jamdani

পূর্ব নেপালের হিল কুইন কন্যাম

বিদ্যুৎ রাজগুরু

ঘরের কাছে নেপাল ভ্রমণ

অজানার আনন্দে মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে আমাদের। তাই অচেনাকে চিনতে আর অজানাকে জানতে কার না ভালাে লাগে বলুন? সেদিন অনাবিষ্কৃত অজানা ঐশ্বর্যের সন্ধানে শীত শীত সকালে ঘরের কাছে প্রতিবেশী দেশ পূর্ব নেপালে পাড়ি দিলাম। শিক্ষক বন্ধু সন্তোষের কাছেই প্রথম শুনলাম পূর্ব নেপালের কন্যাম নামক পার্বত্য উপত্যকার নাম। প্রথম শুনেই মনে মনে ভেবেছিলাম, ঘরের কাছে বিদেশ নেপালের কন্যাম যাব একদিন। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সেদিন শিলিগুড়ি থেকে কাঁকরভিটায় নেপাল-ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে কন্যাম অভিমুখে রওনা হই। ভারতের গাড়ি, তাই ‘ভাংচার’নামে অনুমতিপত্র নিয়ে যেতে হল। একটা দিনের জন্য ভাংচার কাটালাম। লােকশ্রুতি নে’ও ‘পাল’ শব্দ দুটি থেকেই এসেছে ‘নেপাল’। যার অর্থ পবিত্র গুহা। গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দেশ নেপাল। আমরা আজ সেই নেপাল দেশে প্রবেশের মুখে। কাঁকরভিটা থেকে কালাে পিচঢালা রাস্তাটা ধুলাবাড়ি, ধাইজানের পর চারালির কাছে। ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। আর মূল সড়কটা বিত্তা মােড়ের দিকে চলে গেছে।

সাধপূরণের ভ্রমণ

ভারতের মতাে ট্রাফিক ঝামেলার ঝক্কি নেই। দুই পাশে খেতি জমি, সারি সারি সুপারি গাছ কিংবা এলাচের বাগান দেখতে দেখতে সবুজ সুন্দর নির্জনতায় আমাদের পথ চলা। কালাে পিচের রাস্তাটা যেন মাথার সিঁথির মতাে চলে গেছে। দুই পাশে বিক্ষিপ্ত জনবসতি। কোথাও এতটুকু কোলাহল নেই। একফালি রাস্তাটা বনজ গন্ধ মেখে ধীরে ধীরে উঠে গেছে পার্বত্য উপত্যকায়। উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ঠান্ডা। কনকনে ঠান্ডা যেন আমাকে আঁকড়ে ধরছে। বেশ একটা ভিন্ন আমেজ আর অজানা অনুভূতিতে মন ভরে যায়। এ যেন ‘কতদিন ভাবে ফুল উড়ে যাব কবে, যেথা খুশি সেথা যাব, ভারি মজা হবে। আমার সাধপূরণের ভ্রমণ শুরু। তরাই-পাহাড়ের পাদদেশের কয়েকটা জনবসতি পেরিয়ে উপস্থিত হলাম “জোড়া কলস’ নামক রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা বসতি অঞ্চলে। সত্যি, জোড়াকলস স্থানটি ঢুকতেই একটি তােরণ রয়েছে। দুই পাশে একজোড়া সােনালি রঙের ঢাউস কলস। হয়তাে মাঙ্গলিক কলস। আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। জোড়াকলস কন্যাম যাওয়ার পথে ছােট্ট একটি পাহাড়ি গ্রাম। এখানেই আমাদের চায়ের বিরতি। শীতের মিঠে রােদ গায়ে মেখে হালকা টিফিনও করে নিলাম। গাড়ি স্টার্ট করা হল। কুটিডিডা পাহাড়ি বসতি পার হলেই পাথভিরা দেবীর মন্দির।

পবিত্র পাথভিরা মন্দির

পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথ পেরিয়েই পৌঁছে গেলাম কন্যামের খুব কাছে পাথভিরা মন্দিরে। পর্বতের শৈল্যশিরার একেবারে টঙে পাথভিরা দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠিত। মূল সড়কের পাশে পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে আমরা মন্দিরমুখী হলাম। আমার প্রাক্তন ছাত্র মনােজ আগেই বলেছে, স্যার, পুজো দিতে হবে। তাই রেডিমেড পুজোর উপাদান কিনে রওনা দিলাম পাহাড়ের চড়াইপথে। পথটা বেশ নির্জন। ছায়া ছায়া আরণ্যক পথে আমরা হাঁটি হাঁটি পায়ে মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সিমেন্ট কংক্রিটের বাঁধানাে পথটা ধাপে ধাপে মন্দিরের দিকে উঠে গেছে। কিন্তু মন্দিরের আর দেখা মেলে না। পথমধ্যে প্রচুর বাঁদরের ছােটাছুটি। আমাদের পায়ের শব্দে তারা গা ঢাকা দিচ্ছে পাশের জঙ্গলে। বাঁদরের কোনও বাঁদরামি নেই এখানে। বেশ খানিকটা পথ যেতেই মাটির পথ, আবার মন্দির সংলগ্ন কিছুটা সমতলভূমি। ঠিক পাহাড়ের চূড়ায় পাথভিরা মন্দির। সারি সারি পুজোর অর্ঘ্য নিয়ে দোকানিদের পসরা। সকল দোকানি আছে ভক্তদের অপেক্ষায়। আমি আর মনােজ মন্দির চত্বরে ঢুকলাম। বিশাল চওড়া লম্বাটে পাথরটি রঙিন মাঙ্গলিক কাপড়ে মােড়া। না, পুরােহিত নেই। ভক্তরা আপন খেয়ালে নিজেরাই হাঁটু মুড়ে প্রণাম, ভক্তি জানাচ্ছে আর নীরবে মানসিকও করছে। মনস্কামনায় বেঁধে দিচ্ছে রঙবেরঙের মঙ্গলসূত্র। উচ্চ পর্বত শিখরে বিভিন্ন আরাধ্য মূর্তি কয়েকটি কক্ষে রাখা রয়েছে। যেমন শিব, দুর্গা, গণেশ ইত্যাদি। পাথভিরা হল দেবী দুর্গার আর এক রূপ। স্থানীয়দের কাছে। জাগ্রত দেবী। দুগার ব্রোঞ্জের মূর্তি রয়েছে মন্দির চত্বরে। পাথরটি একটি কক্ষে অবস্থান করছে লাল সিঁদুর মাখানাে অবস্থায়। এখানে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন শিলা আর ব্রোঞ্জের মূর্তি। প্রাচীন মন্দিরটির রয়েছে কৌলীন্য। নেপালি নববর্ষে পাথভিরা মন্দিরে ধূমধাম করে মেলা বসে। বহু দূরদুরান্ত থেকে ভক্তরা আসে মনস্কামনা পূরণের লক্ষ্যে।

পূর্ব নেপালের হিল কুইন

যা-ই হােক, আমরা পুজোর কাজ সেরে পাহাড়ি কন্যা কন্যামের অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম। সুসজ্জিত চায়ের বাগান আর ঢেউ খেলানাে সবুজ উপত্যকা আমাদের যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। নানা রঙের ঘােড়া নিয়ে ঘােড়সওয়াররা প্রস্তুত। এক ইশারাতে ঘােড়ার পিঠে চড়ে ঘুরতে পারেন গােটা কন্যাম উপত্যকা। চা-বাগানগুলি পাহাড়ের ঢেউ খেলানাে উপত্যকা জুড়ে রয়েছে। মনে হয় যেন সাজানাে-গােছানাে সবুজের কার্পেট। যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি। হিমশীতল পরিবেশে এখানে স্বস্তির ঠাঁই মেলে, ক্লান্তি ভুলে যাওয়া যায়। চারিদিকে শুধু সবুজের ঢেউ। রয়েছে সানরাইজ পয়েন্ট। সূর্যোদয়ের রকমারি রূপ দেখতে দেখতে আপনার মন ভরে যাবে।

পূর্ব নেপালের সূর্যদয়া পুরসভার অন্তর্গত এলাম জেলার ছােট্ট পাহাড়ি শহর হল কন্যাম। হিমালয়ের সুন্দরী তন্বী যেন কন্যাম। এখানে রয়েছে চা-বাগিচার অপরূপ সৌন্দর্য। হিমশীতল ঠান্ডায় প্রকৃতির খুব কাছাকাছি কয়েকটা দিন যেন কোনও ভ্রমণরসিক দু’দণ্ড কাটাতেই পারেন। ময়ূরের নীল সবুজ ডানার মতাে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কুঁদ হয়ে যান কয়েক দিন। পূর্ব নেপালের হিল কুইন নামে পরিচিত কন্যাম, যা মেচি জোনে অবস্থিত।

শিলিগুড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত নেপাল-ইন্ডিয়া বডার। একদিকে ভারতের পানিট্যাঙ্কি আর অন্যদিকে নেপালের কাঁকরভিটা। আর এই দুই প্রাচীন দেশের সীমানা ভাগ করে বয়ে চলেছে আন্তঃসীমান্ত মেচি নদী। সেখানেই আছে ইন্দো-নেপাল গেট। গাড়ি নিয়ে নেপাল প্রবেশ করতে হলে নেপালের অনুমতিপত্র ভাংচার’ কাটতে হয়। তার পরেই নেপালে প্রবেশের ছাড়পত্র মিলবে। এখানে পর্যটকদের দেখার জন্য অপেক্ষাতে রয়েছে কন্যাম টি গার্ডেনের মনােলােভা সৌন্দর্য। রােডওয়ে থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে বয়ে চলেছে মনােলােভা চা-বাগিচা। কন্যাম চা-বাগান এবং পিকনিক স্পটের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে।

চন্দ্রিমার সেরা ডেস্টিনেশন

প্রতি বছর হাজার হাজার ভ্রমণকারী কন্যামের মতাে ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনে উপস্থিত হন। কন্যামে প্রকৃতির রূপলাবণ্যে যেন কোনও জীবন রসিক ক্ষণিকের শান্তি পেতে পারে। ট্যুরিস্টরা প্রতি বছর কন্যামের চিলিং ক্লাইমেট এবং হেভেনলি টি গার্ডেনের মাধুর্য অবলােকন করতে দলে দলে ছুটে আসে। শীতকালে কনকনে ঠান্ডা হলেও গ্রীষ্ম ঋতুতে শীত শীত ভাব থাকে। নির্জন শ্যামলিমায় যুগলদের সেরা ডেস্টিনেশন হল কন্যাম। সমৃদ্ধ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কন্যামের আকর্ষণের চাবিকাঠি। এখানে যেমন রয়েছ হর্স রাইডিং অ্যাডভেঞ্চারের সুযােগ, তেমনই আঞ্চলিক নেপালি পােশাক পরে ছবি তুলতে পারেন। মন ভরে। আর স্বাভাবিকভাবেই আমরাও কিছুক্ষণ নেপালি পােশাক পরে ঘােরাঘুরি করলাম। পােশাক ভাড়া দেওয়ার জন্য দোকানিরা বসে রয়েছে। আপনার জন্য ঘােড়া নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে ঘােড়সওয়াররা। কিছুক্ষণ মাটি আর মানুষের কাছাকাছি যেতেই পারেন। বিবশ পতঙ্গের ডানায় এখানে থমকে যায় সময়। প্রেমিকার শীতল হাতের স্পর্শের মতাে মেঘ ছুঁয়ে যাবে আপনাকে।

কন্যাম থেকে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যাবে ছিমছাম জেলা শহর ইলাম। ইলামকে কেন্দ্র করেও বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। যেমন প্রাচীন চা-বাগান লাভধারা টি গার্ডেন। স্থানীয় বাসিন্দারা এটিকে লাভার্স পয়েন্টও বলে। সত্যি, এ যেন ভালােবাসার স্বর্গ। এছাড়া ইলামকে কেন্দ্র করে রয়েছ মাইপুখুরি লেক, জোড়পুখুরি লেক এবং দুর্লভ ঝাউগাছের সারি। কন্যাম থেকে সংগ্রহ করতে পারেন অরগ্যানিক তাজা শাকসবজি এবং কন্যাম বাগানের সতেজ চা পাতা। ঘরের কাছে পূর্ব নেপালের ছােট্ট পাহাড়ি স্টেশন কন্যাম ঘােরার প্ল্যান করতে পারেন সহজেই।

কীভাবে যাবেন: ট্রেনে বা ফ্লাইটে এনজেপি স্টেশন। সেখান থেকে গাড়িতে পানিটাঙ্কি হয়ে নেপালের কন্যাম। দুরত্ব ৮৬ কিমি। শিলিগুড়ি থেকে ভায়া পানিট্যাঙ্কি প্রায় ৭২ কিমি। সময় লাগবে প্রায় ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। এছাড়াও মিরিক থেকে কন্যামের দূরত্ব ৩২ কিমি। সময় লাগবে ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। থাকবার জন্য রয়েছে প্রচুর হােটেল। একদিন ঘুরে শিলিগুড়ি ফিরে আসা যায় সন্ধ্যায়।

* এই অস্থির সময়ে কোথাও বেড়াতে যেতে হলে সমস্ত নিয়মাবলী, সুরক্ষা ও ওই জায়গার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে যাওয়াই ভালাে।

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes