রাস্তায় বেরিয়ে হিমি ভাবলাে, তাহলে আবার একটা বসন্তকাল চলে এলাে? ইংরিজি ক্যালেন্ডার ধরলে আজ-হিমি চট করে রিস্টওয়াচের ডেট কাউন্টারটা দেখে নিল- তেইশে ফেব্রুয়ারি। তার মানে কি ফাল্গুন মাস পড়ে গেছে? কে জানে। কিন্তু এইটুকু হিমি জানে যে, গতকাল অবধি সকালবেলার শরীরে একটা হালকা কুয়াশা জড়িয়ে থাকতাে। আজ সেটা নেই। বিউটিপার্লারের আয়নার মতন স্বচ্ছতায় ঝলমল করছে সল্টলেকের রাস্তাঘাট।
হাঁটতে হাঁটতে সে পেরিয়ে গেল দুটো ফুলের ভারে নুয়ে পড়া সজনেগাছ, বিশ্বাসকাকুদের বাড়ির কচিপাতায় ভরা। দেবদারু। ক্লাবঘরের পূর্বদিকে একটা পলাশগাছ আছে। হিমি রাস্তা থেকেই দেখতে পেল, গাছটার রােগা- রােগা। ডালপালায় কিশােরীর স্তনবৃন্তের মতন অজস্র ডীপ-ব্রাউন কুঁড়ি ফুটে উঠেছে। তাছাড়া আজকেই প্রথম, আক্ষরিক অর্থে সাতসকালে, একটা কোকিল গান গাইতে শুরু করেছে।
সন্দেহ নেই বসন্তকাল- বাংলা ক্যালেন্ডার যাই বলুক।
হিমির মনে পড়ল, অনেকদিন আগে এরকমই একটা সকালে যখন সে এই রাস্তা ধরেই হেঁটে যাচ্ছিল, তখন তার মােবাইলে সুপর্ণর মেসেজ ঢুকছিল-তুমি ভীষণ সুন্দর। কাল সারারাত তােমার কথা ভেবেছি।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্লকের মুখের রাস্তাটা অবধি পৌছতে না পৌছতেই হিমির মনে হল, ধুর বাবা, কার্ডিগানটা আজ গায়ে না দিলেই ভালাে হত। গরম লাগছে। কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকে কেমন করেই বা বুঝবে কোনটা পরা উচিৎ নয়। কাল অবধি তাে বেশ শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। তখন এই কার্ডিগানটা ওকে বাঁচিয়েছিল।
হিমি সােনারপুরের একটা গার্লস স্কুলে পড়ায়। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে স্কুলে পৌঁছতে হয়। বাড়ি থেকে বেরােয় ঠিক সাতটায়। রেসিডেন্সিয়াল ব্লক ছাড়িয়ে মেন- রােডে পৌঁছে একটা অটো ধরে করুণাময়ীর মােড় অবধি যায়। সেখান থেকে বাসে শিয়ালদা। শিয়ালদা থেকে আবার ট্রেন ধরে সােনারপুর। সকালবেলা বলেই দেড়ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়, ওই সময়টায় রাস্তাঘাট ফাকা থাকে।
এরমধ্যে প্রথম স্টেজটায় সবচেয়ে বিরক্তিকর-ওই ব্লকের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে অটো স্ট্যান্ড অবধি যাওয়া।
অনেকখানি হাঁটা। তবে আজ কষ্টটা গায়ে লাগছিল না। এই হঠাৎ বসন্তের টানে একদম অন্যমনা হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল হিমি। একেকদিন এরকম হয়। ভেঙে যাওয়া ভালােবাসার কথা খুব মনে পড়ে।
দু’বছর টিকে ছিল সুপর্ণর সঙ্গে তার রিলেশনশিপটা। বড্ড সুখে কেটেছিল সেই দুটো বছর। প্রত্যেকটা দিনকেই মনে হত স্বর্গ থেকে টুপ করে খসে পড়া, নীল রাংতায় মােড়া একটা সারপ্রাইজ গিফট।
সুপর্ণর জন্য হঠাই খুব মন কেমন করে উঠল হিমির। খুব সুন্দর ছিল সুপর্ণ। ছিল বলছে কেন? এখনও আছে। কদিন আগে ওর নতুন প্রেমিকার সঙ্গে মন্দারমনি গিয়েছিল। ফেসবুকে ছবি পােস্ট করেছে। হিমি দেখছে সেই ছবি।
সুপর্ণকে হিমি প্রথম দেখেছিল লেকটাউনে, জয়িতা বলে ওর এক বন্ধুর বিয়েতে। বিয়েবাড়ির ভিড় বাঁচিয়ে হিমি আর সম্পূর্ণ পাশাপাশি বসে অনেকক্ষণ গল্প করেছিল। পরদিনই ফোনে ওই মেসেজ। মেসেজটা পেয়ে হিমির মাথার মধ্যে গুনগুন করে উঠেছিল কেতকী কুসারী ডাইসনের একটা কবিতা। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হিমি আজকেও নিজের মনেই খুব আস্তে আস্তে উচ্চারণ করলাে:
‘মদের মতন পাগল করা ছেলে,
পদাবলীর সখার মতাে কালাে,
গত জন্মে স্বপ্নে, কিংবা সালে।
আমার সব দিয়ে বেসেছিলাম ভালাে।
হিমির বুক ভেঙে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলাে। এই কবিতাটাই যে সেদিনও ওর মনে পড়েছিল, সে কি এমনিই? কোনাে ইঙ্গিত ছিল না? বেসেছিলাম ভালাে…. বেসেছিলাম। এখন সব অতীত।
কাল রাত্তিরে মা হঠাই হিমির ঘরে ঢুকে এসেছিল। ও তখন বালিশে হেলান দিয়ে বসে ক্লাস সিক্সের মান্থলি ইভ্যালুয়েশনের খাতা দেখছিল। মায়ের মুখের দিকে না তাকিয়েও হিমি বুঝতে পারছিল, মা ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। এই নজরটাকে বড্ড ভয় পায় হিমি। সার্চ লাইটের মতন- মনের অন্ধিসন্ধি দেখে নেয়। একটু বাদে অবশ্য ও মায়ের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হল?
মা বলল, ভুলতে পারছিস না?
হিমি দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে ধরেছিল। কোনােরকমে বলেছিল, ওসব কিছু না। তুমি চিন্তা করে শরীর খারাপ কোরাে না। চেহারাটা কী করে রেখেছিস? মা ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে চিরুনিটা নিয়ে এসে ওর চুল আঁচড়াতে বসেছিল। আসলে মা ওকে ছুঁয়ে থাকতে চাইছিল।
ভুলতে পারছে না। সত্যিই ভুলতে পারছে না হিমি। কেমন করে ভুলবে? এত ভালাে ছিল সুপর্ণ। এত সুন্দর কথা বলত। যখন দেখা হওয়ার কথা তার আধঘন্টা আগে সবজায়গায় পৌঁছে যেত— সে নন্দন চত্ত্বর হােক কিম্বা গিরীশ মঞ্চ। হিমি যদি কখনাে রাগ দেখিয়ে বলত, কে তােমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে এত আগে থেকে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে, তখন একটু হেসে, ফিসফিস করে বলত, আমার কবিতাটা মনে নেই?
সত্যি, বেশ মজার একটা কবিতা বানিয়েছিল সুপর্ণ।।
ঢাকুরিয়ার ক্যাফে-কফি ডে তে বসে ও হঠাৎ একদিন বলেছিল, আমিও একটা কবিতা লিখেছি।
হিমি তাে প্রথমে অবাক, তারপরে উচ্ছসিত। সত্যি!
হিমির কবিতা ততদিনে এদিকে-ওদিকে অনেক জায়গায় বেরােতে শুরু করেছে। এক লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক অন্য লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করছেন- ভারি ভালাে লাগল কিন্নর পত্রিকায় আপনার চন্দ্রাহতা কবিতাটা। আমাদের আগামী সংখ্যার জন্য কয়েকটা কবিতা দিন না। সােজা কথায়, সেই তিন বছর আগেই তরুণ কবি হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়ছিল হেমন্তিকা রায়ের।
ওদিকে সুপর্ণ কবিতার কিছুই বােঝে না।।
তবু কোথাও বসার পর হিমি ওর হাতে তুলে দিত কোনাে পত্রিকায় ছাপা হিমির নিজের নতুন কবিতা। ও ভুরু কুঁচকে পড়তে শুরু করত। হিমি পাশে বসে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকত সুপর্ণর মুখের দিকে। ভাবত, খুঁজে পাবে কি ও, খুঁজে পাবে কি নিজেকে? ওই যে উত্তুরে হাওয়া আর তুলােবীজের উপমা, ওর মধ্যে কি ও আমাদের দেখতে পাবে?
পেত না অবশ্য। একটু বাদে বেজার মুখে ম্যাগাজিনটা ওর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে সুপর্ণ বলত, নাঃ। এ জীবনে আর কবিতা বােঝা হল না। আশ্লেষ’ মানে কী গাে?
জানতে হবে না তােমাকে। মুহুরি কোথাকার! ছদ্মকোপ ওর হাতে থেকে ম্যাগাজিন ছিনিয়ে নিত হিমি। মনে মনে অবশ্য ক্ষমাই করে দিত। কী করবে বেচারা? ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশােনা করে তারপর আইন পড়ে উকিল হয়েছে। বাড়িতেও সাহিত্য পড়ার চল নেই। বাংলা শব্দ শিখবে কোত্থেকে? এমনকি মুহুরি কথাটার মানে বুঝল কিনা সন্দেহ।
সেই সুপর্ণই সেদিন যখন গম্ভীরমুখে ঘােষণা করল- আমিও একটা কবিতা লিখেছি, সেদিন ও প্রায় চেয়ার থেকে উলটে পড়ে যাচ্ছিল। বলেছিল, সত্যি! দেখাও দেখাও।
ওর টিপিকাল মিচকে-টাইপের হাসিটা হেসে সুপর্ণ বলেছিল, দেখাবাে আবার কী? ছােট্ট কবিতা তাে। মুখস্থই আছে। শুনবে? শােনাে- হেমন্তিকা রায়কে/ দু চোখে হারায় কে?
হিমি চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করেছিল- ব্যাস?
আবার কী? হাসছ কেন, উত্তরটা জানাে তাে?
হিমি লুকিয়ে-লুকিয়ে টেবিলের কাঠটা ছুঁয়েছিল। টাচ উড। লােকজনের চোখ এড়িয়ে চট করে সুপর্ণর গালে নিজের গালটা একবার ঘষে দিয়ে বলেছিল, জানি।।
তারপর থেকে ওকে দেখা করার জায়গায় আগে থাকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই ও চাপা গলায় বলত, হেমন্তিকা রায়কে দু’চোখে হারায় কে?
কেমন যেন তাসের ঘরের মতন সবকিছু ধসে পড়তে শুরু করল। প্রথমে আস্তে, তারপর ঝড়ের বেগে। হিমি মাঝে মাঝে সুপর্ণর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে থাকলেও দেখা করতে পারত না। হয়তাে কোনাে কবিতা পাঠের আসরে ডাক পড়ত, কোনাে কবিতা পাঠের আসরে ডাক পড়ত, কোনাে বই প্রকাশের অনুষ্ঠান। সুপর্ণ প্রথমদিকে হিমির শরীরের অজুহাত দেখিয়ে ওকে বারণ করত। বলত, একেই ভাের থেকে সন্ধে অবধি চাকরির খাতিরে দৌড়ােদৌড়ি করছ। তার ওপরে সন্ধেগুলােও যদি এইভাবে ভূতের বেগার…
হিমি ওকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ভূতের বেগার নয়। এগুলাে আমার ভালাে লাগে। ভালােবেসে করি।
আর আমার সঙ্গে দেখা করতে ভালাে লাগে না?
হিমি উত্তর দেয়নি। ভারি অবাক হয়ে ভেবেছে, ও এরকম ভাবে কী করে?
হয়তাে সেটা ভুল হয়েছিল। হয়তাে পরিষ্কার করেই বলা উচিত ছিল, তােমার সঙ্গে কার তুলনা, সুপর্ণ? আমি তাে ঘুমের মধ্যেও বন-পাহাড় ভেঙে তােমার সঙ্গে দেখা করতে যাই। বলেনি কিছু। ভেবেছিল, ও বুঝে নিক। কেন বুঝবে না? কেনই বা সব কথা মুখে বলতে হবে?
হিমির ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে নানা বয়সের বন্ধু ছিলেন। নারী, পুরুষ, কিশাের, তরুণ, প্রৌঢ় সকলেই ছিলেন। হিমির কাছে তাদের একটাই পরিচয় ছিল। তারা কবি, হিমির শক্তিমান কবি। হিমি জানত, এরা তার যৌথ পরিবারের সদস্য। কিন্তু সুপর্ণ হিমির ফেসবুকের সমস্ত পােস্ট যে লক্ষ করত সেটা হিমি জানত না। জানলাে, যখন সুপর্ণ নাম ধরে ধরে তাদের। গালাগাল করা শুরু করল। ওটা তাে একটা শুড়া-মুখ দেখলেই মনে হয় কামুক। ওটা তাে গেঁইয়া, অশিক্ষিত। কেমন করে তুমি এদের সঙ্গে মেশাে?
অসহ্য হওয়ায় হিমি একদিন সুপর্ণকে খুব শান্তভাবে বলে দিল, আমি কাদের সঙ্গে মিশব সেটা তুমি আমাকে বলে দেবে না, ঠিক যেমন আমি তােমাকে বলে দেবাে না তুমি কাদের সঙ্গে মিশবে।
ততদিনে হিমি বুঝতে পেরে গেছে, সুপর্ণর ভালােবাসার মধ্যে একটা সর্বগ্রাসী ব্যাপার রয়েছে। সুপর্ণর সঙ্গে জীবন জুড়লে তাকে শুধু সুপর্ণর প্রেমিকা হয়েই বাঁচতে হবে, অন্য কিছু নয়।
এরপরেই ওদের সম্পর্কটা ভেঙে গেল। সুপর্ণ হালকা হাতে প্যাচ আপের চেষ্টা করেছিল। হিমিও। কিন্তু তাতে কিছু হল না।
কাল যখন মা ওর চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল, তখন হিমি মনে-মনে মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল।।
মা জিজ্ঞেস করেছিল, ভুলতে পারছিস না? হিমি মনে মনে বলেছিল, কেমন করে ভুলব মা? মনে হয় সমস্ত কলকাতাটাকেই যেন স্মৃতিচিহ্ন করে রেখে গেছে সুপর্ণ। যে-কোনাে রাস্তা দিয়ে গেলে মনে পড়ে, কবে কখন ওর সঙ্গে। হেঁটেছিলাম সেই রাস্তায়। বাইপাসের ধারে ছাতিমগাছে ফুল দেখলে মনে পড়ে, গত দুবছর ওকে ছাতিমের গন্ধ চিনিয়েছি। ও আমাকে চিনিয়েছিল সাউথ ক্যালকাটার নির্জন সব রাস্তায় লুকিয়ে থাকা টি-বুটিক আর কফিশপ- যেখানে এসি মেশিনের ফিসফিসানির সঙ্গে পর্দা মিলিয়ে নিজেরাও ফিসফিস করে অনর্গল কথা বলা যায়।
সব থেকে কষ্ট হয়, জানাে মা, এই সল্টলেকের রাস্তায় হাঁটলে। শনিবার শনিবার আমার স্কুল ছুটি হত তাড়াতাড়ি, এদিকে ওর কোর্টে যাওয়ার ব্যস্ততা থাকত না। ও লেকটাউন থেকে ফুটব্রিজ পেরিয়ে চলে আসত চার নম্বর ট্যাঙ্ক। সেখান থেকে আমাদের হাঁটা শুরু হত৷ যেদিকে দু’চোখ যায়। তাই এখানকার প্রত্যেকটা রাস্তা, প্রত্যেকটা আইল্যান্ড আর পার্ক আমাদের কোনাে না কোনাে কথা, হঠাৎ চুমু কিম্বা চোখের জল ধরে রেখেছে। পালাবাে কোথায়? শুধু… জানাে মা…
এইখানে হিমি সত্যিই ঘাড় ফিড়িয়ে মা- এর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। মা চুল আঁচড়ানাে থামিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কীরে, লাগলাে নাকি?
উঁহু। হিমি আবার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মনে-মনেই বলেছিল— শুধু সেন্ট্রাল পার্কের সােনালি পলাশটা ওকে দ্যাখানাে হল। বিশ্বাসই করত না লাল ছাড়া অন্য কোনাে রঙের পলাশ ফোটে। গতবছর বইমেলার সময়, মেলা থেকে বেরিয়ে, একবার ঢুকে পড়েছিলাম সেন্ট্রাল পার্কে। কিন্তু তখন তাে সবে ফেব্রুয়ারির শুরু। গাছটায় তখনাে ফুলটুল কিছু আসেনি।
ভেবেছিলাম এ বছর দ্যাখাবাে।
সেটাই বা কী করে ভুলবাে বলাে।
মায়ের সঙ্গে ওই পুরাে সময়টা মনে মনে কথা বলেও হিমি শেষরক্ষা করতে পারেনি। শেষ ভাবনাটা অস্ফুটস্বরে বলে । ফেলেছিল— কী করে ভুলবাে বলাে?’ মা সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে চিরুনি ফেলে দিয়ে দু-হাতে ওর মাথাটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিল।
আজ সকালে এইসব সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতে খুব অল্প একটু রাস্তাই পেরিয়েছিল হিমি। ওর পা চলছিল না, কেমন একটা আলসেমি পেয়ে বসছিল। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছিল না, বাড়ি ফিরতেও না। এমন সব সময়েই মানুষ বুঝতে পারে, যদিও পৃথিবীটা বিশাল আর বাস-ট্রাম- ট্রেন- প্লেন এমনকি জাহাজও অনেক, তবু তার যাবার জায়গা খুব কম।
ঠিক তখনই জড়ানাে গলায় ওকে বিশুকাকা ডাকলাে- খুকুমনি।
বিশুকাকা প্রায় রােজই ওইভাবে ওকে ডাকে। ও কোনােদিনই সাড়া দেয় না। পাশ কাটিয়ে হনহন করে চলে যায়। এইখানটাতেই রােজ বিশুকাকার রিক্সা দাঁড়িয়ে থাকে, এই মেন রােডে ওঠার বেশ কিছুটা আগে, প্রফুল্লচন্দ্র স্কুলের পাঁচিলের গায়ে। ছােটবেলায় বিশুকাকার এই রিক্সায় চেপে স্কুলে যেত হিমি। শুধু ছােটবেলাতেই বা কেন? ইলেভেন টুয়েলভে পড়ার সময়েও এদিকে ওদিকে ট্যুইশন পড়তে গিয়েছে ওই রিক্সায় চড়ে।
পাঁচ-ছ বছর আগের কথা সেসব। তখনও বিশুকাকা বুড়ােই ছিল, এতটা না হলেও বেশ বুড়াে। সেইজন্যেই বােধহয় বড় রিক্সাস্ট্যান্ডে না দাঁড়িয়ে এইখানটায় দাঁড়িয়ে থাকতাে— পাড়ার অনেকটা ভেতরে ঢুকে যেখানে ছেলে- ছােকরাদের সঙ্গে কম্পিটিশন কম। সেটাই সুবিধে হয়েছিল হিমির। তাকে বেশি হাঁটতে হত না। বাড়ি থেকে একটু এগিয়ে এসেই বিশুকাকার রিক্সায় চেপে বসত। তারপর কোনােদিন চলে যেত ফাল্গুনী হাউসিং, কোনােদিন কাঠগােলা, কোনােদিন চারনম্বর ট্যাঙ্ক। যেদিন যেখানে পড়া থাকতাে।
মা ফোন করতাে— পৌঁছেছিস? কীভাবে গেলি? বিশুর রিক্সা পেয়েছিলিস? যাক।
হিমি বুঝতে পারত, বিশুকাকার ওপরে মারও অগাধ ভরসা। ভাড়া নিয়ে ঝামেলা হবে না। টিউটরের বাড়িতে না ঢােকা অবধি রিক্সা দাঁড় করিয়ে রেখে নজর রাখবে খুকুমনির ওপরে।
হিমি যখন টুয়েলভে পড়ে, তখন দমদম পার্কে গায়ত্রী ম্যাডামের বাড়ি অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে যেত। ফিরতে ফিরতে একেকদিন রাত সাড়ে নটা দশটা বেজে যেত। শীতকালে সল্টলেকে সাড়ে ন’টা দশটা মানে অনেক রাত। অটো স্ট্যান্ড থেকে ওদের বাড়ি অবধি পুরাে রাস্তাটাই নিঃঝুম হয়ে থাকতাে। তারমধ্যে এখানে-ওখানে মাতাল আর বেশ্যাদের স্মলিত গান, খিলখিল হাসি। যে কোনাে পথচারীকে দেখলেই তাড়া করে আসতাে একপাল কুকুর। তখন আর রিক্সাও পাওয়া যেত। একলা পায়ে হেঁটে ওই অন্ধকার রাস্তা দিয়ে আসতে হবে ভেবেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত হিমি।
তবে সে মাত্র প্রথম কটা দিন। হঠাৎই সে দেখতে পেল, বিশুকাকা রিক্সা নিয়ে অটোস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে শুরু করেছে। যত রাতই হােক, ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর বিশুকাকা রিক্সা নিয়ে নয়াপট্টি না দত্তাবাদ কোথায় যেন ওর বাড়িতে ফিরত। ওকে মা কিম্বা বাবা কেউ ওই দায়িত্ব দেয়নি কিন্তু। ও নিজেই হিমিকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল।
কলেজে ওঠার পর থেকেই রিক্সায় চাপার প্রয়ােজন ফুরিয়ে গেল। তখনও বিশুকাকা এই প্রফুল্লচন্দ্র স্কুলের পাঁচিলের গায়ে রিক্সা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতাে। কখনাে কখনাে প্রায়- ছুটন্ত হিমিকে পেছনদিক থেকে ডাক দিত খুকুমণি, কেমন আছাে?
দাদা বৌদি ভালাে আছেন?
হিমি দায়সারা মাথা নেড়ে চলে যেত। ঠিক কখন যে বিশুকাকা এতটা বুড়াে আর অথর্ব হয়ে গেল হিমি খেয়াল করেনি। কখন যে ওর রিক্সাটা বহুদিন ধরে সমুদ্রে ভেসে চলা একটা ভেলার মতন বিবর্ণ আর নড়বড়ে হয়ে গেছে তাও না। যখন থেকে মােটরাইজড রিক্সাগুলাে রাস্তার দখল নিল তখন থেকেই কি? তাই হবে।।
ওই ব্যাটারিতে চলা রিক্সাগুলাে দারুণ দৌড়য়। ভাড়া একই। কে সাধ করে বুড়াে রিক্সাওলার ভাঙা রিক্সায় চাপবে, যখন। একটু অপেক্ষা করলেই সামনে ব্রেক কষে দাঁড়অবে পক্ষীরাজ। সকলেই তাে কম সময়ে কোথাও না কোথাও পৌছতে চায়, তাই না?
চায় কি? সকলেই কি চায়? সবসময়ে চায়? কই, আজ এমুিহুর্তে হিমি তাে চাইছে না।
হিমি রিক্সাটাকে পেরিয়ে দু-এক কদম চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে এলাে।
বিশুকাকা তাে একটু আগে ওকে ডেকেছিল। নাকি ও ভুল শুনেছিল? লােকটা তাে ভাঙা পাদানির ওপর কুঁকড়ে-মুকড়ে
বসে ঘুমােচ্ছে।
এখন রােদুর অপারেশন থিয়েটারের আলাের মতন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেই আলােয় হিমি দেখতে পেল, বিশুকাকার ঠোটের ওপরে একটা নীলমাছি বসেছে। তাছাড়া হিমি বাসি মদের গা- গােলানাে গন্ধও টের পেল। ও এক পা দু পা করে পিছিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক তখনই বিশুকাকা ঠোট থেকে স্তন ছেড়ে গেলে একটা বাচ্চা যেভাবে চমকে জেগে ওঠে, সেইভাবে জেগে উঠেই ধড়মড় করে রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ালাে। রিক্সার হ্যান্ডেলের ওপরে প্রণামের ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল, ওঠো খুকুমণি। কোথায় যাবে, কাঠগােলা?
শান্তি। একটা শান্তি জড়িয়ে ধরলাে হিমিকে। স্কুলের বাগানের আমগাছটায় ঝেপে বউল এসেছে। সেই বউলের গন্ধে বাসি মদের গন্ধ ওর নাক থেকে মুছে গেল। ও পরিষ্কার শুনতে পেল, সজনেফুলের থােকার মধ্যে ভােমরার পাখার বোঁ বোঁ শব্দ। হিমি পাদানির গর্তে যাতে পায়ের পাতা ঢুকে না যায় এমন সাবধানে বিশুকাকার রিক্সার সিটে উঠে বসল। বলল, কাঠগােলা না। সেন্ট্রাল পার্কে যাবাে। তুমি চালাতে পারবে তাে?
বিশুকাকা ঘােড়ায় চড়ার মতন করে অতিকষ্টে ড্রাইভারের সিটে উঠে বসে বলল, কেন পারবাে না? পারিনি কবে? শুধু রাস্তাটা একটু বলে দিও। চোখে ভালাে দেখি না।
তারপর ধীরে… খুব ধীরে বিশুকাকা সেন্ট্রাল পার্কের ঠিক উল্টোদিকের রাস্তা বরাবর রিক্সা চালাতে শুরু করল। হিমি কিছু বলল না। তার কোরাে তাড়া ছিল না। আগের বছরে ঠিক এমনি একটা দিনেই সে সুপর্ণকে সেন্ট্রাল পার্কে সােনালি পলাশ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। সেবছর তখনাে পলাশ ফোটেনি।
হিমি বুঝতে পেরেছিল, যদি বিশুকাকা বেঁচে থাকে, যদি একদিন দুদিন, তিনদিন ধরে চলতে চলতে কখনাে ওরা সেই গাছটার নিচে পৌঁছতে পারে, তাহলে ঠিক তখনই ফুটে উঠবে থােকা থােকা সােনালি পলাশ।
তবে সুপর্ণকে আর কোনােদিন হিমি সেই ফুল দেখাতে পারবে না।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
এদেশে সোনাকে স্থিতি এবং ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...