jamdani

সহধর্মিণী

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

সহধর্মিণী শব্দটি আমাদের কানে প্রায়ই আসে। তেমন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়ােজন বােধ করি না। বিশুদ্ধ বাংলায় বউকে বলা হয় সহধর্মিণী। একটু সম্মানিত করা। ধর্ম শব্দটি থাকলেও বউ-এর ধর্ম যা, তাই থাকে। খুব একটা পরিবর্তন হয় না। কিন্তু এই শব্দটিকে জীবন্ত করে রেখে গেছেন মা সারদা। বিদ্যুৎ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন। কথাটা সেদিন তার মুখ থেকে বেরিয়েছিল বিদ্যুৎরেখার মতাে। আকাশের গায়ে যেমন বিদ্যুৎ চিরে যায়। শ্রীমা রয়েছেন দক্ষিনেশ্বর কালীবাড়ির নহবতে। ১৮৭২ সালের মার্চ মাস। তার বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। প্রথম আসা। ঠাকুর একদিন একান্তে জিজ্ঞেস করলেন, “কি গাে, তুমি কি আমায় সংসারপথে টেনে নিতে এসেছ?’ শ্রীমা সামান্যতম ইতস্তত না করে ঝটিতে উত্তর দিলেন, ‘না, আমি তােমাকে সংসারপথে টানতে যাব কেন? তােমার ইষ্টপথেই সাহায্য করতে এসেছি। আমি তােমার সহধর্মিণী। সেইদিন এই শব্দটিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে দিলেন মা সারদা, দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর মন্দিরে।
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে ভক্তের পরিষ্কার স্পষ্ট প্রার্থনা- ‘ভার্যাং মনােরমাহ দেহি মনােবৃত্ত্যনুসারিণীম’- হে দেবী, আমার মনােবৃত্তির অনুসারিণী অর্থাৎ অনুকূল আচরণকারিণী মনােরমা ভার্যা দাও।’ এই ভার্যা শব্দটির আবার দ্বিবিধ ব্যাখ্যা। ভরণীয়া অর্থাৎ ভার্যা, অথবা ভক্তি।
পরিবার-সংসার-স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের চিন্তার বিষয় ছিল। এটি আমাদের ধর্মেরও বিষয়। সব মহাপুরুষই এর ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। বেদ-উপনিষদ-পুরাণ সর্বত্রই এই বিষয়ে নানা কথা আছে। স্বামী স্ত্রী অদ্ভুত একটি সম্পর্ক। পূর্ণতার প্রতীক। সংসার এক মন্দির। জীবন এক জীবন্ত পূজা। সমস্ত ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে আছে শক্তি তত্ত্বের ওপর। সবই মায়া। এ কথাটা সহজে বােঝা যাবে না। ব্যস্ত জগতের অত সময়ও নেই। তবে শুনে রাখা ভালাে। পরে কাজে লাগতে পারে। আদ্যাশক্তি মহামায়া। এই দৃশ্যজগৎ তার অধীনে। জগৎকে। মুগ্ধ করে সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় করছেন। সেই মহামায়া দ্বার ছেড়ে দিলে তবে অন্দরে যাওয়া যায়। বাহিরে পড়ে থাকলে বাহিরের জিনিস কেবল দেখা যায়, সেই নিত্য সচ্চিদানন্দ পুরুষকে জানতে পারা যায় না। তাই চণ্ডীতে মধুকৈটভ বধের সময় ব্রহ্মাদি দেবতারা মহামায়ার স্তব করছেন-
ত্বং স্বাহা ত্বং ত্বধা ত্বং হি বষটকারঃ ত্বরাত্মিকা।
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।।

আপনি স্বাহা, আপনিই স্পর্ধা, আপনিই দেব-আহ্বানের বটমন্ত্র, আপনিই অমৃতরূপা অ উ ম, অর্থাৎ প্রণব ওঁকার।
ঠাকুর নারীকে অভাবনীয় সম্মানের আসনে বসিয়ে গেছেন। বলছেন, মেয়েরা এক একটি শক্তির রূপ। পশ্চিমে বিবাহের সময় বরের হাতে ছুরি থাকে, বাংলাদেশে জাঁতি থাকে, অর্থাৎ ওই শক্তিরূপা কন্যার সাহায্যে বর মায়াপাশ ছেদন করবে। এটি বীরভাব। কন্যা শক্তিরূপা।। বিবাহের সময় দেখনি বর বােকাটি পেছনে বসে থাকে, কন্যা কিন্তু নিঃশঙ্ক।
‘সহধর্মিণী’ বলা কোনও ব্যাপার নয়। বলে দিলেই হল। অনেক কথার একটি কথা। ভাবনায় আনা খুবই কঠিন। ঠাকুর বারে বারে চণ্ডীর বিশেষ একটি শ্লোকের প্রতি আমাদের দৃষ্টি দিতে বলছেন, নিজের অর্থাৎ পুরুষদের চিন্তাভাবনাকে সেই অনুসারী করতে বলছেন। ‘মাইন্ডসেট’! | শ্লোকটি অতি সুন্দর-
বিদ্যাঃ সমস্তাম্বব দেবি ভেদাঃ
স্ক্রিয়ং সমস্তাং সকলা জগৎসু।
ত্বয়ৈকয়া পুরিতমমবরৈতৎ
দেবি, বেদাদি অষ্টাদশবিদ্যা আপনার অংশ। চতুঃষষ্টি কলাযুক্তা এবং পতিব্ৰত্য, সৌন্দর্য তারুণ্যাদি গুণান্বিতা।
সকল নারীই আপনার বিগ্রহ। আপনি জননীরূপা এবং একাকিনীই এই জগতের অন্তরে ও বাহিরে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন।
শক্তি জগতের মূলাধার। এই আদ্যাশক্তির ভেতর ‘বিদ্যা’ ও ‘অবিদ্যা’দুইই আছে। অবিদ্যা’ কী? যা শুধুই মুগ্ধ করে, অর্থাৎ কামিনী-কাঞ্চন।। মােহ বিস্তার করে জীবনকে আচ্ছন্ন করে। মােহাচ্ছন্ন। ভােগের দিকে টেনে নিয়ে যায়। কিছুকাল নাচিয়ে আবর্জনার মতাে পরিত্যাগ করে। এই অবিদ্যা মায়া ভয়ঙ্করী। অতি নির্দয়। আর ‘বিদ্যা’ মায়া কেমন? ভক্তি-দয়া-জ্ঞান-প্রেম ভগবানের দিকে নিয়ে যায়।
এখন কথা হল, পুরুষ বলছে, “আমার সহধর্মিণী।ভালাে কথা। তা তুমি পুরুষটি কেমন? মদ্যপ, জুয়াড়ি, ফেরেববাজ, নির্যাতনকারী। তাহলে কি এইরকম, ব্যাধের স্ত্রী ব্যাধিনী, ডাকাতের স্ত্রী ডাকাতিনী। ওই যে বলা হয়েছে সহধর্মিণী। আবার একটি প্রবাদ আছে- ‘যেমন দ্যাবা, তেমনই দেবী। আমি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথাই বারে বারে বলব, তার কারণ, তিনি ভূমির কথা বিশেষ রূপে ভেবেছেন। সেই ভূমির নাম ‘মানবজমিন’। হলকর্ষণ করছেন দুজন— পিতা ও মাতা। উপনিষদ বলছেন- পিতৃদেবাে ভব, মাতৃদেবাে ভব। ঠাকুর সকলের পরিবারের খবর নিচ্ছেন। স্ত্রীই তাে পরিবার। তিনিই তাে সংসার, গৃহ, সুরক্ষা, ছায়াতরু, সন্তানের জননী, পালিকা, বার্তা, সংস্কার, সংস্কৃতি। চণ্ডিকাদেবী যেমন বলছেন,

একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।
পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো মদূরিভূতয়ঃ।।
একমাত্র আমিই এই জগতে বিরাজিতা। আমার অতিরিক্ত অন্য আর কে আছে। ব্রহ্মাণী প্রমুখ সব দেবীই আমার বিভূতি, শক্তি। সব আমাতেই বিলীন।
দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে দ্বিতীয়বার দর্শনের দিনে, ঠাকুর শ্রীমকে প্রশ্ন করছেন, ‘আচ্ছা, তােমার পরিবার কেমন ? বিদ্যাশক্তি না অবিদ্যাশক্তি? শ্ৰীম বললেন, “আজ্ঞে ভাল, কিন্তু অজ্ঞান।
ঠাকুর ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আর তুমি জ্ঞানী!
ঠাকুরকে সারদা বললেন, “আমি তােমার সহধর্মিণী। সে কি শুধু কথার কথা! না, ঠাকুর বলছেন, ‘ও যদি এত ভাল না হতাে, আত্মহারা হয়ে আমাকে আক্রমণ করত, তাহলে আমার সংযমের বাঁধ ভেঙে দেহবুদ্ধি আসত কিনা কে বলতে পারে?
সহধর্মিণী প্রকৃতই পতির ধর্মানুসারিণী, পবিত্রতার প্রতিমূর্তি। তাহলে? চরম একটি উদাহরণ তিনি জগৎসমক্ষে স্থাপন করবেন। সেটি হল নারীর মধ্যে দেবীত্বের উদ্বোধন। তিনি তার সহধর্মিণীকে দেবীরূপে পূজা করবেন। ফলহারিণী কালীপূজার দিন তিনি তাঁর সহধর্মিণী সারদাকে ষােড়শীরূপে পূজা করলেন। তন্দ্রে এই দেবী হলেন শ্রীবিদ্যা বা ত্রিপুরাসুন্দরী। সম্পূর্ণ বিধিমতে পূজার আসনে বসিয়ে পূজা। পূজক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি প্রার্থনা করেছিলেন, ‘সর্বশক্তির অধীশ্বরী মা ত্রিপুরাসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর, এঁর (শ্রীমায়ের) শরীর মনকে পবিত্র করে এই আধারে আবিভূর্তা হয়ে সর্বকল্যাণ সাধন কর মা। অবশেষে এই জাগ্রত জীবন্ত দেবীকে আত্মনিবেদন করে দিলেন, নিজের সমস্ত সাধনার ফল। এমনকি জপের মালাটি পর্যন্ত সমর্পণ করে দিয়ে প্রণাম করে বললেন, “হে সর্বমঙ্গলের মঙ্গলস্বরূপে, সর্বকর্মনিষ্পন্নকারিণী, শরণদায়িনী, ত্রিনয়নী, শিবগেহিনি গৌরী, হে নারায়ণী, তােমাকে প্রণাম।
এই হল সহধর্মিণীর প্রকৃত রূপ। প্রথমে সমর্পণ, পরে সমানে সমান। তারপর যুগলে পথ চলা। তারপর সমুখে শান্তি পারাবার। অন্ধকারে আচ্ছন্ন বর্তমান জগতে এসব চলে না। চলবে না, চলতে দেওয়া উচিত নয়। এখন সহধর্মিণী নয়, বিপরীত ধর্মিণী। জরা সামালকে, শিসা না টুট যায়!

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes