ফোন নাম্বার না জানা থাকায় আবারও আমরা অনাহুত অতিথি হয়ে ঢুকে পড়লাম উত্তর কলকাতার আরও এক বনেদি বাড়িতে। প্রবেশ করার আগেই অবশ্য জেনে নিয়েছিলাম কার সঙ্গে কথা বললে জানা যাবে এ বাড়ি এবং পরিবারের ইতিহাস। এ বাড়ির মেয়ে অনসূয়া বিশ্বাসের খোঁজ করলাম কোর্টইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে। আমাদের বাঁদিকে তখন দেখতে পাচ্ছিলাম সুবিশাল ঠাকুরদালান। বেশ অনেকটা উঁচুতে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে এখন একলাটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যমণ্ডিত পারিবারিক ঠাকুরদালান।
পুজোর সময় অবশ্য গমগম করে ওঠে জায়গাটি। এখন ভরা চৈত্রে সে দাঁড়িয়ে আছে শূন্যতার মাঝখানে। এরই মধ্যে তিনতলার বারান্দা থেকে উঁকি দিলেন অনসূয়া এবং সেখান থেকেই শুনলেন আমাদের আগমনের হেতু। এরপর নিজেই নীচে নেমে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন ওপরে। নিঝুম দুপুরে ভারী মোলায়েম লাগছিল পুরোনো বাড়ির পরিবেশ। তারই মধ্যে এক-পা দু-পা করে আমরা ঢুকে পড়লাম ইতিহাসের ইতিবৃত্তে।
জানা গেল দর্জিপাড়া মিত্র বংশের আদি পুরুষ হলেন, কালিদাস মিত্র। সাত- আটশো বছর আগে রাজা আদিশূর সূদূর কনৌজ থেকে বাংলায় সে সময় যে কায়স্থদের এনেছিলেন তাঁদেরই একজন হলেন এই কালিদাস। এরপর মিত্র বংশ বহু শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত হতে থাকে কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় তারা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কালিদাসের কুড়ি পুরুষ অধস্তন জগন্নাথ মিত্র কলকাতার কাছাকাছি আড়িয়াদহে বসবাস করতেন। ১৭শ শতাব্দী নাগাদ তিনি ভাগ্যান্বেষণে তখনকার সুতানুটির ‘হোগল কুরিয়া’ বা এখনকার দর্জিপাড়া অঞ্চলে এসেছিলেন। সেই থেকেই দর্জিপাড়া মিত্র বংশের শুরু। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র ছিলেন দুর্গাচরণ মিত্র। তিনি এক সময় ধনদৌলত এবং খ্যাতিতে সমাজে গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তাঁর বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার কোট জুয়েলার হিসেবে বাণিজ্য করা। ইতিহাস বলে এই দুর্গাচরণ মিত্রের সেরেস্তাতেই কাজ করতেন সাধক-কবি রামপ্রসাদ। সেরেস্তার খাতায় জরুরি হিসেবের বদলে তিনি লিখে ফেলতেন মায়ের নামগান। যাকে আমরা রামপ্রসাদী গান বলে জানি।
দুর্গাচরণের ভ্রাতুস্পুত্র নীলমণি মিত্রও ছিলেন তাঁর জ্যাঠামশায়-এর মতোই বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ। নিজের বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতায় তিনিও সমাজের বিশিষ্ট মানুষ হয়ে উঠেছিলেন এক সময়। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন ধনী জমিদার ও লবণের দেওয়ান, আবার অন্যদিকে ছিলেন একজন সুদক্ষ রত্ন বিশারদ। নিজের কর্মগুণে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নজরে আসেন। এরপর ইংরেজ সরকার তাঁকে আর্বিট্রেটর পদে নিযুক্ত করেন। এই পদে আসীন ব্যক্তিকে সে সময় বিভিন্ন মামলা-মকদ্দমায় বাদী-বিবাদী পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার কাজ করতে হতো। নীলমণি মিত্র তৎকালীন সময়ের বিশাল সম্পত্তির অধিকারি এবং প্রভাবশালী ছিলেন বলে তাঁকে এই পদের জিন্য নির্বাচন করা হয়। তবে এই মিডিয়েটর হিসেবে কাজ করাটাই তাঁকে বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করায়। একবার কোনও একটি মামলায় মধুস্থতা করার নির্দেশ দেয় ইংরেজ সরকার। কিন্তু যে শ্যলক এবং ভগ্নীপতির মধ্যে মামলাটি ছিল, তাঁরা দুজনেই ছিলেন নীলমণির প্রিয়জন। স্বভাবতই এই মামলায় তিনি মধ্যস্থতা করতে রাজি হলেন না, কারণ মামলার রায় যাঁরই বিপক্ষে যাবে তিনি নীলমনির ওপর বিরূপ হবেন। কিন্তু ইংরেজ সরকার মানতে রাজি হলো না। তারা বারংবার নীলমণির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকল। শেষপর্যন্ত যখন নীলমণির নামে সমন এল যে তিনি কাজটি না করলে তাঁকে গ্রেফতার করা হবে, তখন নীলমণি স্থির করলেন তিনি কলকাতা ছেড়ে কাশীবাসী হবেন। নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি সপরিবারে কাশী চলে গেলেন এবং এরপর ইংরেজ তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি ক্রোক করল। প্রায় নিঃশ্ব অবস্থায় তিনি কাশীতে কালযাপন করতে লাগলেন। এরপর তিনি কাশীতেই দেহ রাখলেন। এর পর কয়েক বছর পর তাঁর পুত্র কালীপ্রসাদও কাশীতেই মারা গেলেন। কালীপ্রসাদের স্ত্রী তখন ছোটো ছোটো ছেলেদের নিয়ে পড়লেন অকূল পাথারে। শেষপর্যন্ত তিনি তাঁর তিন নাবালক পুত্রকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন এবং দূর্গাচরণ মিত্রের উত্তরাধিকারীদের আশ্রয় গ্রহণ করে অতি দীন দরিদ্রের মতো জীবন কাটাতে লাগলেন।
এর কিছুদিন পর ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। কালীপ্রসাদের এক পুত্র প্রাণকৃষ্ণ একদিন খেলাচ্ছলেই কুমোরটুলির শিল্পীদের থেকে মূর্তি বানানো শিখে, গড়ে ফেললেন এক কালীমূর্তি। ছেলেবয়সে বানানো সেই মূর্তিতে তিনি মনের ভুলে দেবী প্রতিমার বাঁ পা এগিয়ে তৈরি করে ফেলেছিলেন। আদতে মায়ের ডান পা এগিয়ে থাকাটাই নিয়ম। তারপর বেড়িতেই সেই প্রতিমার পূজা করা হয় সাদামাটাভাবে। এরপরেই ঘটে আশ্চর্য ঘটনা। হতদরিদ্র পরিবারটির হৃত গৌরব যেন ফিরে আসতে থাকে।
কিছুদিন পর রামদুলাল সরকারের পরিবার থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসে। সেই সময় কলকাতায় রামদুলাল সরকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। আমেরিকার সঙ্গে ইমপোর্ট ব্যবসায় তিনি কেবল সুনামই অর্জন করেন নি, তিনি তখন কলকাতার বিশিষ্ট ধনকুবের। তবে তাঁর বেদনা ছিল একটিই। কুলীন অভিজাত কায়স্থ সমাজে তিনি তাঁর আদরের কন্যা বিমলার বিবাহ দিতে পারছেন না কিছুতেই। অনেক ভাবনা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত তিনি স্থির করেন, কোনও দরিদ্র ঘরে মেয়ের বিয়ে দিয়ে তিনি বিবাহসূত্রে কুলীন কায়স্থ সমাজে নিজের স্থান করে নেবেন। এরপরই বন্ধ কাশীনাথ ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি হাজির হলেন কাশী থেকে ফিরে আসা কালীপ্রসাদের দরিদ্র বিধবা স্ত্রীর বাড়িতে। প্রথমটায় আপত্তি করলেও শেষপর্যন্ত অবশ্য কালীপ্রসাদের স্ত্রী মেনে নিলেন বিবাহপ্রস্তাব। অর্থনৈতিক অবস্থার আকাশ-পাতাল ফারাক সত্ত্বেও রামদুলালের কন্যা বিমলার বিয়ে হল কালীপ্রসাদের পুত্র রাধকৃষ্ণের সঙ্গে। এর ফলে রাধাকৃষ্ণের হাত ধরে পরিবারেরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করল। প্রাণকৃষ্ণের খেলাচ্ছলে বানানো কালীপ্রতিমা যেন পরিবারে নতুন প্রাণপ্রতিষ্ঠা করল। সেই থেকে আজও কালীপুজো হয়ে আসছে মিত্র বাড়িতে। ২২৬ বছরের পুরোনো কালীপুজো এ বাড়ির দুর্গাপুজোর থেকেও প্রাচীন। এবং এখনও সেই প্রথম দিনের মতো এ বাড়ির কালীপ্রতিমার বাঁ পা থাকে এগোনো।
রাধাকৃষ্ণ ছিলেন ধীরস্থির, পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি কাজকর্মে শ্বশুরের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। রামদুলাল তাঁর প্রাসাদতুল্য বাড়ি সংলগ্ন কয়েক বিঘে জমি রাধাকৃষ্ণকে উপহার দেন। রাধাকৃষ্ণ তারই উপর বসবাসের জন্য এক সুরম্য ভবন তৈরি করেন। সেই বাড়িটিই অধুনা দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ি। রাধাকৃষ্ণ তাঁর শ্বশুরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘ম্যাকে, জর্জ অ্যান্ড কুলিজ’ নামে আমেরিকার এক মামকরা বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে রপ্তানি ও আমদানি ব্যবসা শুরু করেন। সাধুতা এবং বিশ্বস্তার জন্য রাধাকৃষ্ণের নাম আমেরিকার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ সে দেশের বোস্টন শহরের সালেম অঞ্চলে পি বডি মিউজিয়ামে তাঁর এবং তাঁর সহযোগী পুত্র রাজকৃষ্ণের পূর্ণাবয়ব মূর্তি স্থাপন করা হয়।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
এদেশে সোনাকে স্থিতি এবং ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...