jamdani

ঘুরে আসুন হীরক রাজার দেশে

ঘড়িতে ৮ টা বেজে ১০ মিনিট। তখনও অফিসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ করেই মােবাইল হােয়্যাটস অ্যাপ নােটিফিকেশন টোন বেজে উঠল। কাজ শেষ করে মােবাইল হাতে নিয়ে দেখি শ্ৰী-এর মেসেজ।‘তাের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। মনটা একটু উৎফুল্ল হয়ে উঠলেও তখনও ভাবিনি বাড়িতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে একটা বিশাল সারপ্রাইজ। বাড়ি ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই উত্তর এল ‘এই উইকেন্ডে আমরা বড়ন্তি যাচ্ছি। বাই রােড, বাইকে। হােটেল আমি বুক করে নিয়েছি। সপ্তাহের বাকি দিনগুলাে কেটে গেল চরম উত্তেজনায়। শুক্রবার অফিস থেকে ফেরার পথে বাইকে ফুল ট্যাঙ্ক তেল ভরে নিলাম। পরের দিন শনিবার সকাল ৭.৩০ মিনিটে বাইক স্টার্ট করলাম। ব্যাগ প্যাক করা ছিল আগের রাতেই। শুরু হল পথ শেষ না হওয়ার দিকে সফর। 

ভায়া ডানলপ বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এসে পরলাম নিবেদিতা সেতুতে। সেতু অতিক্রম করে বাইক ছােটালাম এসএইচ ২ রাস্তা ধরে। এবার ধরতে হবে এনএইচ ১৯ অর্থাৎ দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। এই জায়গায় একটু লক্ষ্য রাখতে হয়। প্রথম বাঁ দিকের রাস্তা ছেড়ে নিলাম দ্বিতীয় বাঁ দিকের রাস্তা। গিয়ে পড়লাম দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে। এবার নিশ্চিন্ত মনে বাইক ছােটালাম শক্তিগড় উদ্দেশ্য করে। বলতে দ্বিধা নেই, এই সময় আনমনেই গুনগুন করে উঠলাম ‘এই পথ যদি না । শেষ হয়’ গানটি। 

ডানকুনি পেরিয়ে শক্তিগড়। প্রায় টানা ৯০ কিলােমিটার বাইক চালিয়ে এই প্রথম বাইক থামালাম। রাস্তা তুলনামূলক ভাবে ফাঁকাই ছিল। শক্তিগড় পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। নেমে দু’জনে ঢুকে পরলাম আমাদের প্রিয় দোকান ‘ল্যাংচা নিকেতন’-এ। এতক্ষণ পেটে ছুঁচোয় ডন মারছিল। তাড়াতাড়ি করে শক্তিগড়ের বিখ্যাত ল্যাংচা অডার করলাম দু’টো প্লেটে দু’টো করে। প্রথম টুকরােটি মুখে প্রবেশ করতেই প্রাণ জুড়িয়ে এল। আহা, অপূর্ব সে স্বাদ। দু’টো ল্যাংচা শেষ করেই আরও একটা অডার করতে যাব, এমন সময় কানে ভেসে এল নারীকন্ঠের শাসন। অগত্যা শরীরের কথা ভেবে এবং জার্নির কথা মাথায় রেখে আবার স্টার্ট করলাম আমার পক্ষীরাজ।। 

প্রথমেই পড়ল বর্ধমান। একটু যানজট থাকলেও খুব বেশি বেগ পেতে হল না। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরেই পৌঁছে গেলাম পানাগড় হয়ে দুর্গাপুর। প্রায় ৮০ কিলােমিটার রাস্তা পৌঁছাতে সময় লাগল ১ ঘণ্টা। দুর্গাপুর এসেছি আর ভিরিঙ্গি মােড়ের লাকিদার চা খাবাে না— এমনটা কখনও হয় নি। অগত্যা বাইক ঘােরালাম লাকিদার দোকান (৯৮৫১৪৩৭১০৮) উদ্দেশ করে। চা খেয়েই বাইক স্টার্ট করলাম। আর সময় নষ্ট করা যাবে না। ৪০ মিনিটে অন্ডাল ও রানিগঞ্জ হয়ে প্রায় ৪৪ কিলােমিটার রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম আসানসােল। আর বেশি দেরি নেই। পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। থামা যাবে না। বরাকর রােড ধরে গাড়ি ছােটালাম। যেতে হবে ৪৫ কিলােমিটার, সময় লাগবে আর প্রায় ১ ঘণ্টা। প্রথমেই পড়ল নিমাতপুর চৌমাথা। সেখান থেকে বাঁ দিক নিয়ে চললাম সামনের দিকে। সামনেই দামােদর নদীর ব্রীজ। ব্রীজ অতিক্রম করে নেতুড়িয়া হয়ে পৌঁছতে হবে হারমাদ্দি হাসপাতাল। হাসপাতালের ঠিক পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছে সরু রাস্তা। গ্রামের মধ্যে দিয়ে বাইকে চড়ে যেতে যেতে এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর গ্রামের বাড়িগুলির বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে দেখলাম। পিছন থেকে শ্রী বলে উঠল, “দেখ, সাঁওতালী গ্রাম। কী অপূর্ব সুন্দর। ততক্ষণে পাহাড় চোখের সামনে। 

অবশেষে পৌঁছে গেলাম মন পলাশি রিসর্টে। পাহাড়ের তলায় ছােট্ট ছােট্ট কটেজ। এবার একটু ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার পালা। মধ্যাহ্নভােজ সেরে আবার দু’চাকায় দু’জনে বেড়িয়ে পরলাম। গন্তব্য জয়চন্ডী পাহাড়। গন্তব্য হীরক রাজার দেশে। এই জয়চন্ডী পাহাড়েই সত্যজিৎ রায় ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রটি শু্যট করেন। প্রায় ২৮ কিলােমিটার পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছে গেলাম জয়চন্ডী পাহাড়। সময় লাগল ৩০ মিনিট। এই অঞ্চলের পাহাড়গুলি বােল্ডারযুক্ত, অঞ্চলের অন্যান্য পাহাড় থেকে স্বতন্ত্র। পাহাড়ের চুড়ায় আছে মা জয়চন্ডীর মন্দির। প্রায় ৭০০ টি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় উপরে। কষ্ট করে উপরে উঠতে পারলে চারপাশের ভিউ মন মাতিয়ে দেওয়ার মত। পাহাড় থেকে নেমে আমরা ফিরলাম রিসর্টে। 

এবার আর বাইকে নয়, বেরিয়ে পরলাম হেঁটে, দু’জনে দু’জনের হাত ধরে। রিসর্টের পাশে বড়ন্তি পাহাড়ের কোলেই শুয়ে আছে মুরাদি লেক। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই লেকের ধারে পায়ে পায়ে পথ চলার মজাই আলাদা। লেকের উপর দিয়ে পাহাড়ের পিঠ বেয়ে সূর্য যখন ঢলে পড়ে দীগন্তরেখা জুড়ে, দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে যায়। চারপাশের পলাশ, পিয়াল, শাল, আমলকি, হরিতকী গাছগুলির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। 

পরের দিন অর্থাৎ রবিবার সকাল সকাল উঠেই বাড়িতে বানানাে লুচি-ছােলার ডাল খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম গড়পঞ্চকোট পাহাড়ের উদ্দেশে। সরবরী-পাঞ্চেত রােড ধরে বেরিয়ে পড়লাম। এই রাস্তার জার্নি মনে থাকবে সারাটা জীবন। যেহেতু সময়টা বসন্তকাল, চোখ যেদিকেই যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি থােকে থােকে সাজানাে পলাশ ফুল। বড়ন্তি থেকে ২৫ কিলােমিটার পথ অতিক্রম করে গড়পঞ্চকোট পৌঁছে গেলাম ৩০ মিনিটে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কাশীপুরের রাজা এই গড় বানিয়েছিলেন পাহাড়ের কোলে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সমস্ত গড় ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধুমাত্র পঞ্চরত্ন গঠনের রাস মন্দিরটি আজও ওই গড়ের সাক্ষ্য বহন করছে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ধ্বংস স্তুপ। প্রায় ১৮ বর্গ কিলােমিটার জুড়ে বিস্তৃত গড়পঞ্চকোট। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভােগ করতে করতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। হুশ ফিরল শ্রী-এর গলায়। বেলা গড়িয়ে আসছে। স্টার্ট দিলাম বাইক। মন পলাশে ফিরে মধ্যভােজ সারলাম। এবার ফেরার পালা। মন একবার বলে উঠলাে এখানেই থেকে যাওয়া যায় না বাকি জীবনটা?’ শ্রী হয়তাে মনের কথাটা বুঝতে পেরেই বলে উঠলাে আর দেরি করা ঠিক হবে না। কাল সকালেই অফিস। চল বেড়িয়ে পড়ি।মন না মানতে চাইলেও বাইক চালু করলাম। একরাশ স্মৃতি নিয়ে ফিরতে লাগলাম কলকাতার বাড়ির ঠিকানায়। 

কোথায় থাকবেন – 

মন পলাশ এবং মহুলবন রিসর্ট – ৮৯১০৯৪২৪৭০ ভাড়া- ১৮০০ টাকা প্রতি রাত, ট্রিপল বেড 

পলাশ বাড়ি – ৯০৫১৬১৬০১২ অথবা ৯৮৩১৫০৭৬৪৪, ভাড়া – ১০০০ টাকা প্রতি রাত, ডবল বেড 

কী খাবেন – 

সাধারণ খাবার, তবে বন মুরগি খেতে পারেন। হােটেল কর্তৃপক্ষকে বলে রাখতে হবে আগে থেকে। 

— কৌশিক পান

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes