শহুরে বাতাবরণ, কোলাহল থেকে বেড়িয়ে হাত বাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলেই শান্ত প্রকৃতির কোলে অবস্থিত, মায়াবী বন্ধনে আবদ্ধ পাহাড়ি গ্রাম সাংসের ও হােম স্টে কাব্য-কাদম্বরী। কালিম্পং থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে, রংপাে যাওয়ার পথে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা এক ছােট্ট পাহাড়ি হ্যামলেট সাংসের। নির্জন। সবুজ পাহাড় আর ঘন নীল আকাশের বেষ্টনীতে সাংসেরে দু-তিন দিন কাটানাে এক দারুণ অনুভূতিই বটে। এখানে আপনার সঙ্গী হতে পারে হিমালয়ের বরফ ঢাকা পাহাড় চূড়াে। তিস্তার টলটলে স্বচ্ছ হিরের মতাে জল বয়ে চলেছে পাহাড় ঘেরা এই জনপদের পাশ কাটিয়ে। নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের আভ্যন্তরীণ ডেলাে পাহাড়ে ঘেরা সাংসের খাসমহল প্রকৃতির কোলে এক অনন্য অবদান।
দৈনন্দিন একঘেয়েমি কর্ম জীবনে যাঁরা ক্লান্ত, কালিম্পংয়ের কোলাহল থেকে যাঁরা সরে আসতে চান একটু নিরিবিলিতে, তাঁদের জন্য টি এস এলিয়েটের ভাষায় এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ‘এসকেপ ফ্রম রিয়েলিটি’ বলা যেতেই পারে। ঘন সবুজাভ প্রকৃতি আপনাকে দিতে পারে নৈসর্গিক উপভােগ, যা আপনি কল্পনাও করতে পারেন না। ডেলাে পাহাড়ের পাশ দিয়ে পাহাড়ি কোল ছুঁয়ে নীচে নেমে গেছে এক অপূর্ব ঢালু রাস্তা। রূপসী উত্তরবঙ্গের রূপবতী এক পর্যটনকেন্দ্র এই সাংসের। নির্জন, নির্মল, সুন্দর এই গ্রাম সাংসেরের উচ্চতা খুব একটা বেশি নয়, মােটামুটি ৪০০০ ফুট হবে। এখানকার তাপমাত্রা সারা বছর মনােরমই থাকে। তবে রাতের আবহাওয়া একটু ঠান্ডা বােধ হয় বইকি।
এখান থেকে খুব কাছেই কালিম্পং শহর। মাত্র ১৪ কিমি দূরে। এখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন দূরপীন, ডেলাে, রামিতে ভিউ পয়েন্ট, হনুমান টক প্রভৃতি মনােলােভা স্থান। এছাড়া লাভা-লােলেগাঁও, রিশপ, কোলাখাম, ইচ্ছেগাঁও, সিলেরিগাঁও সাংসের থেকে ঘুরে আসা যায়। একদিকে সুন্দরী তিস্তার আনমনে বয়ে যাওয়াকে, আর অন্যদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে যেন হাত দিয়ে ছুঁয়ে ফেলা যায় এই সাংসেরে। সবদিক থেকে মনে হয় যেমন সুছন্দ, সাজানাে গােছানাে প্রকৃতি তার উজাড় করা ভালােবাসা দিয়ে আপনাকে অভ্যর্থনা করছে বরণডালা সাজিয়ে।
কাব্য-কাদম্বরী
এই কাব্য আর কাদম্বরী দুই পাহাড়ি কন্যা। এমন অসামান্য নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে এক তরুণীর নাম কাব্য ও অপরজন কাদম্বরী। কে কে হােমস্টের নামে দু’টি ‘কে’-এর অর্থ কাব্য আর কাদম্বরী, মালিকের দুই কন্যা। দিয়লাে ও দুরপিনদারা পাহাড়ের গায়ে বা মাঝখানের ছবির চেয়েও সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, মনােরম এই সাংসের গ্রাম। বাঁ দিকে মেল্লি, রংপাে, সিংটাম হয়ে গ্যাংটক আর ডান দিকে মহানন্দা অভয়ারণ্য, সেবক, কালিঝােরা হয়ে তিস্তা বাজার ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে ঝােলনা ব্রিজ। ব্রিজ থেকে ১৪ কিমি দূরে কালিম্পং। কালিম্পং থেকে শুরু হল চড়াই। যেতে যেতে বােঝা যায় ওই পাহাড়ি পথ কখনও উঁচু গাছের মাথা ছুঁয়েছে, আবার কখনও চলেছে আকাশের মাথা ছোঁয়া গাছের পায়ের কাছ দিয়ে। অনেকটা নীচ দিয়ে রূপােলি ছবির মতাে ভেসে আসছে তিস্তার রূপ-রস-গন্ধ। চারিদিকে যেন এক শব্দহীন নিঝুম জগৎ। রাস্তার দু’ধারে শুধু বুনাে ফার্ণ, লিলি, আমলকি, বহেরা, রুদ্রাক্ষ। আর এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে আদা-এলাচের ঝােপ। ভাগ্য সঙ্গে থাকলে কখনও এই জঙ্গলের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় ময়ূরের চলে যাওয়া।
আকাশে মেঘেরা ছুটে বেড়াচ্ছে মেঘ বালিকাদের সফেদ ডানায়। কাব্য-কাদম্বরীর সবুজ ছােট্ট লনটা থেকে বিশাল পাহাড়কে সারাদিন দেখলেও মন ভরে না, মনে আক্ষেপ থেকেই যায়। এই পাহাড়ের বুকে বাঁ দিক ঘেঁষে হিরের টুকরাের মতাে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে টাইগার হিল। আর এদিকটায় অবস্থিত আছে দার্জিলিং শহর, মাঝে সিকিমের তারেভিড়, নামচি, রাবাংলা, নামথাং। ডানদিকে মাথা উঁচু করে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘার ১৭ টি পিক। আর একটু নীচে অবস্থিত নাথুলা ? রেঞ্জ। এখানে পৌঁছে শুধু বিশ্রামের আয়ােজন নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও মনের খােরাকের খোঁজ মেলে। হৃদয়ের এই এক টুকরাে আনন্দ যেন শহুরে হট্টগােলকে আনয়াসে দূরে ঠেলে দেয়। সাংসের এখানে বড়ই সুন্দর এক ফরেস্ট ভিলেজ। চারিপাশে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা গাঁও, ঘন নীলাভ আকাশ।
এই পাহাড়ি গ্রামের পায়ের কাছ দিয়ে বয়ে চলেছে সবুজ রঙমাখা তিস্তা। মন চাইলে সঙ্গে সঙ্গে হেঁটেই পৌঁছে যেতে পারবেন তিস্তার শীতল মনােলােভা জলের সংস্পর্শে। এই জায়গার একটি সুন্দর নাম আছে যা তারখােলা নামে পরিচিত। এই স্থান থেকে সামান্য দূরত্বে সহজেই টই টই করে আসা যায় সড়কপথে সিকিম-বাংলার চেকপােস্ট রংপাে। চারিদিকের সিন সিনারি দেখে মনে হয় কবির ভাষায় ‘তুমি কি কেবলই ছবি। হােম স্টেতে এসে বসলে সঙ্গে সঙ্গে এসে যায় গরম গরম পপকর্ণ আর গরমাগরম পাহাড়ি কফি। একটু পরেই সামনের উন্মুক্ত প্রকৃতি জুড়ে নেমে আসে নিবিড় সন্ধে। পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে এক এক করে জ্বলে উঠতে থাকে যেন দীপাবলির আলাে। সবার হাতগুলাে শিরশির করে ওঠে ঠান্ডায়। এক নিশ্চিন্ত আলস্য যেন ঘিরে ধরে আমাদের সকলকে ক্রমশ।
ভিউপয়েন্টের সুখ যাপন
সাংসেরের ঐতিহ্যবাহী ভিউ পয়েন্টে বসার জন্য এই গ্রামেরই কোনও মৃত ব্যক্তির পরিবার তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে এখানে তৈরি করে দিয়েছেন সুন্দর এক জায়গা। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি এই বসবার জায়গায় সবকিছু ভুলে, কাজের চাপকে দূরে ঠেলে যেন বহুক্ষণ বসে থাকা যায় মনােরম প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে। এখানে বসলে যেন মন ও হৃদয় ঘড়ির কাঁটার শাসন মানে না। চোখ দুটি এখানে যেন দৃশ্যসুখের আনন্দে জুড়িয়ে যায়। শান্ত হয় মন ও মস্তিষ্ক।
এখানে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সিঙ্কোনা গাছের সারি। সিঙ্কোনার সঙ্গে সঙ্গে এখানে দেখতে পাওয়া যায় এলাচ, আদা, মাড় ও কমলালেবুর বাগান। এখানকার গ্রামে গ্রামে তেমন সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায় জৈবসারে শাকসবজির নজরকাড়া চাষবাস। টাটকা তরতাজা শাকসবজি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পদ খাইয়ে যেন এখানকার রিসর্টের লােক চিরতরে মুগ্ধ করে দেয়।
রাতের দিকে বেশ টের পাই পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে যথেষ্ট ঠান্ডা নেমে আসছে। খড়ের ছাউনি ছেড়ে আমরা সবাই ঘরে ঢুকে পড়ি গরম পােশাকের খোঁজে। ডাইনিং রুমে রাত ৮ টা ৩০ মিনিট বাজলে ডাক পড়ে খাবার খাওয়ার জন্য। খাবারের স্বাদে গন্ধে মুখ একেবারে ভরে যায়। সে স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। কী অকপট আন্তরিকতা তাঁদের মানতেই হবে।
দুষণমুক্ত এই সাংসের যেন ছিমছাম প্রকৃতির এক আলগা পাহাড়ি প্রান্তর। বর্ষাকাল এলেই এই গ্রামটিতে সুন্দর সুগন্ধী আতপ চালের গন্ধ পাওয়া যায়।। সাংসেরে আসল মজা মেলে ভােরবেলা ঘুম থেক উঠে শিশির ভেজা পায়ে হালকা ট্রেক আর সুস্পষ্ট কাঞ্চনজঙ্ঘার মনমুগ্ধকর দৃশ্য পরিদর্শনে। শান্ত-স্নিগ্ধ বার্চ, পাইন, সিঙ্কোনা বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলায় যেন কোনও ক্লান্তিই আসে না শরীর ও মনে। ঘুম থেকে আলসেমি নিয়ে কম্বলের ভেতর থেকে। বেরিয়েই দেখি সম্পূর্ণ আকাশ জুড়ে যেন ভর করেছে সূর্যের লালচে নরম আলাে। যেন সম্পূর্ণ নতল জুড়ে বেজে চলেছে ‘প্রথম আলাের চরণধ্বনি।’ সীমিত সময়ের জন্য সেই আলাে ছুঁয়ে যেন জন্ম হয় এক স্বপ্ন ছোঁয়া নতুন দিনের।
কীভাবে যাবেন সাংসের
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কালিম্পং চলে এসে সাংসেরে খুব সহজেই পৌঁছানাে যায়। এই পাহাড়ি এলাকায় যেমন নিজস্ব গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়, তেমনি রিজার্ভ বা শেয়ার গাড়িতেও যাওয়া সম্ভব।
কোথায় থাকবেন
কে কে হােম স্টে (কাব্য-কাদম্বরী হােম স্টে)
যােগাযােগ
বিপ্লব দে – ৯৭৩৩৪৫৪৭৭৯/ ৮৯৬৭৯২৮৩৩৪
শরিফ রাই – ৮৯০৬১০৩৭০০/ ৭৯০৮৫৯৬৭৫৬
কিরি মানে হাতি আর বুরু মানে বন। আর মেঘাতুরু মানে... Read More
কংক্রিটে মোড়া শহরের কোলাহল পেরিয়ে কদিন ঘুরে আসুন সবুজ গাছপালায়... Read More
প্রতিদিনের ব্যাস্ততার মাঝে মন চায় কিছুদিনের ছুটি। যেখানে থাকবে না... Read More
এই গল্পটা যখন লিখতে বসেছি অদ্বিতীয়া ম্যাগাজিনের জন্য, তখন আরো... Read More
কোচবিহার থেকে মাত্রা ৩৫ কিলােমিটার দূরে তুফানগঞ্জএর রসিকবিল বিভিন্ন প্রজাতির।...
ঘড়িতে ৮ টা বেজে ১০ মিনিট। তখনও অফিসে কাজ করছিলাম।...
কিটু চট্টোপাধ্যায় বাইক কিনেছি মাসখানেক। একদিন হঠাৎ ইচ্ছা হল বাইক...
কলকাতার খুব কাছে একরাত কাটানোর জন্য মনের মত জায়গা। উত্তর...
পুরি থেকে মাত্র ১৪ কিলােমিটার দূরে। এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যশালী শিল্পকলা...
শহুরে বাতাবরণ, কোলাহল থেকে বেড়িয়ে হাত বাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলেই...
আদুরে মেয়ের মতাে আদুরিয়া। বর্ধমানের কাছেই এই বন আবাসনটি ভ্রমণরসিকদের...
পাহাড়ের কোলে ছবির মতাে সাজানাে এক আদিবাসী গ্রাম। পুরুলিয়ার শহর...
ওড়িশার একমাত্র শৈলগ্রাম কন্ধমাল জেলার দারিংবাড়ি। শাল, সেগুন, মহুয়ার বন,...
ঢেউটা আলতাে করে পা দুটো ছুঁয়ে ফের আপন খেয়ালে চলে...