পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য ভাল একটা খবর আছে।
অন্যদিন টিভির পর্দা থেকে চোখ সরায় না। আমি অফিস থেকে ফেরার পর সুসময়ী প্রথম কথাটা বলে সিরিয়ালের মাঝে কর্মাশিয়াল ব্রেকের সময়। তাকিয়ে দেখলাম, ভাল খবর দেবে বলল বটে, কিন্তু মুখটা তেতাে করে রেখেছে। আমাদের বিবাহিত জীবন প্রায় তিরিশ বছরের। সুসময়ীর মুখের রেখা দেখেই এখন বুঝতে পারি, কী বলতে চাইছে। বুঝলাম খবরটা মােটেই ওর পছন্দের নয়।
সারাটা দিন ভবানী ভবনে খুব ধকল গেছে। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের তলায় গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে। তবুও, খোঁচাটা হজম করে বললাম, “কী খবর?
সুসময়ী বলল, তােমার বােনঝির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
বাহ, শুনে সত্যিই মনটা ভাল হয়ে গেল। আমার বড়দিদি… টুবুনদি থাকে দিল্লিতে। ওর এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে টম চাকরি করে কোনও একটা সিকিউরিটি এজেন্সিতে। মেয়ে গুচ্চি ইংরেজিতে এমএ, বিএড। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায়। বয়স প্রায় তিরিশ হতে চলল। টুকুনদি অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছিল গুড্ডির বিয়ে দেওয়ার। দিল্লিতে বেশ কয়েকটা সম্বন্ধও এসেছিল। কিন্তু বেশিরভাগ প্রবাসী বাঙালির যেমন ইচ্ছে, টুকুনদিরও তাই। ছেলে-মেয়ের শ্বশুরবাড়ি হােক কলকাতায়।
টুকুনদি তেমন পাত্র পাচ্ছিল না। এই বছর দুয়েক আগেও, ফোন করে টুবুনদি প্রায়ই অনুরােধ করত, ‘দেবা, কলকাতায় তাে তাের প্রচুর চেনা-জানা। দ্যাখ না, যদি ভাল একটা ছেলে পাওয়া যায়।
চেনা-জানাদের মধ্যে কোনও ছেলেকে পছন্দ হলে আমি যখন বলতাম, ‘কথা বলে দেখব না কি? গুড্ডির সঙ্গে কিন্তু ভাল মানাবে’, তখন সুসময়ী ফোস করে উঠত, থাক, আগে নিজের মেয়ের বিয়ে কথা ভাবাে। অন্য কারাের ভাবনা তােমায় ভাবতে হবে না। আগ বাড়িয়ে সম্বন্ধ করতে যাচ্ছ। বিয়ের পর কোনও ঝামেলা হলে টুবুনদি কিন্তু সারা জীবন তােমায় দোষ দিয়ে যাবে।’ কথাগুলাে শুনলেই দমে যেতাম। সত্যিই তাে, বিয়েটা সুখের হবে কী না, আগে থেকে কি বলা যায়? পুলিশে কাজ করি। রােজই দাম্পত্য কলহ নিয়ে অভিযােগ, পাল্টা অভিযােগ আমাদের কাছে আসে। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা কত অসহিষ্ণু হয়ে গেছে! তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে আজকাল ব্রেক আপ হয়ে যায়।
নিজের মেয়ের বিয়ে নিয়ে দুর্ভাবনা অবশ্য এখন আমার নেই। মেয়ে তিতির নিজেই পাত্র পছন্দ করে রেখেছিল। সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার অমিতাভ। লেক গার্ডেন্সের দিকে থাকে। ও চলে যাওয়ার আগে সুসময়ই গিয়ে ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে বিয়ের পাকা কথা বলে আসে। গত বছর বিয়ে করে অমিতাভ আমেরিকায় নিয়ে গেছে তিতিরকে। মেয়ের বিয়ে এত নিঝঞাটে হয়ে যাবে, আমি ভাবতেও পারিনি।
আমি কোনও প্রশ্ন করার আগে সুসময়ী বলল, ‘জিজ্ঞেস করলে না তাে, গুড্ডির বিয়ে কোথায় ঠিক হল ?’
‘ছেলে থাকে সিডনিতে। ওখানকার কোনও হােটেলের শ্যেফ। পৈতৃক বাড়ি বারাসতে। ছােট ফ্যামিলি, বাবা-মা আর এক আনম্যারেড বােন। টুকুনদি বলল, পাত্র সিডনিতে হােটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনাে করতে গেছিল। ওখানেই সেটল করে গেছে। বিয়ে করে গেছে। বিয়ে করে সে না কি গুড্ডিকে সিডনিতে নিয়ে যাবে।
পাত্রের বায়ােডাটা বেশ ইম্প্রেসিভ। আজকাল হােটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ করে বহু বাঙালি ছেলে বিদেশে চাকরি করে বলে শুনেছি। তবুও, পুলিশে আছি বলে মনে একটা খটকা জাগেই। আমাদের কাছে প্রায়ই কেস আসে, বিদেশে চাকরি-বাকরি করে বলে এখানে এসে বিয়ে করে অনেকে। কিন্তু পরে দেখা যায়, ভুয়াে। বরের সঙ্গে বিদেশে যাওয়ার পর মেয়ে না কি আবিষ্কার করে, বর হােটেলে কাপ-ডিশ ধােয়। তখন মেয়েপক্ষের চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। টুকুনদি আবার এমন কোনও ভুল করে বসবে না তাে? বললাম, ছেলেটার সম্পর্কে টুকুনদি ভাল করে খোঁজ নিয়েছিস তাে?
‘বলল তাে নিয়েছে। দিল্লিতে ওদের কোন এক নবাবের ছেলে না কি সিডনিতে থাকে। সেই খোঁজ করে জানিয়েছে, পাত্রকে চেনে। টুবুনদি বলল, পাত্রের খোঁজ পেয়েছিল শাদি ডট কম থেকে। ছবি দেখেই না কি পাত্রপক্ষ গুড্ডিকে পছন্দ করে ফেলে। ওদের পুরাে ফ্যামিলি মাঝে দিল্লিতে গুড্ডিকে দেখতে গেছিল। পাত্রের বাবা সােনার হার দিয়ে ওকে আশীর্বাদ করে এসেছেন। শুধু তাই নয়, টুকুনদি আর গুড্ডিকে নিয়ে উনি তিনদিনের জন্য হরিদ্বারে বেড়াতেও গেছিলেন। সেখানে কোনও এক আশ্রমে তখনই বিয়ের তারিখটা ওরা ঠিক করে ফেলেন।
শুনে একটু অবাক হলাম। টুকুনদি এত বড় একটা ডিশিসন নিয়ে ফেলল, অথচ আমাকে একবারও জানাল না! কথাটা তুললে, সুসময়ী আমাকে ব্যঙ্গ করবে। তাই চুপ করে গেলাম। ভাবলাম, আমার সঙ্গে পরামর্শ টুকুনদি করতেই বা যাবে। কেন? গুড্ডির বিয়ের ব্যাপারে আমি তাে কোনও উদ্যোগ নিইনি। যাক, মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে টুকুনদি অনেকটা স্বস্তি পাবে। খুব কষ্ট করে গুড্ডিকে মানুষ করেছে। মাঝে একবার শুনেছিলাম, মেয়েটাকে নিয়ে টুকুনদি অসুবিধের মধ্যে পড়েছিল। ওর না কি মৃগি রােগ হয়েছিল। প্রায়ই সেন্সলেস হয়ে যেত। এখনও ওকে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। টুবুনদি একবার বলেছিল, ওর এই রােগের কথা শুনে, প্রায় পাকা হয়ে যাওয়া বিয়ের দু’একটা সম্বন্ধও না কি কেঁচে গিয়েছিল। চুপ করে আছি দেখে সুসময়ী বলল, “তুমি একবার ফোন করে টুকুনদির সঙ্গে কথা বলাে। কেন জানি না, আমার মনে হল, বিয়েটা ওরা কলকাতায় এসে দিতে চায়। পাত্রপক্ষ না কি সেটাই ডিম্যান্ড করেছে। আমি কিন্তু তােমায় সাফ বলে দিচ্ছি, আমার বাড়িতে বিয়ের ঝামেলা আমি নিতে পারব না। কলকাতায় গুড্ডির বিয়ে দিতে চায়, ওরা দিক। তবে, বাড়ি ভাড়া করে দিক।
কথা না বাড়িয়ে আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। মেয়ের বিয়ে উতরে দেওয়া কতটা ঝক্কির, সেটা আমি তিতিরের বিয়ে দিতে গিয়ে বুঝেছি। গল্ফ গ্রিনের একটা কমপ্লেক্সে আমার তিন কামরার ফ্ল্যাট। বিয়ের জোগাড় তাে বটেই, দূরের আত্মীয়স্বজনকে এনে রাখা, তাদের থাকা, খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা, সব মিলিয়ে আমার নাভিশ্বাস উঠে গেছিল। সেইসময় গুড্ডিকে খুব সাজিয়ে গুজিয়ে রাখত টুকুনদি। যাতে এখনে কোনও ছেলের চোখে পড়ে যায়। তিতিরের ছেলেবন্ধুরা বাড়িতে এলে গুড্ডির সাজগােজ আরও বেড়ে যেত। ব্যাপারটা ভালভাবে নেয়নি সুসময়ী। বিরক্ত হয়ে আমাকে বলত, ‘এমন গা ঢলানি মেয়ে জন্মে দেখিনি।
সাংসারিক কূটকাচালিতে কোনওদিন ঢুকিনি। তাই চুপ করে থাকতাম। টুকুনদির উৎকণ্ঠার কারণ আমি বুঝতে পারতাম। গুড্ডি আর তিতির কেউ কারও থেকে কম নয়। দু’জনেই সুন্দরী। লেখাপড়াতেও সমান সমান। তফাৎ শুধু বয়সে। গুড্ডির থেকে তিতির তিন বছরের ছােট। তিতিরের অত ভাল বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অথচ নিজের মেয়ের কিছু হল না, এই কষ্টবােধটা টুকুনদির মনে আসা স্বাভাবিক। একবার কথায় কথায় আমাকে বলেও ফেলেছিল, ‘মেয়ের পাত্তর জোগাড় করার হ্যাপা তােকে পােহাতে হল না। তাের কপালটা খুব ভাল রে দেবা। এককালে আমি বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছিলাম। এখন ফল ভুগতে হচ্ছে। একটা সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল টুকুনদি। সেই অপরাধবােধ এখনও ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম, সুসময়ী ফোনে যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। গলায় বিষ, ‘তুই তাে জানিস, টুকুনদির ওয়ান পয়েন্ট প্রােগ্রাম, আমার সঙ্গে পাল্লা দেবে। তিতির বিয়ের পর বিদেশে গেছে, ওর মেয়েকেও তাে পাঠাতে হবে। বলল বটে, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট থেকে ছেলের খোঁজ পেয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয়, তা না। এ ফেসবুকের বিয়ে। টিকবে না। গুড্ডির কপালে অশেষ দুঃখ আছে।
আর শুনতে ইচ্ছে করল না। মােবাইল ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে এলাম। ফোন করতেই ও পাশ থেকে টুবুনদি সেই একই কথাগুলাে বলল, যা সুসময়ীর মুখে শুনেছি। বাড়তি কথা, ‘স্কুলের চাকরিটা গুড্ডি ছেড়ে দিল। বিয়ের পর পাশপাের্টের জন্য অ্যাপ্লাই করবে। তখন তােকে একটু হেল্প করতে হবে ভাই। পুলিশ ভেরিফিকেশনটা যাতে তাড়াতাড়ি হয়ে যায়, তুই একটু দেখিস। পাশপাের্ট আর ভিসা হয়ে গেলেই গুড্ডিরা মাস ছয়েকের মধ্যে সিডনিতে চলে যাবে।
গুড়ির চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা আমার মনঃপুত হল না। শুনেছি, হাজার চল্লিশেক টাকার মতাে মাইনে পেত। বলতে গেলে, জামাইবাবুর পেনশন আর গুড্ডির রােজগারের টাকাতেই টুকুনদিদের সংসার চলত। গুড্ডির বিয়ে হঙে গেলে কী হবে? টম কি একা টানতে পারবে? ভরতুকির টাকাটা কে দেবে?
জিজ্ঞেস করলাম, “দিদি, পাত্রপক্ষ কিছু চায়নি? মানে, দেনা-পাওনার কথা বলছি।
টুকুনদি বলল, “না রে। গয়না-গাটি কিছু চায়নি। পাত্রের বাবা একেবারে মাটির মানুষ। বলেছে, এক কাপড়ে আপনি নয়নাকে সম্প্রদান করে দেবেন। আমরাই ওকে সাজিয়ে নিয়ে যাব। আর ফার্নিচার নিয়ে কী হবে? বিয়ের পর তাে ওরা এখানে থাকবে না। বিদেশে গিয়ে ঘর সংসার করবে। আসলে কী জানিস, ভদ্রলােক দীর্ঘদিন ডেনমার্কে ছিলেন। মনটা খুব উদার। হঠাৎ ফ্যামিলির টানে দেশে ফিরে এসেছেন। বারাসাতের বাড়িটাকে খুব সুন্দর সাজিয়েছেন। সেই ছবিও আমাদের পাঠিয়েছেন হােয়াটসঅ্যাপে। বলে গেলেন, বিয়ের পর গুড্ডির জন্য দোতলায় আলাদা ঘর বানিয়ে দেবেন।
পুলিশের মন তাে, তাই জিজ্ঞেস করলাম, “বারাসতে ওদের সম্পর্কে কি খোঁজ নিয়েছিস?
‘না, এখনও নেওয়া হয়নি। তাের জামাইবাবুকে তাে চিনিস। মেয়ের বিয়ে নিয়ে তার কোনও আগ্রহ নেই। প্রতি পদে পদে বাধা দিচ্ছে। আমরা ঠিক করেছি, বিয়ের হপ্তা দুয়েক আগে কলকাতায় চলে যাব। বেনারসি আর তত্ত্বের শাড়ি-টাড়ি, তখনই কিনে ফেলব। শুভর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। ও একমাসের জন্য একটা বাড়ি ভাড়া করে দেবে বলেছে। ওদের কৈখালির দিকে না কি সস্তায় বাড়িভাড়া পাওয়া যায়।
আমার ছােটভাই শুভ কৈখালিতে থাকে। তার মানে, টুকুনদি বিয়ের ব্যাপারে ওর পরামর্শ নিয়েই চলছে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে টুকুনদি যতবার কলকাতায় এসেছে, ততবারই আমার বাড়িতে উঠেছে। দু’এক বছর অন্তর গরমের ছুটিতে ওরা আসত। তখন টম আর গুড্ডি আমার খুব ন্যাওটা ছিল। ওরা তখন অন্য কোনও মামা বা মাসির বাড়ি যেতেই চাইত না। কেন জানি না, মনে হল, টুকুনদি ভালই করেছে, গুড্ডির বিয়েটা কৈখালিতে নিয়ে গিয়ে। ওখানে বিয়ে বাড়ি ভাড়া, কেটারিংয়ের খরচা, অনেক কমে হয়ে যাবে। তা ছাড়া, শুভ পার্টি করে বলে, ওই অঞ্চলের লােকজন ওকে বেশ সমীহ করে। ফোন ছাড়ার আগে টুকুনদিকে জিজ্ঞেস করলাম, “বিয়ের জন্য যদি টাকাপয়সার দরকার হয়, আমাকে বলিস। টুকুনদি বলল, “না রে ভাই। দরকার হবে না। গুড্ডি বলে দিয়েছে, কারও কাছে হাত পাততে হবে না। ও নিজের বিয়ের জন্য কিছু টাকা জমিয়েছিল। হালকা গয়নাও কিনে রেখেছে। আমার যা গয়না আছে, ওকে দিয়ে দেবাে। বড় একটা খরচ বেচে যাচ্ছে। তাের জামাইবাবু কী বেআক্কেলে বাপ শােন। বলে দিয়েছে, একটা পয়সাও দিতে পারবে না।ফলে টমকে ওর অফিস থেকে কিছু লােন নিতে হল।
আরও দু’চারটে কথার পর লাইন কেটে দিয়ে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, দেখি পিছনেই সুসময়ী দাঁড়িয়ে। বােধহয় আমার শেষ প্রশ্নটা ওর কানে গেছিল। জিজ্ঞেস করল, “কী বলল তােমার টুবুনদি? টাকাপয়সা চাইল?
মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, “না, সরাসরি না করে দিল। জেনে খুশি হবে, তােমাকে কোনও ঝক্কি পােহাতে হবে না। গুড্ডির বিয়েটা ওরা দেবে শুভর বাড়ি থেকে।
সুসময়ী বলল, “যাক বাঁচা গেল।
(২)
গুড্ডির বিয়ের কথা উঠলেই আজকাল বাঁকাচোরা কথা বলতে শুরু করে সুসময়ী। মাঝে মাঝে ফোনে ওকে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে শুনি। তখন টুকুনদি আর গুড্ডির উপর ওর আক্রোশ যেন ফেটে পড়ে। মেয়েটার এত ভাল বিয়ে হচ্ছে, অথচ মন থেকে ও কেন মেনে নিতে পারছে না, আমার বােধগম্য হয় না। শুভর বউ উর্মি মাঝে আমাকে একদিন ফোন করেছিল। কৈখালিতে ওদের প্রতিবেশী একটা মেয় খুন হয়েছে, সেই খবরটা জানানাের জন্য। কথা শেষ। হওয়ার আগেই ফোনটা আমার হাত থেকে কেড় নিয়ে সুসময়ী গলায় মধু ঢেলে জানতে চাইল, ‘গুড্ডির বিয়ের অ্যারেঞ্জমেন্ট কদুর কী করলি, বল।
স্পিকার অন করা আছে। উর্মির উত্তরটাও শুনতে পেলাম, ওরা তাে কাল সকালেই এসে পৌঁছচ্ছে, তােমাদের জানায়নি? সুসময়ী ভাঙবে, তবুও মচকাবে না। বলল, “তাের বাড়িতেই উঠবে তাে?
‘না, দিদি। শুভ ওদের জন্য বাড়ি ঠিক করে দিয়েছে। আমার বাড়ির খুব কাছে। দোতলা, একদম নতুন বাড়ি। শুভদেরই পার্টির এক কমরেডের। এখনও কেউ থাকেনি। টুকুনদি আর গুড়ি ওখানেই এসে উঠবে। খাওয়া-দাওয়া করবে আমার এখানে এসে। তুমি তাে জানাে, আমার শরীরটা বিগড়েছে। বাড়তি লােকের রান্নাবান্নার ধকল আমি নিতে পারব না। টুকুনদি তাই একটা রান্নার মাসি ঠিক করতে বলেছে। সব খরচ ওরাই দেবে। মাসি দিনে পাঁচশাে টাকা করে নেবে।। বউভাতের পরদিন পর্যন্ত রান্না করে দেবে।
‘ওদের সঙ্গে জামাইবাবু আসছেন না?
‘না, গুড্ডি নিয়ে আসতে চায়নি। ওঁর ট্রেনের টিকিটই কাটেনি। শুনলাম, জামাইবাবু নিজেই টিকিট কেটেছেন। আসবেন বিয়ের দু’দিন আগে। জানাে দিদি, ওঁর উপর টম আর গুড্ডির এমন রাগ, বিয়ের কার্ডে জামাইবাবুর নামটা পর্যন্ত দেয়নি। ‘কী বলছিস রে?
‘সত্যিই কি তুমি কিছু জানাে না দিদি? বিয়ের কার্ড নিয়ে টুকুনদি তাে তােমাদের ওখানে যাবে, তখন ওকে জিজ্ঞেস কোরাে, কেন জামাইবাবুর নামটা নেই। ফোনে শুভ অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল। গুড্ডি উত্তর দেয়নি, উল্টে না কি বলেছে, জামাইবাবু সম্প্রদান করলে ও বিয়েতেই বসবে না। রিলেসন এতই খারাপ হয়ে গেছে বাপ-বেটির মধ্যে।
গুড্ডির পক্ষ নিয়ে সুসময়ী বলল, ‘রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক উর্মি। জামাইবাবু বিয়ের কোনও উদ্যোগই নিতেন না। মেয়ের বিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ও মেয়ের বিয়ে দিয়ে লাভ নেই। ওর মেন্টাল ট্রিটমেন্ট দরকার। তিতিরের বিয়ের সময় গুড্ডি যখন এসেছিল, তখন ওকে দেখে আমার খারাপ লাগত রে উর্মি। ওর থেকে ছােট তিতিরের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, অথচ ও সংসারের জোয়াল টেনে যাচ্ছে। জামাইবাবুর কোনও হুঁশ নেই। কোন মেয়ে সেটা সহ্য করতে পারে, বল।
‘আমার তাে ভয়ই করছে, বিয়ের সময় যেন কোনও অশান্তি না হয়।
‘আমরা থাকব, কিছু হবেনা। যাক গে, তােরা কেনাকাটি করবি কোত্থেকে রে? “কেন আমাদের এখানেই। দিদি এখন বাগুইআটি-কৈখালিতেই সব পাওয়া যায়। আমাদের কলকাতায় যেতে হয় না।। টুকুনদি গলার হার দিয়েছিল। আমাকেও তাই দিতে হবে।
‘আমরা এখনও ঠিক করিনি দিদি।
‘ঠিক করিসনি, না কি আমায় বলবি না।
‘না দিদি, তােমাকে লুকিয়ে আমার লাভ কী? এই তাে মায়ের হার্ট অপারেশনের জন্য শুভকে লাখ দুয়েক টাকা খরচা করতে হল। ওর হাতে জমানাে টাকা কিছু নেই, উল্টে ধার-দেনাও হয়ে গেছে। আমি তােমাদের মতাে অত দামি গয়না দিতে পারব না গাে। লােকে যা-ই বলুক।
‘গুড্ডি কী বলছে? ওর সঙ্গে তাের কথা হয় ?
‘প্রায়ই ফোন করে। ওর আবদার শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে দিদি। আজকাল বিয়ের আগে সঙ্গীত না কি যেন অনুষ্ঠান হয়, সেটা করতে হবে। সেদিন মেহেন্দির ব্যবস্থা করতে হবে। কৈখালিতে মেহেদি লাগানাের লােক কোথায় পাবাে দিদি? শুভ অনেক খোঁজখবর করে সল্ট লেকের এক বিউটি পার্লার থেকে লােক ধরে আনছে। এই ফালতু খরচগুলাে না। করলেই নয়? এ দিকে তাে শুনি, জামাইবাবু কষ্টে সংসার চালায়। মেয়েটার মাথা বিগড়েছে।
‘হবু বরকে গুড্ডির পছন্ড হয়েছে?
‘খুউব। রানা ছেলেটা ডাউন টু আর্থ। গুড্ডির সঙ্গে জেল করে গেছে। দিনকাল পাল্টে গেছে দিদি। গুড্ডি বলল, ওরা যখন হরিদ্বারে বেড়াতে গেছিল, তখন একবেলার জন্য রানা না কি ওকে ইলােপ করেছিল। কোন এক হােটেলে আগেই হনিমুনটা সেরে নিয়েছে। এখন তাে মােবাইলে ওরা ঘন্টায় ঘন্টায় কথা বলে অথবা চ্যাট করে। মনেই হয় না, ওদের মধ্যে মাসখানেকের আলাপ। ফোনে রানার সঙ্গে গুড়ি আমার একবার কথা বলিয়েও দিয়েছে। টুকুনদি এলে আমাদের সবাইকে রানা একবার বারাসতে নিয়ে যাবে। যাবে না কি?
উর্মির কথাগুলাে এ দিক থেকে আমি শুনতে পাচ্ছি। কী সাংঘাতিক মেয়ে গুড্ডি! বিয়ের আগে হনিমুন সেরে আসার গল্প আবার জোঁক করে বলে বেরােচ্ছে! তাও গুরুজনদের কাছে। এতটা বদলে গেল কী করে? পাগল হয়ে গেছে না কি? উর্মির মুখে কথাগুলাে শুনে আমার অস্বস্তি হতে লাগল। এ কাজটা যদি তিতির করত, তা হলে সুসময়ী ওকে গলা টিপে মারত। বিয়ের আগে তিতির যে অমিতাভর সঙ্গে মেলামেশা করত না, তা নয়। কিন্তু একদিনও লেট নাইট করেনি।
তাকিয়ে দেখলাম, সুসময়ীর মুখে বিদ্রুপের হাসি। ও বলল, ‘যেমন মা, তেমনি তার মেয়ে। না রে, বারাসতে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আমরা গেলে একেবারে বউভাতে যাব। যাক গে, কোনও খবরটবর থাকলে দিস। এখন ছাড়ছি, কেমন? রিসিভারটা ক্রেডলে বসিয়ে সুসময় আমাকে বলল, “উর্মিটা কী চালাক হয়ে গেছে দেখাে। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে, বিয়ের সময় একমাসের জন্য বাড়িতে রান্নার মাসি রাখার ব্যবস্থা করে নিল। খরচটা টুকুনদি দেবে, কিন্তু ও আত্মীয়স্বজনের কাছে ক্রেডিট নেবে, গুড্ডির বিয়েটা ওই দিল। তুমি পারতে, তােমার বাড়ি থেকে বিয়েটা হলে, টুকুনদির কাছে টাকা নিতে?
হ্যা বললে পরে বিবেকের দংশনে ভুগবে। না বললে সুসময়ী খুশি থাকবে। চুপ করে থাকাই শ্রেয়। মৌন সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে সুসময়ী কিচেনে ঢুকে গেল।
কলকাতায় আসার পাঁচদিন পর এক রােববারে গুড্ডিকে নিয়ে টুকুনদি আমার বাড়িতে এল। মাঝে ফোনে একবারও আমার সঙ্গে কথা বলেনি। হয়তাে একদিন কেনাকাটায় খুব ব্যস্ত ছিল। এমনও হতে পারে, গুড্ডির বিয়ে নিয়ে সুসময়ীর কোনও কটাক্ষ আত্মীয়স্বজনদের কেউ টুকুনদির কানে তুলে দিয়েছে। তাই আমাদের উপর রাগ। আরও একটা কারণ থাকলেও থাকতে পারে। তিতিরের বিয়ের সময় দুয়াের ধরােনি নিয়ে একটা তিক্ততা হয়েছিল। গুড্ডিরা… তুতাে ভাইবােনেরা কুড়ি হাজার টাকা চেয়ে বসেছিল অমিতাভর কাছ থেকে। না দিলে বাসর ঘরে ঢুকতে দেবে না। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে তর্ক-বিতর্ক। আর সহ্য করতে না পেরে তিতির একটু কড়া কথা বলে ফেলেছিল গুড্ডিকে। সামান্য ঠাট্টা ইয়ার্কি নিয়ে রাগ। তিতিরের বউভাতে গুড্ডি যায়নি। মনােমালিন্যটা ছড়িয়ে গেছিল সুসময়ী আর টুকুনদির মধ্যেও।
নেমতন্ন করতে এসে কার্ড এগিয়ে দিয়ে গুড্ডি বলল, “মামু, বিয়ের দিন সকালে বড়মামিকে নিয়ে এসাে।”
নেমতন্নর ধরনটা আমার নিজেরই মনঃপুত হল না। আড়চোখে দেখি, সুসময়ীর মুখটা থমথমে হয়ে গেছে।
পরিস্থিতি যাতে গম্ভীর না হয়ে যায়, হেসে বললাম, সে কী রে। আমি তাে ভাবলাম, দু’দিন আগে থেকে আমাদের যেতে বলবি।
গুড্ডি বলল, ওখানে গিয়ে আর পাঁচজনের মধ্যে গাদাগাদি করে তােমরা থাকতে পারবে না গাে। তােমাদের তাে গাড়ি আছে, রােজ যাতায়াত কোরাে। কৈখালি তাে এমন কিছু দূরেও নয়।
টুকুনদি বলল, “কোনও রকমে বিয়েটা দিচ্ছি রে দেবা। তােরা আশীর্বাদ কর, বিদেশে গিয়ে মেয়েটা যেন ভাল থাকে।
আমার ইচ্ছে ছিল না, গুড্ডিকে এতদূরে পাঠানাের। কিন্তু রানাই বলল, আপনি চিন্তা করবেন না মা, তেমন হলে। আপনাকে আমি সিডনিতে নিয়ে যাব। দ্যাখ না, অন লাইনে আমার পাশপাের্টের জন্যও রানা অ্যাপ্লাই করবে বলছে। কথায় কথায় গুড্ডিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সিডনিতে গিয়ে তুই সংসার করবি, না কি তাের অন্য কোনও প্ল্যান আছে? গুড্ডি বলল, তােমার মাথা খারাপ মামু? তিতিরের মতাে আমি কিন্তু বসে থাকতে পারব না। আমার যা কোয়ালিফিকেশন আর এক্সপিরিয়েন্স, তাতে রানা বলছে, টিচারের চাকরিতে ওরা আমাকে লুফে নেবে। কিন্তু বাবা বলছেন, সিডনিতে গিয়ে তুমি আরও পড়াশুনাে করাে মা। পিএইচডি করাে। হাইয়ার স্টাডিজের জন্য ওখানে প্রচুর খরচ। যত টাকা লাগুক, আমি দেবাে।
‘বাবা’ ডাকটা খট করে কানে এসে বাজল। হবু শ্বশুরমশাইয়ের কথা বলছে। শ্বশুরবাড়ির গুণগান করতে লাগল গুড্ডি। সুসময়ীকে পাত্তাই দিল না। ফাঁক পেয়ে টুকুনদিকে একবার সুসময়ী জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রাণা আর গুড্ডির কুষ্ঠি মিলিয়েছ দিদি?
টুকুনদি জবাব দেওয়ার আগে গুড়ি বলে উঠল, ‘তুমি থামাে তাে বড়মামি। সেকেলে লােকেদের মতাে কথা বােলাে না। মা পন্ডিতকে ডেকেছিল। আমি বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি।’
বছর দুয়েক পর গুড্ডির সঙ্গে কথা বলছি। মনে হল, খুব অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছে। সম্পর্কের মর্যাদা দিচ্ছে না। বকাটা কাটা কথা শােনাচ্ছে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে আরও কয়েকটা তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলল গুড্ডি, ‘আত্মীয়স্বজনের কথা আর বােলাে না মামু। কারাের ভাল কেউ সহ্য করতে পারে না। এই তাে রানা সেদিন বলছিল, ওদের এক আত্মীয় ফলস্ কেসে ওকে জেলে ঢুকিয়েছিল। বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছে তাই হিংসে। আমি জানি, সবাই আমাকেও হিংসে করে। কিন্তু আমার মতাে ডিগ্রি আর কার আছে? আমার বয়সি কাউকে তাে আর নিজে রােজগার করে খেতে হয়নি। বাপের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সবাই জীবন কাটিয়ে গেল। বুঝলাম, খোঁচাটা তিতিরকে লক্ষ করে।
‘হা রে, জলপাইগুড়ি থেকে নীতিনকাকুরা আসছে?
গুড্ডি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, কে জানে? বিয়ের কার্ড দিল্লি থেকে পাঠিয়েছি। এলে আসবে। না এলেও ক্ষতি নেই। শােনাে মামু, আমার বিয়েতে কেউ আসুক না আসুক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। বিয়ের ব্যাপারে কেউ কোনও হেল্প করেনি। গত পাঁচ বছর ধরে মাম্মি কত লােককে রিকোয়েস্ট করেছে। কেউ গা করেনি| ঈশ্বর আছেন। ভাল একটা ছেলে আমাকে পাইয়ে দিয়েছেন।
আধ ঘন্টার মধ্যে টুকুনদিরা উঠে পড়ল। বারবার অনুরােধ করা সত্ত্বেও, চা পর্যন্ত খেল না। ওদের কৈখালি পৌঁছে দেওয়ার জন্য ড্রাইভারকে ডাকলাম। কিন্তু জেদ করে গুড়ি বলল, “থাক মামু। উবের করে এসেছি, উবেরেই চলে যেতে পারব। ওরা চলে যাওয়ার পর চোখ-মুখে জল দিয়ে এসে সুসময়ী রাগে ফেটে পড়ল, মেয়েটার কথা শুনলে? ইচ্ছে হচ্ছিল, ঠাস করে চড় মারি। কে ওকে হিংসে করে? তিতির? ওর বয়ে গেছে হিংসে করতে। একটা নষ্ট মেয়ে… দিল্লিতে একটা পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছিল। চার দিন পর ফিরে এসেছিল, সে কথা কি আমরা জানি না? তাের বিয়ের দায় কাঁধে নিয়ে মরব না কি? আমি বলে দিলাম দেবা, টুবুনদির মুখ চেয়ে শুধু বিয়ের দিন আমি যাব। ওর বউভাতে যাওয়ার রিকোয়েস্ট আমায় কিন্তু করবে না।
গুড্ডির জীবনে এই রকম একটা বিশ্রী অতীত আছে, আগে কখনও শুনিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘গুড্ডি পালিয়ে গেছিল, তুমি কী করে জানলে? কে বলল, তােমাকে?
‘কে আবার বলবে? গুড্ডির বাবা। আজ সকালবেলায় জামাইবাবু ফোন করে তােমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন। তুমি তখন বাথরুমে। এ বিয়ে নিয়ে ওঁর ঘাের আপত্তি। বার বার বললেন, দেবাকে বােলাে, বারাসতের এই ফ্যামিলিটার যেন। একটু খোঁজখবর নেয়। পাত্রের বাবাকে দেখে আর কথাবার্তা শুনে ওঁর মনে হয়েছে, ঘােড়েল টাইপের। শােনাে, তুমি আজই বারাসতে খোঁজ নাও। তােমাদের সার্কেল ইন্সপেক্টরকে বলাে, দু’তিনদিনের মধ্যে যেন খবর এনে দেয়।
সত্যিই মনে হল, এ বার খোঁজ নেওয়া দরকার। খারাপ কিছু হলে মেয়েটার জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। বারাসত পুলিশে আমারই ব্যাচমেট সতীনাথকে ফোন করে বললাম, একটা বিয়ের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া দরকার। পাত্র আর ওর বাবার নাম, ঠিকানা সব হােয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি পারিস, খবর নে।
তিনদিন পর রাতে টিভির সামনে বসে খবর শুনছি, এমন সময় আমেরিকা থেকে তিতিরের ফোন। যেন ফোনটার অপেক্ষাতেই ছিল। তাড়াতাড়ি রিসিভার তুলে সুসময়ী জিজ্ঞেস করল, “কীরে, কোনও খবর পেলি?
আমি শুনতে পাচ্ছি। ও প্রান্ত থেকে তিতির বলল, তােমার মােবাইলে গুড্ডিদির একগাদা ছবি পাঠিয়েছি। দেখেছ না কি? সুসময়ী বলল, ‘এখনও দেখিনি। কেন রে?’
‘বিয়ের আগে ছেলেটার সঙ্গে কী বিচ্ছিরি পােজে গুড্ডিদি ছবি তুলেছে, আগে দেখাে। ফেসবুকে প্রচুর ছবি পােস্ট করেছে।
মা, ওরা কবে হরিদ্বারে বেড়াতে গেছিল গাে? হােটেলে বিছানায় শুয়ে সেলফি! দিতে গুড্ডিদির লজ্জা করেনি?
ইন্সটাগ্রামেও কয়েকটা ছবি দিয়েছে। দেখলে তােমার চোখ কপালে উঠবে।
সুসময়ী জিজ্ঞেস করল, ‘ছবিগুলাে অমিতাভ দেখেছে না কি?
‘ওই তাে ফেসবুক ঘেঁটে সব বের করল। কাল বােধহয় গুড্ডিদি আর রানা আমাদের মতাে প্রিওয়েডিং ফোটো শুট করতে ভিক্টোরিয়া মেমােরিয়ালে গেছিল। আমি আর অমিতাভ যে যে পােজে ছবি তুলেছিলাম, গুড্ডিদিও সেই সেই পােজে ছবি তুলেছে। আমাকে পুরাে নকল করেছে মা। ও আমাকে এতটা হিংসে করে জানতাম না।
‘শুধু ফোটো শুটে নয়, সব ব্যাপারেই ও তােকে নকল করছে। যাক গে, তুই বাপীর সঙ্গে কথা বল মা। আমি ততক্ষণে ছবিগুলাে দেখি।
আজকাল সােশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কারাের সম্পর্কে কিছু জানা, এমন কোনও কঠিন ব্যাপার নয়। ফেসবুক ঘাঁটাঘাটি করলে সুদূর আমেরিকায় বসেও পার্সোনাল ডিটেলস জানা যায়। এই দায়িত্বটা মনে হয় সুসময় দিয়েছিল তিতিরকে। রিসিভারটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সুসময়ী প্রায় লাফ দিয়ে সােফা ছেড়ে উঠে গেল। মনােমত টপিক পেয়ে গেছে, তিতিরের সঙ্গে এখন অনেক রাত্তির অবধি মােবাইলে কথা বলে যাবে। এ দিকে ফোন ধরতেই তিতির বলল, ‘বাপী, টুবুন পিসি হােয়াটসঅ্যাপে আমাকে নেমন্তন্ন কার্ড পাঠিয়েছে। তােমার কি মনে হয়, গুড্ডিদির জন্য আমাদের কোনও গিফট পাঠানাে উচিত?
‘অমিতাভ কী বলছে?
‘ও তাে বলছে, পাঠানাে উচিত। আমরা ফসিল কোম্পানির দুটো ঘড়ি পাঠিয়ে দেবাে ভাবছি। বিয়ের দিনই কৈখালির ঠিকানায় পৌঁছে যাবে।
সারা বিশ্ব জুড়ে ফসিল কোম্পানির ঘড়ির খুব নাম। আমার জন্মদিনে তিতির একটা ঘড়ি পাঠিয়েছিল। যাক, বিয়ের সময়কার তিক্ততার কথা তিতির তা হলে ভুলে গিয়েছে। ঠিক এই উত্তরটাই ওর কাছ থেকে আমি আশা করেছিলাম। বললাম, “গুড ডিসিশন।
‘বাপী একটা কথা বলব? রানা ছেলেটা সম্পর্কে তুমি একটু খোঁজ নাও। কার্ড পাওয়ার পর আমি বেশ কয়েকবার কনগ্রাচুলেশন জানানাের জন্য দিল্লিতে ফোন করেছিলাম। প্রতিবারই গুড্ডিদি লাইন কেটে দিয়েছে। ও আমার সঙ্গে যতই খারাপ বিহেভ করুক না কেন, আফটার অল কাজিন তাে। ওর খারাপ কিছু হলে, আমারও খারাপ লাগবে।
তিতিরের গলায় উদ্বেগ। শুনে মনে মনে ঠিক করলাম, কাল অফিসে গিয়েই একবার বারাসতে সতীনাথকে ফোন করতে হবে। পরশু গুড্ডির বিয়ে। কাল এসে জামাইবাবু যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কী খবর পেলে, কোনও উত্তর দিতে পারব না।
(তিন)
সকালবেলায় ড্রয়িংরুমে বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় ডাের বেলের আওয়াজ। এত সকালে কাজের মেয়ে ছাড়া আর কেউ আসে না। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই আমি অবাক। দেখি, একটা কিট ব্যাগ হাতে জামাইবাবু দাঁড়িয়ে। এ কী! জামাইবাবু কৈখালিতে যাননি? মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে যেতেই উনি বললেন, ‘হাওড়া স্টেশন থেকে সরাসরি তােমার বাড়িতেই চলে এলুম শালাবাবু।
তিতিরের বিয়ের সময় শেষবার দেখা হয়েছিল। তখনকার তুলনায় চেহারাটা একেবারে ভেঙে গেছে জামাইবাবুর। দেখেই বােঝা যাচ্ছে, প্রবল মানসিক অশান্তির মধ্যে রয়েছেন। তাড়াতাড়ি বললাম, “আসুন, আসুন।
ঘরে ঢুকে সােফায় বসে জামাইবাবু বললেন, ‘বিয়ে বাড়িতে আর যেতে ইচ্ছে করল না। গুড়ি না কি বলেছে, আমি গেলে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে।
আরও কী সব বলতে যাচ্ছিলেন উনি। বললাম, “ওসব কথা পরে হবে। চা-টা খেয়ে আপনি আগে খানিকক্ষণ রেস্ট নিন। জামাইবাবুর গলা শুনে সুসময় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকে এসেছে। কাপটা এগিয়ে দেওয়ার সময় ও বলল, ‘আপনার মেয়ে আমাদেরও যেভাবে নেমতন্ন করে গেল, অন্য কেউ হলে বিয়ে বাড়িতে যেত না।
চায়ে চুমুক দিয়ে জামাইবাবু বললেন, ‘মায়ের ব্যাড ইনফ্লুয়েন্স। এছাড়া আর কী বলব। ছােটবেলা থেকে ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, তাের প্যারালাল, ফ্যামিলিতে আর কেউ নেই। আমার দিককার রিলেটিভদের তাে ও মানুষ বলেই মনে করে না। জেঠা কাকা-পিসিদের কাউকে নেমতন্নও করেনি। অথচ আমার এক ভাই থাকে বাগুইআটিতে। যাক সে কথা। তােমাকে যে কাজটা করতে বলেছিলুম, করেছ শালাবাবু? পাত্রপক্ষের খোঁজ কি নিয়েছ? সেটা জানার জন্যই আরও তােমার বাড়িতে এলুম।
শুনে আমার অস্বস্তি শুরু হল। কাল সকালে সতীনাথকে একবার ফোন করেছিলাম। ও বলেছিল, খবরটা আজই দেবে। এই প্রশ্নটারই মুখােমুখি হতে চাইছিলাম না। বললাম, ‘খবরটা আজই পেয়ে যাবেন।
ঘন্টাদুয়েক ঘন্টাদুয়েক বাদে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি, এমন সময় ফের ডাের বেল বেজে উঠল। সুসময়ী দরজা খুলে দিয়েই বলে উঠল, “আপনি! সকাল থেকে তাে আপনার কথাই হচ্ছে।
এরপরই সতীনাথের গলা পেলাম, “দেবাশিসকে ফোন করব ভেবেছিলাম। কিন্তু একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদারের জন্য কাল রাতে টালিগঞ্জে আসতে হল। তাই ভাবলাম, আজ সকালে বারাসতে যাওয়ার পথে আপনাদের এখানে ঘুরে যাব। খবরটা সামনাসামনি দেওয়াই ভাল হবে।
মেঘ না চাইতেই জল! ভালই হল, জামাইবাবু নিজের কানেই শুনতে পাবেন পুলিশ রিপাের্ট কী। ড্রয়িংরুমে ঢুকে বললাম, ‘কীরে, কিছু খবর পেলি?
সতীনাথ বলল, খবর ভাল না। তােদের পাত্তর রানা ওরফে কৌশিক বিশ্বাস একটা চিটিং কেসের আসামী ছিল। বছর দুয়েক দমদম সেন্ট্রাল জেলে কাটিয়ে এসেছে। ওরা তখন থাকত অশােকনগরে। ওর বাপ বিমল বিশ্বাস আরও ধুরন্ধর। একটা সময় সে নাকি কয়েকটা বছর ডেনমার্কে ছিল। ছেলে জেলে শুনে সে দেশে ফিরে আসে। কে হাইকোর্টে নিয়ে গিয়ে, প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করে ছেলেকে জামিনে বের করে এনেছে।।
এখন অশােকনগরের পাট গুটিয়ে চলে এসেছে বারাসতে করুণাময়ীর মােড়ে। এখনকার পাড়া প্রতিবেশীরা জানে, রানা অ্যাদ্দিন সিডনিতে হােটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়তে গেছিল।
সতীনাথের কথা শুনতে শুনতে সুসময়ীর মুখ দিয়ে আফসােসের “ইসস’ শব্দটা বেরিয়ে এল। হঠাৎই আমার চোখে পড়ল, গেস্ট রুম থেকে জামাইবাবু বেরিয়ে এসে সতীনাথের কথা শুনছেন। উনিই প্রথম প্রশ্নটা করলেন, “বাপ ছেলে এখন করেটা কী?
সতীনাথ বলল, ‘বিমল বিশ্বাস বামনগাছিতে একটা এনজিও খুলেছে। অসহায় মেয়েদের স্বনির্ভর প্রােজেক্ট চালায়। ওর কিছু কানেকশন আছে ডেনমার্কে। সেখান থেকে নিয়মিত ডােনেশন নিয়ে আসে। মেয়েদের দিয়ে কালা ধান্ধা করে।
দু’একটা কমপ্লেনও এসেছে থানায়। বারাসত পুলিশের কাছে খবর আছে, বাপ-ব্যাটা দু’জনেরই পেটে তেমন বিদ্যে নেই। এনজিওর কাজকর্ম বাড়ানাের জন্য ওরা এমন একজন শিক্ষিত মেয়েকে খুঁজছিল, ওদের দলে ভিড়ে যে বিদেশে করেসপন্ডেসটা করতে পারবে। দেবাশিস, তাের বােনঝি সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে।
ঘরে বাজ পড়লেও এমন চমকে উঠতাম না। জামাইবাবু ধপ করে সােফায় বসে পড়েছেন। রক্তশূন্য মুখে সুসময়ী আমার দিকে তাকিয়ে। ওর মুখের রেখায় একটাই প্রশ্ন, এখন কী হবে? তখনই সতীনাথ জিজ্ঞেস করল, “কী ভাবছিস দেবাশিস ? ছেলেটাকে তুলে আনব না কি? তাের রিলেটিভ বলেই বলছি, জেনে শুনে এই বিয়েটা হতে দেওয়া উচিত নয়।
উত্তরের খোঁজে আমার পুলিশ মস্তিষ্কেও তখন ঝড় বয়ে চলেছে। পেশাগত কতব, না পারিবারিক কুটকাচালি… কোনটাকে প্রাধান্য দেবাে, বুঝতে পারছি না। সুযােগ মতাে কেস করে রানাকে তুলে আনলেই তাে চলবে না। কোন অপরাধে ওকে অ্যারেস্ট করা হল, এমন কোনও আইন নেই। হ্যাঁ, বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য পুলিশ আপাতত একটা ফলস কেস। দিতেই পারে রানার বিরুদ্ধে। কিন্তু গুড্ডি চাইলে বিয়েটা পরে আটকানাে যাবে না। সবথেকে বড় কথা, পুলিশ কোনও অ্যাকশন নিলে টুকুনদি আর গুড্ডির মনে হতে পারে, এই ষড়যন্ত্রের পিছনে আমি আর সুসময়ী। ওদের উপর হিংসে করে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছি। এ সব কথা ভেবে বলটা আমি জামাইবাবুর কোর্টে ঠেলে দিলাম, আপনি কী চান?
বােধহীন চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে, কঠিন মুখে জামাইবাবু বললেন, ‘যা ভবিতব্য, তা হতে দাও শালাবাবু। যেচে উপকার করতে যেও না। আমার মেয়েকে তাে আমি চিনি। আট-দশমাস পর আমার ওখানেই আবার ওকে ফিরে আসতে হবে। মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকো তােমরা। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
এদেশে সোনাকে স্থিতি এবং ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...