jamdani

লিপস্টিক বড় বিপজ্জনক

প্রচেত গুপ্ত

লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং বদলের প্রতীক। আকৃতি বদলের প্রতীক। আসলকে ঢেকে ‘নকল’ তৈরির প্রতীক। লিপস্টিক মাখা ঠোঁট শুধু ঠোঁটের নয়, ঠোঁট লিপস্টিকেরও। এই ঠোঁট দেখে যদি কোনও নারী হিংসে করে, মনে রাখতে হবে, সে ঠোঁটকে করছে না, লিপস্টিককে করছে। কোনও পুরুষের যদি মন উচাটন হয় এবং মনে মনে চুম্বন করে তাহলে মনে রাখতে হবে, সেই পুরুষ শুধু ঠোঁটকে চুম্বন করছে না, লিপস্টিককেও করছে। কোনও লিপস্টিক কোম্পানি চাইলে এই মর্মে বিজ্ঞাপনও বানাতে পারে। ছবিতে দেখানাে হবে, এক সুপুরুষ লিপস্টিক রাঙা কোনও নারী ঠোঁটে গভীর আশ্লেষে চুমু খাচ্ছে। নীচে থাকবে আঁকা ছবি। সেই ছবিতে লিপস্টিক হাসছে। পাশে ক্যাপশান। ওরে বােকা মেয়ে, ওই চুমুর বেশিটাই তাে আমার। লিপস্টিক আমার কাছে যেমন প্রতীকের, তেমন বিপদেরও।

শুধু লিপস্টিক নয়, রং বদলানাের যে কোনও জিনিসই আমার চোখে বিপজ্জনক। আসল চেহারা লুকিয়ে নকল চেহারা তৈরির পক্ষে আমি নই। চারপাশে নকলই বেশি। সে ঠোটই হােক, আর মানুষই হােক। সবাই নিজেকে নানা ভাবে লুকোতে চাইছে, আড়াল করতে চাইছে। কেউ ঠোঁটে চাইছে, কেউ ঠোঁট থেকে বেরােনাে কথায় চাইছে। অরিজিনাল ‘আমি’ কে চাপা দেওয়ার জন্য আকুলিবিকুলি চলছে। খালি ভয় ‘আসল আমাকে বাইরের মানুষ যেন চিনে না ফেলে। তাই নকল সাজার হিড়িক। ওই যে গান আছে না? ‘মুখে রং মেখে আর মুখােশ পরে পরি যে পরচুলাে/ আমরা যা নই তা সেজে, সবার চোখে যে দিই ধুলাে। একেবারে সে রকম। চারপাশে শুধু রং মাখা আর মুখােশ পরবার খেলা। খেলা না বলে যুদ্ধ বলাই ভালাে। বদ নেতারা হাত কচলে ভােট চায়। নিজের আসল রূপ লুকিয়ে রাখে। ভােট ফুরােলে ওই হাতেই চড় মারে। ঠগবাজরা কথায় রং মাখিয়ে লােক ঠকায়। অপকারীরা উপকারীর ছদ্মবেশে। চারপাশে ঘুরঘুর করছে। কেউ সামনে বন্ধুর রঙে সেজে পেছনে মারছে ছুরি। টিভিতে কথার রং সাজিয়ে যে মহিলা-পুরুষ বধূ হত্যার নিন্দা করে, তারাই। বাড়িতে পুত্রবধূ পেটায়। আবার যে পুত্রবধূ পরচুলােতে দয়াময়ী সাজে, শাশুড়ি খেতে চাইলে সে-ই চুল ধরে ঝাঁকানি দেয়। বড্ড নােলা হয়েছে না? এই রং। মাখা আর রং তােলা দেখতে দেখতে সিটিয়ে আছি। ভালাে, সুন্দর কিছু দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। নকল নয় তাে? আমার এই মত শুনে অনেকে ভাবতে পারেন, আমি বােধহয় সাজগােজের বিরুদ্ধে। মােটেও তা নয়। সাজুগুজু মেয়েদের ইনস্টিংক্ট। জন্মগত অধিকার। মেয়েদের সাজগােজ যেমন দেখতে ভালাে লাগে, তেমন সাজগােজ করতেও মেয়েরা ভালােবাসে। অতি সুন্দর অভ্যেস। তবে তা নিজের রূপকে আরও বাড়িয়ে তােলবার জন্য হলেই ভালাে। কালাে রং-কে ফসা দেখানাের জন্য যারা রঙের আশ্রয় নেয়, তারা মূখ। হ্যা, আবার বলছি তারা মূখ। আড়ালে তাদের নিয়ে হাসাহাসি হয়। যে কালাে মেয়ে তার কালাে রং-কে আরও সুন্দর করে সবার সামনে উপস্থিত হয়, সে সবার নজর কাড়ে। থ্যাবড়া, ফাটা, বর্ণহীন ঠোটের স্বাস্থ্যরক্ষা করা অবশ্যই উচিত, কিন্তু নিজের আসল ঠোটকে হীনমন্য করে নয়। আবার বলছি, লিপস্টিকে আপত্তি নেই। আপত্তি লিপস্টিকের ক্রেডিট নিয়ে নিজেকে সুন্দরী’ ভাববার। সাজগােজ করে পুরুষ-নারী কেউ যদি বলে, আমি কেমন সেজেছি দেখ— শুনতে মধুর লাগে। কেউ যদি বলে ‘আমি কত সুন্দরী দেখ’– হাস্যকর লাগে। আরে, তুই নিজেই তাে সুন্দর। তাের মতাে সুন্দর। সেই সুন্দরকে তুই অপমান করিস কোন মুখে? একটি মেয়ে যখন বান্ধবী হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে প্রিয়জনের ঘনিষ্ঠ হয় তখন তার ঠোট লিপস্টিকে রাঙা হয়ে কোনও লাভ হয় না। ভালােবাসায় রাঙা হতে হয়। প্রিয়জনের কাছে সেই ঠোট তখন পৃথিবীর সেরা ঠোট। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

লিপস্টিকের ইতিহাসে এবার একটু উঁকি মারি। অনেক বিরুদ্ধে বললাম, মেয়েরা নিশ্চই রাগ করবে, এবার একটু পক্ষে বলি। তার আগে বলে রাখি লিপস্টিকের ঐতিহাসিক জ্ঞান বাড়াতে আমাকে সাহায্য করেছেন আমার বন্ধু, গবেষক দেবাশিস মুখােপাধ্যায় মহাশয়।

লিপস্টিক আজকের ব্যাপার নয়। নারীকুলে অনেকদিন ধরে এই চমৎকার প্রসাধনটির চল রয়েছে। বাৎসায়নের কামসূত্র’র কথা সবাই জানি। প্রাচীনকালের রূপচচা নিয়ে সেখানে হরেক কথা আছে। রমণীরা নানা ধরনের প্রসাধনে মেতে থাকতেন। স্নান আর অঙ্গমির্জনা বিখ্যাত ৬৪ কলার মধ্যে। পড়ে। নারী নিজেকে ‘অপরূপা’ করতে চেয়েছে যুগ যুগ ধরে। কত বছর আগের কথা সেসব! তখন থেকেই লিপস্টিক হাজির। স্নান আর অঙ্গমির্জনার পর নারী অধর রঞ্জিত করতে ব্যবহার করত লাক্ষাবর্ণের অলক্তক। লাক্ষার রস দিয়ে এই রং তৈরি হত। রাঙা অধর নিয়ে পুরুষের সামনে যখন তারা উপস্থিত হত, পুরুষ মন উথালপাতাল করে উঠত। রাঙা ঠোটের মুচকি হাসি তিরের মতাে বুকে এসে বিধত। বড়বড় বীর পুঙ্গবেরা এই তিরের গায়ে মূছা যেত। এরপর এল পানপাতার রস। সেই রসে ঠোঁট রাঙানাে অতি পরিচিত এক প্রসাধন ছিল। জনপ্রিয়ও। রাঙা ভেজা ঠোঁটে হাতছানি থাকত। নারীকে পেতে একটা সময় পুরুষকে বল প্রয়ােগ করতে হয়েছে, নারীও তেমন পুরুষকে পেতে অধরকে রঙিন করেছে। নিজে যে কামনার কথা বলতে লজ্জা পেয়েছে, ঠোটের প্রসাধন সেই কথা বলেছে অস্ফুটে। পুরুষের শত প্রতিরােধ ভেঙে পড়েছে হুড়মুড়িয়ে। নারীকে ছলাকলার এই সাজ প্রথম কে শেখাল? ইতিহাস বলছে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেই শুরু হয়েছে। প্রাচীন সুমেরিয়ানরা প্রথম ঠোট লাল করতে শুরু করে। রঙিন পাথর গুড়াে করে জলে গুলে রং তৈরি করে তারা। সেই ঠোট স্পর্শ করা মানে তাে পাহাড় পেরিয়ে প্রেম!

শােনা যায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ক্লিওপেট্রা নাকি পােকার রক্তে ঠোট রাঙাতেন। হায় রে! ষােলােশাে শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে প্রথম এলিজাবেথ মােম আর গাছের পাতা দিয়ে লিপস্টিক বানাতেন। শুধুমাত্র অভিজাত বংশের মেয়েরাই এই রং ব্যবহার করবার অধিকারী ছিলেন।

অতএব হে নারীকুল, আমার মতাে সামান্য লেখকের বিরূপ মন্তব্যে ভেঙে পড়বার কোনও কারণ নেই। লিপস্টিক কোনও হেলাফেলার বিষয় নয়। তার রয়েছে উজ্জ্বল ইতিহাস। যা অসুন্দরকে সুন্দর করেছে। সুন্দরকে করেছে আরও সুন্দর। আমার প্রশ্ন একটাই। ঠোটের রং কি মনের অসুন্দরকে দূর করতে পারে? যার মন বিবর্ণ সে কি লিপস্টিক মেখে সুখী হবে? এমন লিপস্টিক কি কখনও আবিস্কার হবে, যা ঠোটের কথাকে সুন্দর করবে ?

আশা করব, নিশ্চই একদি হবে। লেখা শেষ করি একটা গল্প বলে। লিপস্টিক নিয়ে বিপজ্জনক গল্প।

আমার বন্ধু অপূর্ব একদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরল রাত করে। বউ তাে রেগে আগুন। কোনওরকমে এটা-সেটা বলে, জামা খুলে অপূর্ব গেল বাথরুমে।। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে যদি খেতে বসা যায়। বউয়ের রাগ তাতে খানিকটা কমবে নিশ্চয়ই। বাথরুমে স্নান করতে করতে অপূর্ব গানও ধরল গুনগুনিয়ে।‘না না, ভুল কোরাে না, ভুল কোরাে না, ভুল কোরাে না ভালােবাসায়। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান। গান শুনে বউয়ের রাগ কি কমবে না? অবশ্যই কমবে। বাথরুম থেকে বেবিজেয় হালকা সাজগােজ করল অপূর্ব। পাজামা-পাঞ্জাবি। ঘাড়ে পাউডার। চলে এল সােজা খাবার টেবিলে। এসে থমকে দাঁড়াল। বউ থম মেরে বসে আছে চেয়ারে। হাতে কাজ থেকে এসে ছাড়া অপূর্বর সাদা জামা।

“কী হয়েছে ডার্লিং!

বউ চুপ। অপূর্ব আবার বলল, কী হয়েছে সােনা? শরীর খারাপ?’ বউ তাতেও চুপ। অপূর্ব এগিয়ে এসে বউয়ের কাঁধে হাত রাখল। বউ ঝটকায় হাত সরিয়ে জামাটা মেলে ধরে কঠিন গলায় বলল, এটা কী?’ অপূর্ব দেখল তার কাজ থেকে ফেরা সাদা জামার পেছনে লাল লিপস্টিকের দাগ। সেই দাগ বলছে, কোনও নারী-ওষ্ঠ অপূর্বর পিঠ ছুঁয়েছে। আমার বন্ধু অপূর্ব শুধু চরিত্রবান নয়, তার নারী-ভীতি ছিল। নিজের বউ ছাড়া অন্য নারীর সঙ্গে মেলামেশায় সে ছিল জড়ােসড়াে। এসবের ওপর বউকে সে যেমন ভয় করত, ভালওবাসত খুব। গদগদ টাইপ ভালােভাসা। তারপরেও তার পিঠে লিপস্টিকের দাগ ! একেই বলে কপাল। না, কপাল নয়। একেই বলে ঠোট। লিপস্টিক রাঙানাে ঠোট।

কিন্তু অপূর্বর বউকে কে বােঝাবে? লিপস্টিক মেয়েদের ঠোটে যেমন সুন্দর, স্বামীর জামার পিঠে তেমন মারাত্মক। ফলে যা ঘটবার তাই ঘটল। অপূর্বর বউ রাতেই সুটকেস গুছিয়ে বাপের বাড়ি রওনা দিল। যাওয়ার আগে ঘােষণা করল, যতদিন না সাক্ষ্য-প্রমাণসহ লিপস্টিক রহস্যের কিনারা হচ্ছে ততদিন সে ফিরবে না। অপূর্ব বসল মাথায় হাত দিয়ে। সামান্য লিপস্টিক জীবনে এতবড় দুঃসময় নামিয়ে আনল! তার ভালােবাসাকে রসাতলে পাঠাল! জামায় এ কার লিপস্টিক? সে কি ছিল বাসে? মেট্রোতে? অটো? ক্লাবে? নাকি কাজের জায়গায়? সে কে? কে সেই ঘাতকিনী? রক্তাক্ত করে গেল দাম্পত্য রক্ত রঙা ঠোটের ছোঁয়ায়! রহস্যের কিনারা হল পরদিন। কাজ থেকে ফিরে অপূর্ব দেখল, বউ হাসি হাসি মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লিপস্টিক রহস্যের সমাধান সে নিজেই করেছে। তার নাকি মনে পড়েছে, আগের দিন কাজে বেরােনাের সময় বরকে আদর করেছিল রােজকার মতাে। কেলেঙ্কারি ঘটেছে তখনই। আদরের আগে নতুন কেনা লিপস্টিকের ট্রায়াল নিয়েছিল। রাতে বাপের বাড়িতে ঘুমােতে ঘুমােতে রং মনে পড়ে গেছে।

গদগদ অপূর্ব বউ ফিরে পেয়ে খুব খুশি। বউয়ের নতুন লিপস্টিককে মনে মনে শতকোটি ধন্যবাদ জানাল। বলল, “ইস্, কাল সারাদিন সবাই আমার জামার পিঠে ওই দাগ দেখেছে। তারপর মুখ নামিয়ে বউয়ের ঠোঁটে চুমু খেতে গিয়ে থমকে গেল।

‘যাও আগে, লিপস্টিক মেখে এসাে।

আপনারাই বলুন, এরপরেও লিপস্টিককে বিপজ্জনক না বলে থাকা যায় ?

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes