এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই
নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে,
নন্দি বাড়ির আটচালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে।
বিখ্যাত গায়ক সনৎ সিংহের এই গান এই জেনারেশনের ক’জন জানে। আসলেই বদলের মরশুমে সব কিছুই বদলে যায়। এদিকে আকাশটা এখন সমুদ্রনীল। সাদা মেঘ যেন শ্বেতপদ্ম। শরতের আকাশে এই রঙ-ই মর্তে এনে দেয় আসন্ন উৎসবের প্রথম ছোঁয়া। যে ছোঁয়ায় পাল্টে যায় পথঘাট-অলিগলি রাজপথ। পাল্টে যায় বাসে-ট্রামের তর্ক-বিতর্ক। সাবেকি নাকি থিম? এই প্রশ্ন ঘিরেই তখন সরগরম শহর থেকে শহরতলি। কিন্তু এই বদল তো আর একদিনে আসেনি। সময়ে যেমন সব কিছুই বদলে যায়, তেমনি বদলে গিয়েছে দুর্গাপুজোও।
অবশ্য বদলে যাওয়া দুর্গাপুজো মানে কিন্তু পুরোহিত, পুজোর বদল নয়। আবার দশভূজা, বারোভূজা বা অষ্টভূজা হয়ে যাওয়াও নয়। মা উমা বাপের বাড়িতে চারদিনের জন্যে যেভাবে আসেন, সেভাবেই আসেন, তাঁর চার সন্তানকে নিয়ে। সঙ্গে অবশ্যই অশুর। এমনকি সিংহ, ময়ূর, ইদুর, পাচা, হাঁস, সাপ-তারাও ঠিকই আছেন। ৩০০ বছরের পুজোর, যা বদলে গেছে তা হলো পুজোকে কেন্দ্র করে বাঙালির আনন্দ আয়োজন। নতুনত্ব এসেছে প্যান্ডেল, লাইটিং, ঠাকুর তৈরি নিয়ে।
বাসন্তী পুজো থেকে অকালবোধন
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে প্রাথমিক যে বদলটা এসেছিল, তা করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। তার হাত ধরেই শুরু হয়েছিল অকালবোধন। অর্থাৎ ফাল্গুন থেকে শরৎ-এর আশ্বিনে। অবশ্য তার জন্যে যে বাসন্তী পুজো আটকে গিয়েছে, তা কিন্তু নয়। গোটা পশ্চিমবঙ্গে বেশ ধুমধাম করেই হয়। কিন্তু শহর কলকাতাতে সে কেবল কিছু কিছু জায়গায় সীমাবদ্ধ। ব্যতিক্রম মেদিনীপুরের পাশকুড়া-রাধামোহনপুর বালিচক অঞ্চল। ‘বারোয়ারি’ বাসন্তীপুজো যার নাম। যা ব্যবহৃত হয় দুর্গাপূজোর ক্ষেত্রেও। যাকে আজ আমরা সার্বজনীন বলি। অর্থাৎ যে পুজোয় সবার সমান অধিকার ছিল। ব্রাহ্মণ-কায়স্থ, গরিব বড়লোক সবার পার্বণ।
বারোয়ারি অর্থাৎ বারো ইয়ার
ইতিহাস বলছে পুজো আগে বারোয়ারি ছিল না। এর জন্য অবশ্য খুব পেছনের ইতিহাস ঘাটতে হবে না। উপন্যাস বা গল্প পড়লেই বুঝতে পারবেন। কিংবা পাঁচ, ছয় দশকের বাছাই করা বাংলা চলচ্চিত্র। যেখানে দুর্গাপুজো হচ্ছে জমিদার বাড়িতে। সেই পুজোতে অংশ নিচ্ছেন গুটিকয়েক আমন্ত্রিত। এখনকার মতো ‘আমাদের পুজো’ বলে কিছু ছিল না। সেখানেই হুগলী জেলার গুপ্তি পাড়া আমূল পাল্টে দিলো পুজোর চিত্র।
সময়টা ১৭৯০। তার আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ ও আপামর কলকাতার বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলোতেই আটকে ছিল পুজো। কিন্তু গুপ্তিপাড়ার বারো জন ব্রাহ্মণ যুবক ঠিক করল দুর্গাপূজো করবে তারাও। যেখানে থাকবে না কোনও বিভেদ, জাতপাত, ধনী গরিবের ভেদাভেদ। যার জন্যে আজও বাঙালি কৃতজ্ঞ। সেই থেকেই শুরু বারোয়ারি দুর্গাপূজো। যার বয়স হয়ে গিয়েছে প্রায় ২২৬ বছর।
থিমপুজো এবং সাত ও আটের দশক
১৭৯০ সাল থেকে বারোয়ারি পুজো শুরু হওয়ার পর, আরও কিছু সময় লেগেছিল বদল আসতে। কারণ তখনও জমিদার রাজ চলছে কলকাতা, সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে। তারা সহ্য করত না, নীচুজাতেরা পুজো করবে ঘটা করে। ধুমধাম করে আনন্দ করবে। যার ফলে বারোয়ারি পুজো এগোচ্ছিল ভীরু পায়ে। ১৯৪৭ এর সময়টাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভারত স্বাধীনতা অর্জন করতেই ধীরে ধীরে জমিদারী প্রথা উঠে যেতে শুরু করল। এরপর সাতের দশক থেকে বারোয়ারি পুজো বিরাট আকার ধারণ করল। পুজো করত সব একেকটা ক্লাব। এলাকার বিখ্যাত বা কুখ্যাত দাদারা। পেছনে থাকত রাজনৈতিক হাত।
শুদ্ধ শুচি ও সুস্থ রুচি
হ্যাঁ, এই স্লোগানেই বদলে গিয়েছিল পুজোর চালচিত্র। সালটা ১৯৮৫। পঁয়ত্রিশ বছর আগের ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন কলকাতাকে নিয়ে আসে আন্তর্জাতিক প্লার্টফর্মে। থিম পুজোর কনসেপ্ট এলো তারপরই। চাঁদা তুলে সাবেকি পুজোর তখন রমরমা। কেউ কেউ যে ব্যতিক্রমী কাজ করছে না সেটাও নয়। তখনই ছড়িয়ে পড়ল শুদ্ধ শুচি, সুস্থ রুচি-র স্লোগান। যা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন পুজো কমিটির মধ্যে।
এভাবে কেটে গেল আরও কিছু বছর। শারদীয়া সম্মাননা ঘিরে প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠল পাড়া। ভাগ হলো উত্তর কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতার এলাকা। সালটা ১৯৯২-৯৩। বাঁশ, কাপড় দিয়ে পুজোর প্যান্ডেল ছাড়াও কোথাও ফলের বীজ, কোথাও কাঠ দিয়ে শুরু হলো মণ্ডপসজ্জা। শিল্পীর ভাবনায় এলো বদল।
এরপর ১৯৯৫ থেকে ২০১৯। বারোয়ারি পুজো হয়ে উঠল থিম পুজো। পুজো হয়ে উঠল বাণিজ্যিক। জুড়ে গেল শিল্প, কারুকৃতি, তৈরি হলো ৮৮ ফুট দূর্গা। এখন কনসেপ্টের যুগ। থিম মিউজিকে ঘোষিত হয় পুজো। লাইন দিয়ে দেখতে হয় ঠাকুর। আর ভাসানে ক্যারাভান করে আলোকসজ্জিত হয়ে দেবী দূর্গা চলেন বিসর্জনে।
বদলে যাওয়া পুজোর গান এবং মহালয়া
বদল এসেছে পুজোর গান এবং মহালয়াতেও। পিতৃপক্ষের এই শেষ দিন যে বছর থেকে বাণী কুমার- পঙ্কজ মল্লিকের সৃষ্টি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হল সেইদিন থেকে বাঙালি নতুন চোখে দেখতে শুরু করল মহালয়ার এই পুণ্যতিথিকে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র- হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বেতার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ই ছিল একমাত্র মহালয়া অনুষ্ঠান। শরতের আলোর বাঁশি বেজে উঠলেই নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে বাজারে এসে যেত একেবারে আনকোরা নতুন পুজোর গান। হেমন্ত-মান্না-শ্যামল-মানবেন্দ্র-নির্মলেন্দু চৌধুরীদের স্বর্ণযুগ, তারপর এলো শ্রীকান্ত-লোপামুদ্রা-রাঘব-শুভমিতাদের গান। বাড়িতে বাড়িতে কলের গানের মতোই এখন শোপিসে পরিণত হয়েছে ক্যাসেট প্লেয়ার। সিডি-ডিভিডি প্লেয়ারটা মাঝেমধ্যে গেয়ে উঠলেও তার পরমায়ু ফুরিয়ে এলো প্রায়। পুজোর গানের অপেক্ষা আর সেভাবে বুঝে উঠতে পারে না এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। “আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে/ ঢ্যাং কুরকুর ঢ্যাং কুরাকুর বাদ্যি বেজেছে’ গেয়ে ছুটে আসা প্রজন্ম অতীত হয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল পুজোর আবহে।