jamdani

লােকালয় থেকে দূরে দু’দিন অজানা দ্বীপে।

ঢেউটা আলতাে করে পা দুটো ছুঁয়ে ফের আপন খেয়ালে চলে গেল। চাঁদের রুপােলি রঙ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। কানে ভেসে আসছে জাল ফেলার ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ। দূরে টিমটিম করে জ্বলছে হ্যারিকেনের আলাে। আচমকা গভীর নিস্তব্ধতা ভেঙে ডেকে উঠল পেঁচা। প্রকৃতি যেন সমুদ্র আর পরিবেশ মিশিয়ে এক অবিশ্বাস্য মধুর কম্বিনেশন দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে মৌসুনিকে। বেশ অনেকদিন ধরেই সােশ্যাল মিডিয়ার ওয়াল টু ওয়াল ঘুরে ফিরছে মৌসুনি দ্বীপের সৌন্দর্য। আর সেখানের টেন্টের ক্যাম্পিনিংয়ের কথা। যা দেখে ভ্রমণপিপাসু আমার মন বলে উঠল— হেথা নয়, হােথা নয়, নয় অন্য কোথা, অন্য ওখানে… মৌসুনি দ্বীপে। তাই ঠিক করলাম মৌসুনি ঘুরতে যাব। তবে ট্রেনে-বাসে নয়! বাইক ট্রিপ। সঙ্গী সম্মিলন চট্টোপাধ্যায় ছেলেবেলা থেকে আমার ক্রাইম পার্টনার। 

ঘড়ির কাঁটা বলছে সকাল ৭টা। এদিকে সম্মিলনের দেখা নেই। ছােট থেকেই ওর টাইম সেন্সের বড় অভাব। কোনওদিন যদি ঠিক সময় আসে! এদিকে বাড়ি থেকে কড়া ইনসট্রাকশন, একা বাইক নিয়ে যাওয়া যাবে না। অগত্যা লেটলতিফ মহাশয়ের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। যা-ই হােক, সম্মিলনকে নিয়ে যাত্রা শুরু হল সকাল ৭টা ২০ মিনিটে। স্টাটিং পয়েন্ট ডায়মন্ডহারবার রােড, জোকা। এই রাস্তা দিয়ে নাক বরাবর সােজা গিয়ে ডায়মন্ডহারবার। প্রথম ব্রেকটা এখানেই নিয়েছিলাম। ফেসবুকের দৌলতে আগেই জেনেছিলাম, এই শহরের বাসন্তী টি স্টলের চায়ের সুখ্যাতি। তাই বাইক থামাতেই সম্মিলন বলল, ‘চল চল, বাসন্তী টি স্টলে ব্রেকফাস্টটা সেরে নিই।” কথাটা মন্দ লাগল না। তা ছাড়া সকালে তেমন কিছু খেয়েও বেরােনাে হয়নি। সুতরাং বাসন্তী টি স্টলের চা, ব্রেড ওমলেট খেয়ে শুরু হল আবার পথ চলা। 

চায়ের এই দোকান থেকে বেরিয়ে কিছু দূর পরই দু’রাস্তার মােড়। একটি ডায়মন্ডহারবার রােড, 

অন্যটি উস্থি রােড। এবার উস্থি রােড ধরেই এগিয়ে যাওয়ার পালা। গন্তব্য নামখানা। টানা ৩ ঘন্টা বাইক চালানাের পর আমরা এলাম হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীর ঘাটে। ভেসেলের ঘাটে তখন গাড়ির লম্বা লাইন। আর পেটে তখন চলছে ছুঁচোর ডন। এদিকে বেলা গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। হােটেলে ভাত বাড়ন্ত। অগত্যা আবার ডিম-পাউরুটি খেয়ে নদী পার হলাম। 

এবারের যাত্রা শুরু হল পাতিবুনিয়ার ঘাটের উদ্দেশে। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে আমারা সরে আসতে থাকি নাগরিক সীমানা থেকে। বদলে যেতে থাকে রাস্তার পাশের দৃশ্যপট। মাটির বাড়ি, নিকানাে উঠান, পানের বরজ, ধানের খেত, লাউয়ের মাচা, হাঁস-মুবগির ঝাঁক-এ বলে আমায় দেখ তাে ও বলে আমায়। এক সময় পাকা রাস্তা পার করে এসে পড়লাম ইটের। সাজানাে পথে। এমন করেই নাম না জানা অচিন সব গাঁ পার করে পৌছলাম চিনাই নদীর ধারে। এখানে ভেসেল নেই! নৌকায় করেই পার করা হল বাইক। তার পর সিমেন্টের ঢালাই দেওয়া রাস্তা দিয়ে ১৫ মিনিট এগিয়ে যেতেই জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মিলল সমুদ্রের হাতছানি। নিজেকে আর আটকাতে না পেরে নীল পরির আকর্ষণে বাইকের স্পিড হল ৭০। সােজা গিয়ে দাঁড়ালাম মৌসুনি বিচে। আসলে ছােটবেলা থেকেই সমুদ্র আমার খুব প্রিয়। অনেকদিন ছেলেবেলার বন্ধুর সঙ্গে দেখা না হলে মনটা যেমন হু হু করে ওঠে, তেমনি সমুদ্রের জন্য মন কেমনের একটা ঢেউ ক্রমশ ফুলতে থাকে। যা-ই হােক, কিছুক্ষণ পরই সুয্যিমামা লাল-হলুদ রঙের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করতে করতে নীল সাগরে ডুব দিল। আর আমরা চললাম ইজিফিসাের পথে। প্রথমেই বলে রাখি, মৌসুনিতে কোনও হােটেল বা রিসর্ট নেই। থাকার ব্যবস্থা বলতে টেন্ট আর মাড কটেজ। এসি, সােফা, টিভি, ফ্রিজের লাক্সারি কৃত্রিমতা এখানে নেই। আছে বলতে খােলা। নির্মল হাওয়া, নাম না জানা পাখির কলতান, পুকুরের মাছ, খেতের সবজি আর নির্ভেজাল আতিথেয়তা। যা-ই হােক, আমরা ছিলাম ইজিফিসাে ক্যাম্পের মাটির ঘরে। এখানে এসে প্রথম মনে হল, সঙ্গে যদি ক্রাইম পার্টনারের বদলে প্রাইম পার্টনার, মানে জীবনসঙ্গিনী থাকতেন, তা হলে রােমান্সের ষােলাে কলা পূর্ণ হত। 

আসবাব বলতে একটা খাট। দেওয়ালে খান তিনেক ছবি। বৈদ্যুতিক কোনও আলাে নেই।। সম্বল হ্যারিকেন। তবে ফ্যান আছে। কিন্তু সমুদ্রের হাওয়ার কাছে তার কোনও প্রয়ােজনীয়তা নেই। সে রাতে দেশি মুরগির ঝাল আর রুটি দিয়ে ডিনার সেরে ঘুমােতে গেলাম। মৌসুনিতে সূর্যোদয় দেখা ভাগ্যে জুটল না। আমাদের ঘুম ভাঙেনি। তবে জ্যাকপট হিসাবে আমাদের কাছে এল জম্বু দ্বীপ ঘুরতে যাওয়ার অফার। এক মিনিট দেরি না করে লুফে নিলাম সুযােগ। উঠে পড়লাম নৌকায়। তার পর নীল আকাশের নীচে, নীল জলের ওপর প্রকৃতির। সৌন্দর্য চেটেপুটে উপভােগ করতে শুরু করে দিলাম। বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে এগিয়ে চলল আমাদের জলযান। যে দিকে তাকাই শুধুই নীল। কে যেন চোখে স্বপ্নের রঙ লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে। চালক “ইউ-টার্ন’ নিতেই ফের বাস্তবের মাটিতে ফিরে এলাম। বিচে নেমে সমুদ্রস্নান। তার পর পুকুরের মাছের ঝােল দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সেরে বাড়ির ফেরার পালা। শুধু সমুদ্রকে কথা দিয়ে এলাম- ‘যখন খুশি ডাক দাও, ফিরে ফিরে আসব তােমার কোলে। তবে এবার কিন্তু প্রাইম পার্টনার।

— সুমন সাহা

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes