– কী করেছিল? তােমার বুকে হাত দিয়েছিল?
– কী! কী বলছেন? চমকে উঠল জাহ্নবী।
– বলছি, সেক্সয়াল হ্যারাসমেন্ট হয়েছে বলছ, তাে ঠিক কী করেছিল? বুকে-ফুকে হাত দিয়েছিল তােমার ?
জাহ্নবী সন্তর্পণে একবার চারদিকে দেখল। ঘরভর্তি লােক। যেন কোনও ভিড়ে ঠাসা বাস। অচেনা, অজানা সহযাত্রী সব। তাদের মাঝখানে বসে আরেকজন মহিলা বেশ উঁচু গলায় জানতে চাইছেন, ওর বুকে হাত দেওয়া হয়েছিল কিনা!
সত্যিই কোনও বেয়াড়া হাত, কোনও অসভ্য কনুইয়ের মতাে প্রশ্নটা যেন এসে খোঁচা মারল জাহ্নবীর বুকে। ভিড় বাসে যেমন হয়। অথবা । একবার, সেই কলেজে পড়ার সময়, মােটরবাইকে চেপে দুটো ছেলে ওর গাঁ ঘেষে যাওয়ার সময়, পথচলতি লােকেদের সামনে ওর ওড়নাটা টেনে নিয়ে হা হা করে হাসতে হাসতে চলে গিয়েছিল- ঠিক সেদিনের মতাে নিজেকে বেআব্রু লাগল জাহ্নবীর।
যদিও প্রশ্নটা করার পর মহিলার মনােযােগ আর জাহ্নবীর দিকে নেই। উনি ফের ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নিজের মােবাইল ফোন নিয়ে!
শুরু থেকে এটাই ঘটছে! তখন জাহ্নবী নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিল ওঁকে। বলতে ওর অসুবিধে হচ্ছিল, অস্বস্তি হচ্ছিল প্রবল।
ঘটনাগুলাের কথা মনে করতে গিয়ে খারাপ লাগছিল নতুন করে। কষ্ট করে উচ্চারণ করতে হচ্ছিল প্রতিটা শব্দ। লজ্জায় ওর মাথা ঝুঁকে পড়েছিল।
বলতে বলতে একবার মুখ তুলে তাকিয়েছিল জাহ্নবী। এবং হতবাক হয়ে গিয়েছিল। মহিলার মুখ নিচু, ফিকফিক করে হাসছেন!
প্রথমে বুঝতে পারেনি জাহ্নবী। ওর অবাক লেগেছিল, মহিলা হাসছেন কেন! অফিসে ওর সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করা হত, একজন বাপের বয়সি লােক নানা ছল-ছুতােয় ওর গায়ে হাত দিত, এতে মজা পাওয়ার মতাে কী আছে!
তারপর জাহ্নবী দেখতে পেয়েছিল মহিলার দু’হাতে ধরা মােবাইল ফোনটা। বুঝেছিল, মহিলা আদৌ ওর কথা শুনছেন না। মােবাইলে কিছু একটা মন দিয়ে দেখছেন আর নিজের মনে হাসছেন। নিশ্চয়ই হােয়াটসঅ্যাপ-এ কেউ কোনও জোক পাঠিয়েছে। অথবা ফেসবুকে কোনও মজার পােস্ট। আর একটা সরকারি চেয়ারে বসে, সরকারি দায়িত্ব পালন করতে করতে মহিলা সেই মজায় ডুবে আছেন।
এখনও মহিলা মােবাইলেই মগ্ন। চুপ করে থাকল জাহ্নবী। ক্রমশ ওর মনে হচ্ছে, বেকার এসব থানা-পুলিস করতে গেল ও! অশালীন ব্যবহার | হােক বা যৌননিগ্রহ, অথবা ধর্ষণ, মেয়েদের কথা শােনার লােক আসলে কেউ নেই। মহিলাদের জন্যে পুলিসের এই আলাদা গ্রিভান্স সেল, বিশেষভাবে মহিলা পুলিসের বন্দোবস্ত রাখা- এসব আসলে বকোয়াস! লােক দেখানাে! প্রশাসন কোনওদিনই ব্যক্তিমানুষের সমস্যা নিয়ে ভাবিত নয়। কারণ প্রশাসন জানে, একা মানুষের সীমাহীন অক্ষমতা।
কাজেই জাহ্নবী চুপ করেই রইল। ৩০ সেকেন্ড, ৪০ সেকেন্ড। হঠাৎ মহিলারও টনক নড়ল, জাহ্নবী সামনে চুপচাপ বসে আছে, কোনও কথা বলছে না। মহিলা মুখ তুলে তাকালেন ওর দিকে, ‘হ্যা, থামলে কেন বলাে। খােলাখুলি বলাে সব।
তাও চুপ করেই থাকল জাহ্নবী। যদিও ও কথা বলতে শুরু না করলে মহিলা আবার মােবাইলে মন দিতে পারছেন না! সেই জন্যে বােধহয় । একটু অধৈর্য। কিন্তু ওঁর কথায় সাড়া দিতে ইচ্ছে করছে না জাহ্নবীর। হঠাৎ ওরও বিরক্ত লাগছে। মহিলা ওর অপরিচিত। তাও উনি জাহ্নবীর সঙ্গে এভাবে ‘তুমি তুমি’ করে কথা বলছেন কেন? উনি পুলিস বলে?
জাহ্নবীর বয়স ৩২। এই মহিলা ওর থেকে কিছুটা ছােটোই হবেন। অবশ্য উনি পুলিশ। খাঁকি উর্দির দাপট! সরকারি চাকরির ওজন! কিন্তু জাহ্নবীও আট বছর ধরে চাকরি করছে। যদিও একটা মাঝারি মাপের বেসরকারি সংস্থা, তাও একটা সাধারণ সৌজন্য তাে এই মহিলার কাছে আশা করতেই পারে! অপরিচিত কেউ ওকে এভাবে ‘তুমি তুমি’ করে কথা বলে না! নেহাত চেনাজানা না হলে জাহ্নবীও অফিসে, রাস্তাঘাটে সবাইকে আপনিই বলে।
জাহ্নবী এটাও বুঝতে পারছে না, যে ও হঠাৎ কী এমন করল যে ওর সঙ্গে এমন তাচ্ছিল্য নিয়ে কথা বলা যায়! ও এখানে অপরাধী হিসেবে আসেনি। পুলিশ ওকে ধরে-বেঁধে আনেনি থানায়। ও নিজে এসেছে, এবং সেটাও অভিযােগ জানাতে। যদিও এই আসতে পারাটা নেহাত সহজে হয়নি। একজন পুলিশের মুখােমুখি বসতে পারার জন্যেও অনেক কাঠখড় পােড়াতে হয়েছে।
প্রথম দিন এল, ওকে স্রেফ ভাগিয়ে দেওয়া হল, অফিসার নেই বলে। পরের দিন এল, সেদিনও নাকি অফিসার নেই! হতাশ হয়ে ফিরেই যাচ্ছিল, হঠাৎ ওর মনে হল, এরা মিথ্যে কথা বলছে। ওর জেদ চেপে গেল। দেখা করেই ফিরবে। অফিসারের আসার অপেক্ষায় ও থানার বাইরের বেঞ্চে বসে ছিল প্রায় ঘণ্টা দুই। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে এল, কিন্তু পরের দিন আবার গেল। সেদিন অফিসার আছেন, দরজা দিয়ে উঁকি মেরে তাঁকে দেখতেও পেল, কিন্তু শুনল, তিনি নাকি খুব ব্যস্ত। জাহ্নবীকে দু’মিনিট সময়ও দিতে পারবেন না। পরে কোনওদিন আসতে হবে।
– পরে? কবে?
থানার দরজায় দাঁড়ানাে পুলিশটি দার্শনিকের মতাে মুখ করে বলেছিল, ‘চলে আসবেন। এই যেমন আসছেন।
খুব অবাক হয়েছিল জাহ্নবী। গত কয়েকদিনে ইন্টারনেট ঘেঁটে ও দেখেছে, সেক্সয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযােগ নিয়ে কোনও মেয়ে থানায় গেলে পুলিশ আইনত এফআইআর নিতে বাধ্য। কিন্তু এরা তাে ওকে ঢুকতেই দিচ্ছে না। হাবভাব দেখে বােঝা যাচ্ছে, ঢুকতে দেবেও না!
জাহ্নবী বাধ্য হয়ে ওর এক উকিল বন্ধুকে বলেছিল। সে বলেছিল এখানকার কমিশনারেটের দায়িত্ব যাঁর হাতে, পরিচিত সেই পুলিশ কমিশনারকে। তিনি থানাকে বলেছিলেন। তারপর থানা থেকে ফোন এসেছিল জাহ্নবীর কাছে। অত্যন্ত নিরস, কেজো গলায় এসআই সুজাতা দাস ওকে ফোন করে বলেছিলেন আজ বিকেলে এসে দেখা করতে।
‘সঙ্গে বাড়ির কাউকে নিয়ে আসবেন। প্রায় আদেশের সুরে বলেছিলেন মহিলা।
এই মহিলাই, যিনি এখন ওর সামনে, টেবিলের উল্টোদিকে বসে আছেন। একটু আগে জানতে চাইলেন, ওর বুকে হাত দেওয়া হয়েছিল কিনা!
বুক নয়, ‘বুক-ফুক’। যেন খুব এলেবেলে একটা ব্যাপার। মেয়েদের বুক এবং তাতে হাত দেওয়াটা।
তা ছাড়া, কোনও মহিলাকে এমন একটা অশ্লীল প্রশ্ন, পুলিশ স্টেশনে বসে কেউ করতে পারে, এটা জাহ্নবী ভাবতেই পারে না। সেটাও এমন চড়া গলায়। কোনও নিভৃত জায়গা নয়। একটা খােলা ঘর। চারপাশে আরও টেবিল পাতা। সেখানে আরও সব পুলিশ বসে আছে। তাদের উল্টো দিকে অন্য লােকেরা বসে। তাদের কথাবার্তা জাহ্নবীর কানে আসছে। তার মানে এই টেবিলের কথাও ওরা শুনতে পাচ্ছে!
মহিলা এখন মােবাইল ছেড়ে, টেবিলের ওপর দু’কনুইয়ে ভর রেখে ওর দিকে ঝুঁকে আছেন। তাকিয়ে আছেন জিজ্ঞাসু চোখে। জাহ্নবী যে এই ‘সেক্সয়াল হ্যারাসমেন্ট অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস’-এর অভিযােগটা এনেছে, সেটা প্রমাণ করতে হয়ত এই তথ্যটা জানা খুব জরুরি। বুকে হাত দিয়েছিল? বুক?
জাহ্নবী বুঝতে পারছে অস্বস্তিতে ওর মুখ-চোখ লাল হয়ে গেছে। নাকের ডগা ঘামছে। কান গরম। ও কোনওমতে একবার দু’দিকে মাথা নাড়ল।
ভাগ্যিস সুজয় এখন ওর সঙ্গে নেই। ওর বর। বাইরে বসে আছে। সুজয় গােটা ব্যাপারটায় খুব বিরক্ত। বউ খামােকা নিজের অফিসের বসের নামে হ্যারাসমেন্টের চার্জ আনছে, এই ব্যাপারটাই সুজয়ের পছন্দ হয়নি। বাড়িতে বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটি হয়েছে এই নিয়ে। সুজয়ের বক্তব্য, ফালতু একটা ব্যাপার নিয়ে এত হইহল্লা করে লােক হাসানাের কোনও মানে নেই। অফিসে এরকম একটু-আধটু হয়েই থাকে। পারলে অ্যাভয়েড করাে, অথবা ট্যাকল করতে শেখাে। নেহাত না পােষালে অন্য চাকরি দেখে নাও। কিন্তু এসব থানা-পুলিশ করতে যাওয়া বােকামি। জাহ্নবী বিপন্ন মুখে মহিলার দিকে তাকাল।
মহিলার পাতলা ঠোটে সূক্ষম একটা হাসির রেখা ফুটল। নিষ্ঠুর একটা আঁচড়ের দাগের মতাে। এবার যেন তাতে বিজবিজিয়ে রক্তের ফোটা ফুটে উঠবে!
গলা নামিয়ে বললেন, এই ঘরে বসে এত সামান্য একটা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তুমি নার্ভাস হয়ে যাচ্ছ! পুলিশ যদি এফআইআর নেয়, তা হলে তাে মামলা রুজু করবে। সেই মামলা যখন কোর্টে উঠবে, তােমার বসের যিনি উকিল থাকবেন, তিনি তাে ছেড়ে কথা বলবেন না! বরং আরও খারাপ প্রশ্ন করবেন ভরা আদালতে দাঁড় করিয়ে। তখন কী করবে?
কী অদ্ভুত! এরা সবাই এক রকম গলায় কথা বলছে কেন! যাদের ওকে সাহায্য করার কথা, তারা সবাই কেন ওকে ভয় পাওয়াতে চাইছে। ‘কী করবে তখন? কী করবে?’– ওদের অফিসের এইচআর ম্যানেজারও ঠিক এরকমই ছদ্ম হুমকির ভাষায় কথা বলেছিল! যখন জাহ্নবী রেগে গিয়ে বলেছিল, অফিস কোনও ব্যবস্থা না নিলে ও থানায় যাবে, ভদ্রলােক খুব নির্বিকার গলায় বলেছিলেন, সেটা তাে আরও এমব্যারাসিং। ব্যাপার! আপনি হ্যান্ডল করতে পারবেন তাে?”
অথচ জাহ্নবী সত্যিই এসব থানা-পুলিশ করতে চায়নি। বরং অফিসের ব্যাপার অফিসেই মিটিয়ে নিতে চেয়েছিল। প্রথমে ভালােভাবে বলেছিল দেবাশিস সরকার, ওর বস-কে। যে, এভাবে গায়ে হাত দিয়ে কথা বলবেন না। আমি পছন্দ করি না। শক্ত গলাতেই বলেছিল।
কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। ভদ্রলােক পাত্তাই দিলেন না জাহ্নবীর আপত্তিকে। একটা সময় এমন হয়ে গেল, উনি কাছাকাছি এলেই জাহ্নবী অস্বস্তিতে কুঁকড়ে যেত। পাশে এসে দাঁড়ালে ধড়মড়িয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াত। তখন আবার ওর পিঠে হাত দিয়ে খুব স্নেহমাখা গলায় বলতেন, “আরে দাঁড়িয়ে উঠছ কেন! বসাে। প্লিজ সিট।
বলতেন, আর ওঁর হাতের আঙুল নির্ভুল খুঁজে পেত জাহ্নবীর অন্তর্বাসের আউটলাইন।
বাধ্য হয়ে, স্রেফ আর কোনও উপায় ছিল না বলে, একদিন চেঁচিয়ে উঠল ও। সবার সামনে। খুব খারাপভাবে বলল, এরকম করবেন না! বলতেই হল।
ওদের এইচআর ম্যানেজার সব শুনে প্রথমে খুব সিরিয়াস মুখ করে বলেছিল, “আপনার বােধহয় বুঝতে ভুল হয়েছে। মিস্টার সরকার ইজ ওয়ে টুউ সিনিয়র। বয়সে অনেক বড়াে আপনার থেকে।
জাহ্নবী বলেছিল, ‘হা, জানি। উনি প্রায় আমার বাবার বয়সি।
অমায়িক হেসেছিল এইচআর।‘একজ্যাক্টলি। উনিও হয়ত আপনাকে নিজের মেয়ের মতােই দেখেন। প্রােবাবলি ইটস জাস্ট ইউ, হু ইজ গেটিং অল দ্য রং সিগন্যালস। আপনিই ভুল বুঝছেন।
লােকটার হাসিমুখ দেখে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে ইচ্ছে হয়েছিল ওর। কোনটা গুড টাচ, কোনটা ব্যাড, মেয়েরা বােঝে। কে বাবার মতাে, কে নয়, বুঝতে পারে। ছােটোবেলা থেকে বােঝে। আর এই লােকটা ঘুরিয়ে যেটা বলতে চাইছে, যেটা বলে আসলে ওকে থামিয়ে দিতে চাইছে, সেটা জাহ্নবীর পক্ষে আরও অপমানজনক। মিস্টার সরকার নয়, ওর ভাবনাতেই গলদ আছে!
যদিও কয়েক মুহূর্তের জন্যে জাহ্নবী বিভ্রান্ত হয়েছিল। তাই কি? ওই কি ভুল ভাবছে? তার পরেই মনে হয়েছিল, তাইই যদি হবে, তা হলে মিস্টার সরকার এখন হঠাৎ কেন এত প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছেন! কেন জাহ্নবীর কাজের ভুল খুঁজতে উনি আজকাল এত তৎপর? এই। সেদিনও তাে মাঝরাতে ফোন করে বলেছেন, অফিস নিয়ে ওর সঙ্গে জরুরি কিছু আলােচনা আছে। ওর সঙ্গেই। কিন্তু সেটা অফিসে করা যাবে না। অফিসের পর বাইরে কোথাও বসতে হবে। আর এখন অফিসে সবার সামনে জাহ্নবীর কমিটমেন্টের অভাবের সমালােচনা করেন। কমিটমেন্ট। একটা মনগড়া ধারণা। সপ্তাহে পাঁচ দিন দশ ঘণ্টা করে খেটেও যার প্রমাণ দেওয়া যায় না।
জাহ্নবী মরিয়া গলায় ওদের এইচআর ম্যানেজারকে বলেছিল, ‘অফিস যদি কিছু না করে, তা হলে কিন্তু আমাকে পুলিশেই যেতে হবে। ভদ্রলােক আহত গলায় বলেছিলেন, কেন এসবের মধ্যে যেতে চাইছেন! কোর্ট, থানা-পুলিশ মানে আপনার জন্যে ফারদার এমব্যারাসমেন্ট। অফিসে জানাজানি হবে, আপনার বাড়িতে সবাই জানবে। আপনার প্রােফেশনাল লাইফ, পার্সোনাল লাইফ, সব ডিস্টার্বড় হবে। কী লাভ হবে তাতে!
এই পুলিশ অফিসার মহিলা, এসআই সুজাতা দাসও ওকে সেই একই কথা বােঝাচ্ছেন। হাসিমুখে। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে পরামর্শ দিচ্ছে। আসলে ইনিও ওকে ভয়ই দেখাচ্ছেন। কপোরেট পালিশ নেই সেই হুমকিতে, কিন্তু হুলগুলাে একই রকম। তীক্ষ, বিষাক্ত। আইনের চক্করে একবার পড়লে জিনা হারাম হয়ে যায়। একজন আইনরক্ষক ওকে কথাটা বলছেন! আদালতে হাজিরা দিতে। দিতে প্রাণ যাবে। চাকরি তাে তার আগেই যাবে। এমনকি ওর বরের চাকরি নিয়েও টানাটানি হতে পারে!
– তােমার বর কী করে?
বলল জাহ্নবী। কোথায় চাকরি করে, কত বছরের চাকরি, সব খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে মহিলা হাসলেন। যেন কিছুটা আশ্বস্তও হলেন যে ওর বরের মুরােদও ওরই মতাে। মাঝারি কোম্পানির ছােটো চাকরি। নিজের চেয়ার-টেবিলটির বাইরে কর্তৃত্ব খাটানাের কোনও জায়গাই নেই। প্রায়। সহানুভূতির গলায় বললেন, তা হলে কোন ভরসায় এসব মামলা-মােকদ্দমায় যাবে! ধরাে হ্যারাসমেন্টের চার্জ এনে পুলিশ মামলা করল। কিন্তু তুমি কিছু প্রমাণ করতে পারলে না। কোনও মেসেজ-টেসেজ তাে সেভ করে রাখােনি বলছাে?”
মহিলা যেন নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন। দু’দিকে মাথা নাড়ল জাহ্নবী। না, নেই। ও রাখেনি কিছু। যদিও তেমন কিছু ছিলও না। হ্যারাসমেন্ট প্রমাণ করার মতাে। মিস্টার সরকার চালাক লােক। বেশিরভাগ সময় যা বলার মুখেই বলতেন। অবশ্যই আড়ালে। এবং প্রশংসাসূচক।‘তােমার যা ফিগার, জিন্সের থেকে শাড়িতেই বেশি ভালাে লাগে!’ জাহ্নবী কী করে প্রমাণ করবে সেসব! কী করে বােঝাবে, যে একটা ৬০-৬২ বছরের লােক তার অর্ধেক বয়সের একটা মেয়ের ‘ফিগার’-এর প্রশংসা করছে- এটার মধ্যে যে অশালীন ইঙ্গিত থাকে, সেটা প্রমাণ করারই বা কী আছে!
-তা হলে! ধরাে তুমি প্রমাণ দিতে পারলে না, মামলা খারিজ হয়ে গেল, তােমার বস উল্টে মানহানির মামলা ঠুকে দিল। কী করবে তখন? আর অবাক হচ্ছে বা জাহ্নবী। এরা সব একই গলায় কথা বলে। সবাই একটা জিনিসই বােঝাতে চায়। যা হয়েছে হয়ে গেছে। এবার মুখ বুজে থাকুন। চেপে যান। কেন ফালতু ঝামেলা বাড়াবেন নিজের! ওর অফিসের এইচআর-ও খুব বন্ধুর মতাে গলাতেই বলেছিল, “দেখুন, আমরা চাই না আপনি এই সামান্য একটা ব্যাপারে মাথা গরম করে কোনও ভুল করে ফেলেন। ঝেকের মাথায় কমপ্লেন করে ফেলে, তার পর সে নিয়ে কোনও অসুবিধেয় পড়েন। আপনার ভালাের জন্যেই কথাগুলাে বলছি। আপনি আরেকবার ভাবুন, প্লিজ।
-এ তাে আমাকে থ্রেট করছেন আপনি! ঘুরিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন! জাহ্নবী প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল।
হতাশার ভাব করে মাথা নাড়িয়েছিল ওদের এইচআর ম্যানেজার। খুব দুঃখিত একটা মুখ করে বলেছিল, “না না, আপনি ভুল ভাবছেন। আমি চাইলে আপনার লেটার অফ কমপ্লেইন্ট আমি জমা নিয়ে নেব। এখনই। কিন্তু তার আগে আবার বলব, আপনি প্লিজ আর একবার ভাবুন। গিভ ইট এ সেকেন্ড থট।
কী করে বােঝাত জাহ্নবী, কী করে বােঝাবে, যে ওর সঙ্গে যা হয়েছে, সেটা আপাতভাবে সামান্য মনে হলেও আসলে সামান্য নয়। মেয়েদের জন্যে এগুলাে সামান্য থাকে না। প্রতিবার খারাপ লাগায় কুঁকড়ে যেত জাহ্নবী। কী অব্যর্থভাবে মিস্টার সরকারের হাত গিয়ে পড়ত ওর ব্রা-এর স্ট্র্যাপে। এরকম হয় নাকি! অ্যাক্সিডেন্টালি ? প্রত্যেকবার! জাহ্নবী বুঝতে পারত, ওই কয়েক সেকেন্ডে মিস্টার সরকারের ধূর্ত আঙুল খুঁজে । নিচ্ছে ওর অন্তর্বাস। আর প্রতিবার ও ঘেন্নায় শিউরে উঠত। শরীর নিয়ে কোনও ছুঁৎমার্গ নেই ওর। কিন্তু এটা তাে ও চাইছে না। ওর ভালাে লাগছে না এটা। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ শরীর ছুঁচ্ছে ওর। সেটা যৌন হেনস্থা নয়? শুধু বুকে হাত দিলেই হেনস্থা!
মহিলা অফিসারটি, সুজাতা দাস, এসআই, এখন কেমন হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সেই চাহনি। একটু দূর থেকে দেখলে তাইই মনে হবে। বন্ধুর মতাে। সাহায্য করতে চায় যে বন্ধু। অথচ সহানুভূতির ছিটেফোঁটা নেই এই মেকি সৌজন্যের আড়ালে। জাহ্নবী যেটুকু বলেছে, তাতেই এই মহিলার যা প্রতিক্রিয়া, ও বেশ বুঝতে পারছে, এর সঙ্গে বাকিটা শেয়ার করার কোনও প্রশ্নই নেই।
আর বললেই কি উনি বুঝবেন! মিস্টার সরকার একদিন সন্ধের পর ওকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সেদিন আর অফিস সংক্রান্ত আলােচনার অছিলা নয়, সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছিলেন কোনও বারে বসে ওঁর সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাটানাের। জাহ্নবী একটু কড়া গলাতেই বলেছিল, “আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?
মিস্টার সরকার অপরিসীম ব্যঙ্গের হাসি ঠোটের কোণে ঝুলিয়ে নির্লজ্জের মতাে বলেছিলেন, “তােমাকে নিয়ে একটু নির্জনে বসতে চাইছি। তার মানে ঠিক কী, সেটা না বােঝার মতাে বােকা তাে তুমি নও। আর মদ খাও না, সতীলক্ষ্মী টাইপ, সেরকমও তাে নও শুনেছি।
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল জাহ্নবী। অফিসের কয়েকজন মিলে ওরা যায় কখনও-সখনও, কোনও বারে। আচ্ছাটাই আসল উদ্দেশ্য থাকে সেখানে, মদ্যপান নয়। জাহ্নবী খুব বেশি খেতেও পারে না। অভ্যেস নেই। কিন্তু দেবাশিস সরকার সেই খবরটাও জোগাড় করেছে।
সেদিন নিজের কিউবিকলে ফিরে এসে জাহ্নবী অনেকক্ষণ থম মেরে বসেছিল। ওর কিছুতেই অপমানটা হজম হচ্ছিল না। যত ভাবছিল, তত রাগ হচ্ছিল। অস্থির লাগছিল। খুব নােংরা লাগছিল নিজেকে। প্রত্যেকটা খারাপ লাগা ঘটনা যেন নতুন করে ঘটে যাচ্ছিল ওর সঙ্গে। নতুন করে ঘেন্না ছড়াচ্ছিল সর্বাঙ্গে। কখনও লিফটে একসঙ্গে উঠলে মিস্টার সরকার ওর গা ঘেঁষে দাঁড়াবেনই। প্রায় প্রতিদিনই উদার প্রস্তাব দেবেন নিজের গাড়িতে জাহ্নবীকে কিছুদূর এগিয়ে দেওয়ার। ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবেন। এমনকি বরের সঙ্গে জাহ্নবীর কেমন সম্পর্ক, তাও জানতে চাইবেন।
সেটাও তাত্ত্বিক আলােচনার অছিলায়! দার্শনিক মুখ করে বলবেন, “আজকালকার ওয়ার্কিং কাপলরা এত স্ট্রেসড থাকে, যে দে ডােন্ট ইভেন হ্যাভ রেগুলার সেক্স!’ এবং এমন একটা সুচিন্তিত মন্তব্য করার পর জানতে চাইবেন, জাহ্নবী আর ওর বরের সম্পর্ক ঠিক কেমন? ডু দে এনজয় আ হেলদি লাইফ?
ভাবতে ভাবতে মাথায় দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠেছিল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল জাহ্নবী। তার পর একেবারেই কিছু না ভেবে, ভাবলে বােধহয় করতেও পারত না কাজটা, জোর পায়ে হেঁটে গিয়ে সােজা ঢুকে পড়েছিল ওদের এমডির ঘরে। ভাগ্য ভালাে, তখন ঘরে একাই । ছিলেন এমডি মিস্টার রাহেজা। বয়স্ক মানুষ, ধার্মিক। খুব সংস্কার মানেন। রােজ সকালে অফিসে আসেন সিঁদুরের টিকা লাগিয়ে। চেম্বারের মধ্যেও লক্ষ্মী-গণেশের বড়াে মূর্তি। সামনে গিয়ে প্রায় বােমার মতাে ফেটে পড়েছিল জাহ্নবী।
খুব মন দিয়ে ওর সব কথা শুনেছিলেন এমডি। তার পর নিজের জলের গ্লাসটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘জল খান একটু। শান্ত হােন।’
জাহ্নবী তখন একটু লজ্জাই পেয়েছিল। মনে হয়েছিল, এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও চলত বােধহয়। সঙ্কোচের সঙ্গে বলেছিল, ‘সরি স্যার, আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি। আমি প্রথমে এইচআর ম্যানেজারের কাছেই গিয়েছিলাম। কিন্তু উনি আমার কথা শুনতেই চাইলেন না! উল্টে …’
হাত তুলে ওকে থামার ইশারা করেছিলেন মিস্টার রাহেজা। তার পর খুব সহানুভূতির সঙ্গে বলেছিলেন, আপনার যে দুঃখ হয়েছে, সেটা আমি বুঝি। আমি মিস্টার সরকারের হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। যদি কোনও ভুল বােঝাবুঝি হয়ে থাকে, আপনিও আমাদের ক্ষমা করে । দিন। রাইট?
ছটফটিয়ে উঠেছিল জাহ্নবী।‘ভুল বােঝাবুঝি নয় স্যার। সত্যিই এটা আমার সঙ্গে হচ্ছে। এই হ্যারাসমেন্ট। এক-দুদিন নয়, দিনের পর দিন। আমি সত্যি কথা বলছি।
মিস্টার রাহেজাও অমায়িক হেসেছিলেন। ঠিক ওদের এইচআর ম্যানেজারের মতাে। তার পর বলেছিলেন, আপনি জানেন, এই মিস্টার সরকার আর আমি, ডালহৌসিতে একটা দশ বাই আট ঘরে দুটো ছােটো টেবল পেতে কোম্পানিটা শুরু করেছিলাম। আমরা দুজনেই সবে তখন সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করে বেরিয়েছি। আমার বাড়ি থেকে বলল, পড়াই শেষ, এবার রােজগারের রাস্তা খোঁজো। এই নাও কিছু ক্যাপিটাল, স্টার্ট অন ইওর ওন। আর সরকারের সেই বছরই বাবা মারা গিয়েছে। ওর কাঁধেই পুরাে ফ্যামিলির দায়িত্ব। আজকে আপনারা এই অফিসের ক্যান্টিনে সাবসিডাইজড মিল পান। আমরা দুজনে তখন দুপুরে খেতাম চাল-ছােলা ভাজা। ফুটপাথের ভুজিয়াওয়ালার থেকে কিনে আনা হত। দু’টাকা করে ঠোঙা, এখনও মনে আছে। কী কষ্ট করে এই কোম্পানিটাকে আমরা দাঁড় করিয়েছি যদি জানতেন!’
শুনতে শুনতে অস্থির হয়ে উঠছিল জাহ্নবী। এসব গল্প শােনানাের মানে কী! তার মানে মিস্টার সরকারের বিরুদ্ধে অফিস কোনও ব্যবস্থা নেবে, তাই তাে? সেটা সােজাসুজি বলে দিলেই তাে হয়!
মিস্টার রাহেজা বােধহয় ওর চোখের ভাষা পড়তে পারছিলেন। টেবিলের ওপর একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘একটা জিনিস গড়তে অনেক দিন সময় লাগে, কিন্তু ভাঙতে এক সেকেন্ড। বুঝছেন, আমি কী বলছি?
চোখে প্রায় জল এসে গিয়েছিল জাহ্নবীর। ও শুধু বলেছিল, ‘আপনাদের কাছে একজন মহিলার সম্মানের কোনও দাম নেই তা হলে? আমার যে অপমান হচ্ছে রােজ, তার কোনও প্রতিকার নেই?
জবাবে কিছু বলেননি মিস্টার রাহেজা। ব্যথিত দু’চোখে তাকিয়ে থেকেছিলেন ওর দিকে। কপালের মাঝখানে সিঁদুরের টিকা, তার গায়ে তখনও লেগে থাকা দু-এক দানা চাল, বয়স্ক একজন মানুষের সংস্কারি, শুদ্ধাচারী মন- সব নির্বাক তাকিয়ে ছিল জাহ্নবীর অপমানিত মুখের দিকে। এমডি কী বলেছেন, সেটা জানার পর অফিসের যে কয়েকজন মেয়ে ওকে কমপ্লেন করতে উৎসাহ দিচ্ছিল, তারা সবাই পা ঘষে সরে গিয়েছিল জাহ্নবীর পাশ থেকে। শুধু লােপামুদ্রা, সারা অফিস যাকে আড়ালে ‘বােকা লােপা’ বলে ডাকে, সে ওর হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিল। কাঁঁদতে কাঁঁদতে বলেছিল, “তা হলে কিছু করা যাবে না লােকটাকে ! আজ তােমার সঙ্গে অসভ্যতা করছে, কাল হয়ত আরেকজন মেয়ের সঙ্গে করবে! কিন্তু কোনও শাস্তি হবে না লােকটার!
জাহ্নবী হয়ত এত থানা-পুলিশ করত না, এত দূর আসার কথা ভাবতই না, যদি না বােকা লােপা ওই কথাটা বলত।‘আজ একজনের সঙ্গে করছে, কাল আরেকজনের সঙ্গে করবে। ঠিকই তাে। কেউ রুখে না দাঁড়ালে এরকমই তাে চলতে থাকবে!
– তােমার ছেলে-মেয়ে আছে?
এসআই সুজাতা দাসের প্রশ্নটা মাথায় ঢুকতে একটু সময় লাগল জাহ্নবীর। ধীরে ধীরে ও দু’দিকে মাথা নাড়ল।
– নেই! বিয়ে হয়েছে ক বছর?
– পাঁচ। এর সঙ্গে ওর কেসের কী সম্পর্ক আছে বুঝতে পারছে না, তাও জবাব দিল জাহ্নবী।
– পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে, তাও কোনও ইস্যু নেই। বরের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তাে, নাকি তাও নেই?
যেন বেড়াল তার দুই থাবার মধ্যে ইঁদুর নিয়ে উল্টেপাল্টে খেলছে, এমন একটা গলায় প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন মহিলা। এর পর উনি কী জানতে। চাইবেন? ডু দে হ্যাভ রেগুলার সেক্স ? যেমন মিস্টার সরকার জানতে চান! জবাব না দিয়ে জাহ্নবী চুপ করে রইল।
– সঙ্গে বাড়ির কাউকে আনতে বলেছিলাম, এনেছাে?
মাথা নাড়ল জাহ্নবী।
– কে এসেছে? বর?
আবারও কিছু না বলে জাহ্নবী মাথা ঝাকাল।
– যাও, ডেকে নিয়ে এসাে। গলায় রীতিমতাে আদেশের সুর।
বাইরে এসে জাহ্নবী প্রথমে সুজয়কে দেখতে পেল না। এই তাে বারান্দার বেঞ্চে বসেছিল! কোথায় গেল! ভাবতে ভাবতেই দেখল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সুজয়, সিগারেট খাচ্ছে। দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল জাহ্নবী।
– একটু আসবে ভেতরে?
– আমি আবার কেন! বিরক্তি সুজয়ের গলায়।
– তােমাকে ডাকছে। জাহ্নবী আমতা আমতা করে বলল।
ওরা দুজন গিয়ে পাশাপাশি বসতে মহিলা পালা করে দুজনকেই ভালাে করে মাপলেন। তার পর সুজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার স্ত্রী যে এই কমপ্লেনটা করতে চাইছে, এতে আপনার সায় আছে?
জাহ্নবী আড়চোখে দেখল, সুজয়ের চোখেমুখে অস্বস্তি। ও পাশ থেকে তাড়াতাড়ি বলল, এটায় তাে ওর কিছু বলার নেই। এটা আমার অফিসের ব্যাপার, আমার নিজস্ব ব্যাপার। আমি এই কমপ্লেনটা করতে চাই।
মহিলা চোখ সরু করে হাসলেন। একবার এফআইআর নিয়ে নিলে, কেসটা কোর্টে চলে গেলে, ব্যাপারটা কিন্তু আর তােমার নিজস্ব থাকবে! তখন সেটা বারােয়ারি হয়ে যাবে। কেসের ডেট পড়লে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে, একঘর লােকের মাঝখানে উল্টোসিধে কোয়েশ্চেনের জবাব দিতে হবে, সবাই শুনবে সেটা। মিডিয়া হবে। কাগজে বেরােবে, টিভিতে দেখাবে। তােমাদের বাড়ির নাম জড়াবে, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন জানবে। যা হয় আর কী! বােঝােই তাে!’
ওরা দুজনেই চুপ করে আছে। মহিলা এবার মােক্ষম চাল দেওয়ার মতাে সুজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার স্ত্রী যার বিরুদ্ধে সেক্সয়াল হ্যারাসমেন্টের চার্জ আনতে চলেছে, সে খুব ওয়েল কানেক্টেড লােক। আজ সকাল থেকে আমাদের ওসি সাহেব এই কেসটার ব্যাপারে কতগুলাে ফোন পেয়েছেন জানেন? আপনার স্ত্রী যেমন কমিশনারকে দিয়ে ফোন করিয়েছে, তেমনি পাল্টা ফোন এসেছে একেবারে টপ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ লেভেল থেকে। আমি নাম নিতে পারব না, কিন্তু একেবারে টপ, বুঝলেন তাে? তারা সবাই পুলিশকে বলেছেন, এই কেসটা নেওয়া হলে যেন সবদিক ভালাে করে খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া হয়। একজন জেনুইন ভদ্রলােকের বেইজ্জতি যেন না হয় কোনওভাবে। কাজেই। শেষ পর্যন্ত যদি হ্যারাসমেন্টের চার্জ প্রমাণ না করা যায়, তা হলে মানহানির মামলা বাঁধা। সেই জন্যই জানতে চাইছি, আপনার বা আপনার। বাড়ির মত আছে তাে এতে?
পাথরের মতাে শক্ত মুখ করে পাশে বসে আছে সুজয়। অফিসার মহিলা জাহ্নবীর দিকে ফিরলেন। প্রায় বন্ধুর মতাে গলায় বললেন, ‘যা বলছি, তােমার ভালাের জন্যই বলছি। এই মামলা যদি শুরু হয়, তােমার ভালাের থেকে খারাপই বেশি হবে। দুদিন পর দেখবে শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা | লেগে গেল। তােমার হাজব্যান্ডই হয়ত ডিভাের্সের মামলা করে দিল! আমারও দশ বছর হয়ে গেল পুলিশে। অনেক তাে দেখলাম। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে জাহ্নবী। ওর হঠাৎ খুব ফাকা লাগছে। মাথার ভেতরটা ফাকা, বুকের ভেতরটা একেবারে খাঁ খাঁ করছে। সবাই ওর। কী ভীষণ ভালাে চাইছে! আহ, ভালাে লাগায় ওর মরে যেতে ইচ্ছে করছে! পুলিশ অফিসার মহিলা কিছু একটা বলছেন ওকে নিচু গলায়। কী বলছেন আবার? শােনার জন্যে একটু সামনে ঝুঁকে পড়ল জাহ্নবী।
– রেপ ভিক্টিমদের কথা ভাবাে একবার। তাদের কী অবস্থা হয়! তােমাকে তাে রেপ করেনি কেউ! তুমি লাকি!
জাহ্নবী ফিকে হাসল।‘রেপ করে যাদের মেরে ফেলা হয়, তারা আরও লাকি, বলুন? বারবার রেপড হতে হয় না! তাই না?
মহিলার চোয়াল শক্ত হল। আমার যা বলার ছিল তােমাকে বলে দিয়েছি। এবার তােমার ডিসিশন। বাড়ি যাও, ভালাে করে ভেবেচিন্তে ঠিক করাে কী করবে। এফআইআর করতে হলে নেক্সট উইকে যে কোনওদিন চলে এসাে। আসার আগে ফোন করে আসবে।
ট্যাক্সিতে ফেরার সময় সারা রাস্তা একটা কথা বলেনি সুজয়। জাহ্নবীও শুকনাে খরখরে চোখে চেয়ে ছিল বাইরের দিকে। বাড়ি পৌঁছে সােজা বাথরুমে ঢুকে গেল জাহ্নবী। স্নান করতে হবে। খুব নােংরা লাগছে নিজেকে। শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে মুখের ওপর ধারাজলের স্পর্শ নিতে নিতে একটু যেন আরাম হচ্ছিল। কিন্তু চোখের ভেতরে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া আগুনের তাত একটুও তাে কমছে না। কান্না তাে পাচ্ছে না একটুও! চোখের ধারটা কেবল জ্বালা করে যাচ্ছে সমানে।
স্নান সেরে, বাড়ির জামা কাপড় পরে বেরিয়ে জাহ্নবী দেখল সুজয় ঘরে নেই। এখন আবার কোথায় গেল কে জানে! বাইরে আলাে কমে এসেছে, কিন্তু ঘরের আলাে জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না। ভেজা চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে জাহ্নবী অন্যমনস্কভাবে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে। রইল। এসআই সুজাতা দাস মিথ্যেই শ্বশুরবাড়ির ভয় দেখাচ্ছিলেন ওকে। বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিল বলে শ্বশুরবাড়ি-বাপের বাড়ি, কোনও দিকের সঙ্গেই স্বাভাবিক সম্পর্ক নয় ওদের। ওরা আলাদা থাকে। বছর দেড়েক আগে দুজনে হােম লােন নিয়ে এই ছােট্ট ফ্ল্যাটটা কিনেছে।। অনেক টাকা মাসে ইএমআই দিতে চলে যায়। এখন বাচ্চা হওয়ার বাড়তি খরচটা ওরা সামলাতে পারবে না। মহিলা কী সহজে জিজ্ঞেস করলেন, বরের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তাে! আসলে জাহ্নবী বুঝতে পারছে, মহিলা একটা ফাঁক খুঁজছেন। ওর চরিত্রের ফাঁক। তা হলে হয়ত এটাও প্রমাণ করে দেওয়া যায় যে প্রায় বৃদ্ধ মিস্টার সরকারের আসলে কোনও দোষই নেই। জাহ্নবী, নষ্ট-চরিত্র জাহ্নবীই তাকে প্রলুব্ধ করেছিল!
আনমনে নিজের মুখে একবার হাত বােলাল জাহ্নবী। চোখ, নাক, চিবুক, গলা হয়ে ক্রমশ আরও নীচে। বুকে, পেটে। জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। ধর্ষিত হলে কি এর থেকেও বেশি অপমান হয়? এর চেয়েও বেশি কষ্ট? এই যে আইনের সাহায্য নিতে গেলে বারবার বােঝানাের। চেষ্টা হয়, ভুল করছ মেয়ে! আরও বেইজ্জত হবে! সমাজে মুখ দেখানাের উপায় থাকবে না! তার থেকে চুপ করাে। মুখ বন্ধ রাখাে। গিলে নাও তেতাে স্বাদ। হজম করে ফেলাে অপমান- ধর্ষণের পর কি এর থেকেও বেশি কষ্ট গিলতে হয়?
জাহ্নবী পাথরের মতাে দাঁড়িয়েই ছিল। পেছনে কাপ-প্লেটের ঠুং-ঠাং শব্দ হতে ঘুরে দেখল দুকাপ চা ট্রেতে নিয়ে ঢুকছে সুজয়। মাঝে মাঝে ওর বর নিজেই চা করে আনে। জাহ্নবী যেদিন খুব ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে, অথবা হয়ত ওর শরীর খারাপ, তেমন দিনগুলােয়। সুজয়কে দেখতে। দেখতে খুব কান্না পেল জাহ্নবীর। ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে সুজয় কাছে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। কেঁপে উঠল জাহ্নবী। সুজয় চুমু খাচ্ছে ওর কানের পেছনে, ঘাড়ে, গলায়।
ভালাে লাগতে লাগতে হঠাৎ জাহ্নবী আড়ষ্ট হয়ে গেল। সুজয়ের হাত ওর টি-শার্টের ভেতরে। পিঠ থেকে ঘুরে আসছে সামনের দিকে। কিন্তু জাহ্নবী এখন এসব চাইছে না। ও শুধু চাইছে সুজয় ওকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে একটু দাঁড়িয়ে থাকুক। সুজয়ের আদরে সাড়া দিচ্ছে না ওর শরীর। ও বাধা দিতে চাইল সুজয়ের হাতকে। কিন্তু সুজয় ততক্ষণে মুখ নামিয়েছে জাহ্নবীর বুকের খাঁজে। জাহ্নবী অসফুটে বলল, না !
সুজয় বিড়বিড় করে বলল, মনখারাপ সেরে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
বিষণণ হল জাহ্নবী। কত সহজে বলে দেয় ‘মনখারাপ সেরে যাবে’! শরীরেরই ক্লেদমুক্তি ঘটে না, তাে মন ! মনের নাগাল পাওয়া অতই সহজ! তবে সুজয় এরকমই। সহজ, সরল, হয়ত কিছুটা নির্বোধও। বউয়ের মন ভালাে করতে মাঝে মাঝে যেমন চা বানিয়ে আনে, তেমনই বিশ্বাস করে, যৌনতায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়! ঠিক হয়ে যায় সব! তাই ওদের দাম্পত্যে প্রায় সব সমস্যাই শেষ হয় অনিবার্য সম্ভোগে। অনিবার্য, কারণ একটা সময়ের পর সুজয় অপ্রতিরােধ্য। ওকে আর ঠেকিয়ে রাখা যায় না। স্রেফ গায়ের জোরেই পারে না জাহ্নবী। সেই শারীরিক সক্ষমতা মেয়েদের থাকে না।
কিন্তু কখনও তাে ঘুরে দাঁড়াতে হয়! যখন পিঠ ঠেকে যায় দেওয়ালে। ওর শরীরে যত জোর আছে সব একজোট করে জাহ্নবী চেপে ধরল সুজয়ের কবজি। হাত টেনে নামিয়ে আনল নিজের বুক থেকে।
অবাক হল সুজয়। এমনটা কখনও ঘটেনি গত পাঁচ বছরে। কী হল?
-না। গুটিয়ে ওপরে উঠে যাওয়া টি-শার্ট নামাতে নামাতে বলল জাহ্নবী।
-কী না?
সুজয়ের দিক থেকে মুখ ফেরাল জাহ্নবী। শক্ত হাতে জানলার গরাদ ধরে বাইরের দিকে তাকাল। রাস্তার আলােগুলাে একটা একটা করে জ্বলে উঠছে। সেই দিকে তাকিয়ে জাহ্নবী খুব স্পষ্ট গলায় বলল, না বললাম। না। চাইছি না। জানালাম। মেনে নিতে শেখাে।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
এদেশে সোনাকে স্থিতি এবং ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...