাে আমাদের ভােট পাওয়ার কথা একশাে তেইশটা সেই বুথে আমরা ভােট পেয়েছি একশাে ছাব্বিশ কিম্বা একশাে একুশ।
-কী করে মেলাও বলাে তাে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতাম।
রথীনদা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলত, ভােটটা একদিনের নয়, পাঁচবছরের। মন থেকে বিশ্বাস করবি যেদিন, সেদিন তুইও মেলাতে পারবি। রাত জেগে এই হিসেবগুলাে যখন রথীনদার বাঁধা উত্তর ছিল, ‘কাজ শেষ না করে যাওয়া যাবে না। সংসার তাে থাকবেই।
সংসার কি এভাবে থাকে? আর নীপাবৌদিই বা কেমন যে কোনওদিন একটা অভিযােগ পর্যন্ত করত না? স্বামীর এই পার্টির নামে জীবন উৎসর্গ করে দেওয়া, চুপ করে মেনে নিত?
একদিন, রথীনদা ভীষণ ব্যস্ত পার্টি অফিসে, পরদিন জেলা সম্মেলন গােছের কিছু আছে, আমি রুটি আর তড়কা পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম বৌদির কাছে। বৌদির জ্বর, রান্না করতে পারবে না বলে, রথীনদাই পার্টি অফিসের উল্টোদিকে যে তপনের দোকান সেখানে অর্ডার করে দিয়েছিল। তখন রাত্রি প্রায় এগারােটা আর আমি ওই এক কিলােমিটার রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে আবারও টের পেলাম যে আমাদের মফসসলটাকে কলকাতা গ্রাস করতে শুরু করে দিয়েছে। পুকুর বুজছে, বাড়ি ভেঙে মাল্টিস্টোরিড উঠছে। খ্যাপা জন্তুর মতাে জমির দালাল আর প্রােমােটাররা নেমে পড়েছে এলাকার হুলিয়া বদলাতে।
সেই বদলাতে থাকা মহল্লায় পরিবর্তনের উলটো শব্দ হয়ে নীপা বৌদি আর রথীনদা বেঁচে ছিল। ওদের বাড়ির একতলার দরজা কখনও বন্ধ হত না , ভেজানাে থাকত শুধু। রথীনদা রাজনীতি করত বলে বাড়িওয়ালাও কিছু বলত না।
সেদিনও ভেজানােই ছিল দরজা। আমি একবার ঠেলা দিতেই খুলে গেল। একটা ছােট প্যাসেজের পর লম্বা একফালি বারান্দা পেরিয়ে। রথীনদাদের ঘরে ঢুকতে হত। আমি ঘরে ঢােকার আগেই বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম, সামনের কলতালায় বসে গায়ে শাড়ি জড়িয়ে বৌদি মগের পর মগ জল ঢালছে মাথায়।
আচ্ছা নীপাবৌদি কি পাগল হয়ে গেছে? জ্বরের মধ্যে এত রাতে গায়ে জল ঢালছে কেন? মরে যাবে তাে! কিন্তু বারণ করার আগেই আমি বােবা হয়ে গেলাম কারণ বৌদির শাড়ির ফাঁক দিয়ে আমি ওর বুক দেখতে পেলাম। কী অপূর্ব আর শ্বেতশুভ্র! যেন পৃথিবীর সব সৌন্দর্য এসে ওখানে জড়াে হয়েছে। আমি আধাআধি দেখতে পাচ্ছিলাম। না, উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিলাম না, ভাললাগায় সম্মােহিত হয়ে যাচ্ছিলাম।
দু’মিনিট, চারমিনিট, পাঁচমিনিট, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ কাঁধে একটা হাত এসে পড়ল। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম রথীনদাকে। আর দেখামাত্র মনে হল, যদি পাতালে পালিয়ে যেতে পারতাম। আমার বুকটা ধড়ফড় করছিল, থুতু আঠা হয়ে গিয়েছিল জিভে। নিশ্চল পাথরের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, কখন থাপ্পড় এসে পড়ে গালে!
থাপ্পড়ের বদলে রথীনদা আমার চুলে বিলি কেটে বলল, তপন ভুল করে ডিম-তড়কা দিয়েছে। নীপার তাে ডিমে অ্যালার্জি। ও আমার খাবার দিতে এসেছিল, ওর মুখ থেকে শুনেই দৌড়ে এলাম। নীপার মােবাইল বন্ধ, নইলে ফোনেই বলে দিতে পারতাম।
আমি বলতে চাইলাম যে মােবাইল তাে আমারও একটা ছিল কিন্তু আমার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরােল না। আমি প্রায় একছুটে রথীনদার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার মুখে শুনলাম, রথীনদা বলছে, জ্বর হলে নীপা ওরকম স্নান করে…’।
তারপর থেকে বেশ কিছুদিন রথীনদাকে দেখলেই পালিয়ে বেড়াতাম কিন্তু রথীনদা তাে ছাড়ার বান্দা নয়। একদিন রাস্তায় আমায় পাকড়াও করে। জোর-জবরদস্তি নিয়ে গেল পার্টি অফিসে। যেতে যেতে বলল, কেন এরকম অদ্ভুত আচরণ করছিস বল তাে?
বিশ্বাস করুন, আমি ওরকমভাবে বৌদিকে দেখতে চাইনি। কিন্তু সেদিন ওই মুহুর্তে, আমার পায়ে যেন দড়ি বেঁধে দিয়েছিল কেউ। আমি নড়তে পারিনি। বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম আমি।
ওরে পাগল, ওটা খুব স্বাভাবিক একটা রিঅ্যাকশন। তুই তাে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলি দু’মিনিট। ঝাঁপিয়ে পড়ে তাের বৌদির শ্লীলতাহানি তাে করতে যাসনি!
রথীনদা আপনি এত সহজে আমাকে ক্ষমা করে দিচ্ছেন কীভাবে? সেদিন আপনি না এলে আমি হয়তাে দাঁড়িয়েই থাকতাম। সেটা জেনেও আপনি আমায় চড় মারছেন না কেন? আপনি কি ভগবান?
আমি একটা মানুষ বাবলু। আর তুই আমার সহকর্মী। তােকে পাশে না পেলে আমি দলের কাজ করব কী করে? ওটা জাস্ট একটা ইনসিডেন্ট। ভুলে যা তাে। চল আমার বাড়ি চল।।
না রথীনদা আমি যেতে পারব না। বৌদি না জানি কী ভাবছে আমার সম্পর্কে। নীপা টেরও পায়নি তুই দাঁড়িয়ে ছিলি। নীপা একটু ভাবের ঘােরে থাকে তুই বুঝিস না? তুই গেলেই টের পাবি, যা যেমন ছিল, সব তেমনই আছে।
সেদিন রথীনদাকে কোনওক্রমে এড়িয়ে গেলেও বেশিদিন পারলাম না। মাসখানেকের মধ্যেই একদিন যেতে হল রথীনদার বাড়ি। আর সেদিন চা, মুড়ি, আলুরচপ খেতে খেতে একবারও মনে হল না যে নীপাবৌদী অন্য নজরে দেখছে আমাকে।
রথীনদা ঈশ্বরের মতাে মানুষ বলেই হয়তাে খেয়াল করেনি যে এই নরকের মতাে পৃথিবীটায় কয়েকজন অন্য নজরে দেখা শুরু করেছে ওকে। সেই লােকগুলাে পার্টির ভিতরের এবং বাইরেরও কিন্তু তারা একসঙ্গেই বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে রথীনদা থাকলে শিবের মাঠ বা মিত্তিরদের পুকুর ভরাট করাটা অত সহজে হবে না। চারতলা স্যাংশন নিয়ে ছ’তলা বানানাের ধান্দায় ভাটা পড়ে যাবে। এ পকেট থেকে ও পকেটে যাওয়ার সময় লাখ লাখ টাকার একটু অসুবিধে হয়ে যাবে। রাজনীতিকে যারা কারবার বানিয়ে নিয়েছে তারা এই অসুবিধে গুলাে হটিয়ে দেবার ব্যাপারে খুব তৎপর হয় তাই একদিন রাত বারােটার একটু আগে পার্টি অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে রথীনদা পেটে চপার আর বুকে গুলি নিয়ে রাস্তায় পড়ে রইল। আমি তার দু’মিনিট আগেও রথীনদার সঙ্গে ছিলাম, আমাকে তারকের দোকান থেকে সিগারেট আনতে পাঠিয়ে আকাশের নিচে একা দাঁড়িয়ে ছিল রথীনদা। আচমকা তিনটে ছেলে ঘিরে ফেলল ওকে।
ছেলেগুলাে আসবে জেনেই কি রথীনদা সিগারেট আনতে পাঠিয়েছিল আমাকে? কিন্তু আমি তাে তারকের আধা-বন্ধ কঁপের ফাঁক দিয়ে। দেখতে পাচ্ছিলাম ওরা রথীনদাকে কোপাচ্ছে, তারপর মাথায় পিস্তল ধরে টেনে দিচ্ছে ট্রিগার, তাহলে কেন চিৎকার করে উঠলাম না, ছুটে গেলাম না? তারক আমার মুখ চেপে ধরেছিল বলে না মরার ভয় আর বাঁচার লােভ আমাকেও গ্রাস করেছিল?
খুনেগুলাে সরে যাওয়ার পর যখন আমি রথীনদার সামনে গিয়ে হাউহাউ করে কাঁদছি আর ধাক্কা দিয়ে বৃথা জাগাতে চেষ্টা করছি রথীনদাকে তখন কেন আমার মাথার মধ্যে নীপাবউদির সেই স্নানের দৃশ্যের সঙ্গে ভারসাম্য রাখার জন্য একটা স্বর্গীয় দৃশ্য ওভাবেই ভেসে ওঠে? আমি জানি না। সুধু জানি যে সেই মুহুর্তটায় না পারলেও পরের দিনগুলােয় পেরেছিলাম। হাজার হুমকির মুখেও থানায় গেছি, কোর্টে গেছি, সাক্ষ্য দিয়েছি। রথীনদার খুনিরা ধরা পড়েছে শেষ অবধি। তার মধ্যে পার্টির শঙ্কর আর আক্রমও ছিল। রথীনদার সঙ্গে মুড়িমাখা খেতে খেতেই ওরা লােকটাকে খুনের প্ল্যান এঁটেছিল।
আমার ওদের চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতক মনে হল, একইসঙ্গে নিজেকেও। আমি যে রথীনদাকে অত ভালবাসতাম, আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি লােকটার সঙ্গে বিছানায় শুয়ে ঘুমের আগে নীপাবৌদির কথা ভেবে উত্তেজিত হয়ে উঠিনি কখনও সেই স্নান দেখার পর? আর উঠেছি যদি তাহলে রথীনদাকে খুন না করলেও, ওর বিশ্বাস ভাঙার দায় আমাকেও বয়ে বেড়াতেই হবে। বাকি জীবন।
নীপাবৌদি পাগল হয়ে যাবে আমি ভেবেছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে ওই বাস্তব-অবাস্তবের ভিতরে ঘুরে বেড়ানাে ভদ্রমহিলা বেশ শক্ত হাতেই নিয়ন্ত্রণ করলেন নিজেকে।
আমি বৌদির ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠলাম, যেমন রথীনদার ছিলাম। বাজার থেকে ব্যাঙ্ক যতটা পারতাম নিজের হাতে করে দিতাম। পার্টির কাজে একটু আধটু যােগ দিয়েছিল বৌদি, খানিকটা আমারই কথায়। আর সেই সূত্রে নীপাবৌদীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে দু-চারটে মুখরােচক গল্পও যে বাজারে ছড়াল না, তা নয়। কিন্তু রথীনদার না থাকাটাই এমন সেতুর মতাে বেঁধে দিয়েছিল আমাকে বৌদির সাথে যে ওসবে কিছু মনেই হল না। আর বৌদি তাে জাগতিক কিছুকে তেমন পাত্তাই দিত না।
রথীনদার খুনের মামলার রায় যেদিন বেরােল নিম্ন আদালতে, যাবজ্জীবন হল তিনজনের, তার দুদিন পরেই আমার উপর একটা মার্ডার অ্যাটেম্পট হয়। ভবেনের গলির মুখে দুটো নেশাডু গাঁজা খাচ্ছিল, ওদের চিৎকারেই পালিয়ে যায় সুপারি- কিলাররা নয়তাে আমার অবস্থাও রথীনদার মতােই হত। পরদিন বিরাট প্রতিবাদসভা ডাকা হয় স্থানীয় নাগরিক মঞ্চ থেকে। প্রচুর লােক হয়েছিল সেই সভায়। আমার পার্টিও। শামিল হয়েছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম পার্টির কারও কারও একটু অসুবিধে হতে শুরু করেছে আমায় নিয়ে। আমি ওই ‘লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে যাচ্ছি বলে।
অসুবিধে আমারও হচ্ছিল। কেউ কেউ ছাতার তলায় থাকতেই ভালবাসে। আমি তেমনই একটা লােক। এই যে এখন আমায় নিয়ে এত আলােচনা, এ আমার অসহ্য লাগছিল। শুধু কি ওই আলাে? বাড়িতে মায়ের কান্নাকাটি আর আমার নিজেরও শিরদাঁড়া দিয়ে বইতে থাকা ভয়ের চোরাস্রোতও কি গােপনে মারছিল না আমায়? একবার বেঁচে গেছি, পরেরবার যদি না বাঁচি?
তাই যখন কানে এল যে একপক্ষের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বেশিরভাগ পার্টিকর্মীই চাইছে আমায়, আসছে ভােটে দাঁড়ানাের জন্য, প্রমােদ গুনলাম। দুর্নীতির সঙ্গে সমঝােতা না করতে পারলে বেঘােরে খুন হয়ে যেতে হবে, এই বাজারে, তার চেয়ে দিদি- জামাইবাবু জামশেদপুরে ওদের কাছে চলে যেতে বলছে, কোন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি দেখে রেখেছে নাকি, হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলি কেন?
সাতপাঁচ ভেবে সেদিন নীপাবৌদীকে নিজের সিদ্ধান্তটা জানাব, ঠিক করলাম। প্রাণে বাঁচার তাগিদেই খুব বেশি রাত অবধি বাইরে থাকতাম না এখন, কিন্তু সেদিন নানান ঝামেলায় দেরি হয়ে গেল খানিকটা। রাত দশটা পেরিয়ে বৌদির বাড়ির দরজায় ঠেলা দিয়ে দেখলাম আগের মতােই ভেজানাে সেটা। খুব রাগ হয়ে গেল। এতবার বলেছি যে এখন আর আগের অবস্থা নেই, তবু কেন দরজা বন্ধ করে রাখে না?
ধাতনি দেব ভেবে ভিতরে ঢুকে ওই লম্বা বারান্দাটায় পা রাখতেই কানে এল, জলের শব্দ। স্নান করছে নীপাবৌদি। সেই, বারান্দা লাগােয়া কলতলায় বসে। স্বামীর চিতার আগুন স্ত্রীর সৌন্দর্যকে পুড়িয়ে দেয় না। দিলে আগেরবার যা দেখেছিলাম, এবারও তাই দেখতে পেতাম না। কিন্তু আগেরবার তাে পা কাঁপছিলো।
নীপা বৌদি, জানি না কীভাবে, আমার অস্তিত্ব টের পেল এবার। গায়ে জল ঢালতে ঢালতেই বলল, আমি খবর পেয়েছি। তােমার রথীনদার লড়াইয়ের জায়গা ছেড়ে তুমি পালিয়ে যেতে চাইছ? তােমার রথীনদা যে বলত, ‘কাপুরুষরাই পালিয়ে যায়, তুমি কি কাপুরুষ?
আমি কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রলািম। নীপাবৌদি কি জানে না, আমি কীসের থেকে পালিয়েছিলাম? কিন্তু সেই পালানাের ইচ্ছেটা সেই মুহুর্তে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। খালি মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সুন্দরতম ওই প্রত্যঙ্গ নীপা বৌদির বুক হিসেবে নয়, রথীনদার মিউজিয়াম হিসেবে বেঁচে আছে। আমার কাঁধে আমি যা ধারণ করতে পারি, নীপাবৌদি নিজের হৃদয়ে সেই ভার নিতে সক্ষম। একটুও যৌনতা জাগল না আমার, এতটুকু আকর্ষণ বােধ করলাম না, শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে যেমন হয়, অনেকটা শান্তি এল মনে।
পরদিন পার্টির রুদ্ধদ্বার মিটিঙে ‘ক্যান্ডিডেট’ হিসেবে আমার নামটা ঘােষণা হতেই আমি উঠে দাঁড়িয়ে মাইকটা চাইলাম। আর মাইকটা হাতে পাওয়ার আগের কয়েক সেকেন্ড জুড়ে অনুভব করলাম যে আমি সেই স্নানের ভিতর দিয়ে যা সমস্ত কলুষকে ধুইয়ে দেয়, মগের পর মগ জল ঢেলে।
রথীনের স্মৃতিরক্ষার জন্যই তােমাকে চাই। পার্টির এক শীর্ষনেতা বলে উঠলেন।
আমি মাইকটা হাতে নিয়ে বললাম, আমি যেমন কাজ করে আসছি, তেমনি কাজ করে যাব। কিন্তু রথীনদাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই আসনটা থেকে নীপাবৌদির জেতা দরকার। আপনারা প্লিজ আমার বদলে ওকে ক্যান্ডিডেট করুন।
ঘরে পিন পড়লেও শব্দ হবে, এমন নীরবতা নেমে এল। সেই নীরবতা ভেঙে একজন বলে উঠলেন, নীপা কি রাজি হবে? আমি মাইকটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম, বৌদিকে রাজি করানাের ভার আমার।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
এদেশে সোনাকে স্থিতি এবং ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...