অনেকদিন ধরে আমার ইচ্ছে ছিল কোনও এক অফ-বিট পাহাড়িয়া জায়গায় গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসা। যেখানে জনমানবের কোলাহল থাকবেনা, থাকবে শুধু নির্জনতা স্তব্ধতা আর প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্য্য। Dajeeling tourism র website -এর সৌজন্যে আমি আমার মনের মত এক জায়গার সন্ধানও পেলাম। তাকদা’! সাত পাঁচ কিছু না ভেবেই বুক করে দিলাম তাকদার বনবাংলাে Samio guist houre।
এই টুরে এ আমি–ই ছিলাম ম্যানেজার আর আমার under-এ ছিল ১২ জন। দেখতে দেখতে দিন ঘনিয়ে এল, ৬ ই জুন শনিবার আমরা ১২ জন পাহারীয়া এক্সপ্রেসে চেপে রওনা দিলাম পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। পরদিন, অর্থাৎ ৭ ই জুন বেলা ১১ টা নাগাদ আমরা পৌঁছােলােম এনজেপি স্টেশনে। স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ২ টো গাড়ি। আমরা পৌঁছােতেই গাড়ি করে আমাদের নিয়ে ছুটল চালক এনস্ এবং চালক প্রমােদ।
গাড়ি সমতল ছেড়ে যখন সর্পিল পাহাড়ি পথ ধরল তখনই অনুভব করলাম পাহাড়ি রােমাঞ্চ। তাকদার উচ্চতা 400 ft, তাই যত গাড়ি এগােতে থাকল ঠান্ডার যাত্রা তত বাড়তে থাকল। আর আমি মুগ্ধ হতে থাকলাম প্রকৃতির এই অপরূপ রূপ দেখে।
অবশেষে তিন ঘন্টার সফর করে আমরা পৌঁছােলাম তাকদা। তাকদা–র সৌন্দর্য বােঝানাের মত ভাষা বা ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই। যেন মনে হল চা বাগানের কাছে, মেঘ বালিকাদের কোলে এসে হাজির হয়েছি আমরা। বাংলােতে পৌঁছােনাের সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির কর্তা মি সােকতান বেরিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তাড়াতাড়ি আমরা ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ খেলাম। খাওয়াতে ছিল ভাত, ডাল, আলু ভাজি আলু ভেন্ডির তরকারি ডিমের ঝােল, সাঁকা পাঁপড়, স্যালাড আর আঁচার। প্রচন্ড খিদে পাচ্ছিল তাই এগুলাে আমাদের কাছে ছিল অমৃত!
অল্প বিশ্রাম নিয়ে টা নাগাদ আমরা কয়েকজন হাঁটতে বেড়ােলাম মিঃ মােকতান-এর কাছ থেকে জেনেছিলাম সে পায়ে হাঁটা দূরত্বেই আছে। অর্কিড সেন্টার। তাই ভাবলাম শুধু শুধু রুমে বসে না থেকে জায়গাটা ঘুরে দেখা ভাল।
অর্কিড সেন্টার যাওয়ার রাস্তাটা অসম্ভব নির্জন! রাস্তার দুধারে পাইনের জঙ্গল তার মধ্যে কুয়াশা ঢেকে রয়েছে। যে দিকেই তাকাই চারিদিকে শুধু কুয়াশার আস্তরণ। আর হবে নাই বা কেন ‘লেপচা’ ভাষায় তাকদা শব্দের অর্থই হল ‘কুয়াশা’! চারিদিকের পরিবেশ জুড়ে এক নাম-না জানা অর্কিডের গন্ধ, যেন নেশা লেগে যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য ছিল তাই পৌছােতে পৌঁছােতে অর্কিড সেন্টার বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যে নামার আগেই আমরা বাংলােতে ফিরে এলাম। বাংলাের পরিচারক ‘যুবরাজ’ আমাদের এসে বলে গেল চা রেডি। চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে বসলাম। পাহাড়ি এলাকায় ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে পড়ে। আর সন্ধ্যে হতেই চারিদিক নিঝুম। শুধু একটানা ঝিঁঝিঁর কর্ণসার্ট হতেই থাকল। সাড়ে আট টা নাগাদ আমাদের রাতের খাবারের ডাক পড়ল। গরম গরম রুটি আর বুনাে মুরগির ঝােল!
দ্বিতীয় দিনঃ সকাল আটটার মধ্যে আমরা স্নান করে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িও হাজির, সাথে প্রমােদ আর এনােস ভাইও। ওরাই আমাদের একাধারে চালক, পথ প্রদর্শক আবার গাইডও। প্রথমে আমরা গেলাম Lover point। এখানে তিস্তা আর রঙ্গিত মিলিত হয়েছে। এখানেই আমরা ব্রেকফাস্ট সারলাম গরম গরম মােমাে আর চা সহযােগে। কাল সারারাত খুব বৃষ্টি হয়েছিল তাই আজ চারিদিক খুব ভেজা ভেজা আর কুয়াশার চাদরে শোভা। সূর্য দেবতা সকাল থেকেই আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলছেন। তবুও মনের মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার আশা নিয়ে আমরা এগােলাম ‘তিনচুলের উদ্দেশ্যে। তাকদা থেকে দূরত্ব 3km। এনােস ভাই বলল এই তিনচুলে থেকে কাঞ্চনজঙ্গা কে এত ভালভাবে দেখা যায় যেটা কিনা টাইগার হিল থেকে ও দেখা যায় না। কিন্তু অনেক মানুষই সেটা জানেন না। যা ভেবেছিলাম তাই হল আমাদের ডাকে কাঞ্চনকন্যা সাড়া দিল না। কিন্তু যেটা দেখা দিল সেটাও কোনদিক থেকে কম যায়না। এক অপূর্ব মন পাগল করা নৈসর্গিক শােভা। যা দেখলে মন প্রাণ সব জুড়িয়ে যায়। পেঁজা পেঁজা তুলাের মতাে মেঘ গুলাে চা বাগনের মধ্যে যেন খেলা করছে। আমি ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যতটা সম্ভব চেষ্টা করলাম প্রতিটা মুহূর্তকে ক্যামেরাতে বন্দি করে রাখার এরপর আমরা এগােলাম কালিম্পং এর দিকে। তান্দা থেকে কালিম্পং-এর দূরত্ব 40km। ঢেউ খেলানাে সবুজ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়ি এগােতে থাকল। কালিম্পং যাওয়ার পথে আমাদের সঙ্গ নিল ‘তিস্তা। যাওয়ার রাস্তায় চোখে পড়ল যেখানে সেখানে সবজি নিয়ে বসে পড়েছে স্থানীয় লােকেরা আর মাশরুমের দোকান। একদম টাটকা, ঘরােয়া। কালিম্পং শহরটা একটু বেশি ঘিঞ্জি। রাস্তার ধারে গায়ে গায়ে লাগা দোতলা সব বাড়ির সারি। প্রত্যেক বাড়ির বারান্দায় বাহারি ফুলের টবে সাজানাে। রং-বেরং এর কাঠের বাড়ি বেশ লাগে দেখতে।
কালিম্পং এর সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট হল ‘ডেলাে পাহাড়’ আমরা ওখানে পৌঁছােলাম তিনটে নাগাদ। ডেলাে বাংলাে ঘিরে অসম্ভব সুন্দর করে সাজানাে। চারিদিকে নানা ফুলের সমারহ। অর্কিড বােগেনভলিয়া, গােলাপ, ম্যাঙ্গোলিয়ান লিলি আরও কত নাম না জানা ফুল। আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্গা আর বসে চলা তিস্তা কে স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। এরপর আমরা রওনা দিলাম ‘মঙ্গলধাম মন্দির’। ফেরার পথে ‘পাইন, ভিউ নার্সারি’ দেখে ফিরলাম। এশিয়ার মধ্যে ক্যাকটাসের বৃহত্তম সংগ্রহ এই নার্সারিতে।
তৃতীয় দিনঃ আজ আমরা ঘুরে দেখলাম তাকদার স্থানিয় স্পট গুলাে ৯ টার মধ্যে পুরি-সবজি চা সহযােগে ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গেলাম 12 km দূরে ‘লামাহাট’, নামে একটা ছােট্ট গ্রামে। খুব সাজানাে–গােছানাে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এই গ্রামের প্রধান আকর্ষণ হল রাস্তার ধারে বিরাট বাগান! তাতে নানা অর্কিডের ছড়াছড়ি। আর প্রকৃতির এই অপরূপ শৃঙ্গ কে কাছ থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপভােগ করার জন্য বাগানের মাঝে মাঝে বসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এখান থেকে সূর্যাস্তের সময় কাঞ্চনজঙ্গার কোলে ঢলে পড়া সূযকে বেশ লাগে দেখতে। এরপর আমরা গেলাম তাকদার আর এক আকর্ষণ দেখতে, ‘Borbatey Heritage bridge’ এটা তাা ফরেস্টের হ্যাঙ্গিং ব্রিজ যা টুরিস্টদের দেখার জন্য অত্যন্ত আকর্ষণের জিনিস। এখান থেকে 10 km দূরে আমরা গেলাম ‘মংপু’ তে। বাঙালির মধ্যে কবিগুরু–র এক আলাদা জায়গা বরাবরই রয়েছে আর এতদূর এসে সেই কবিগুরুর বাড়ি দেখবনা এটা হতে পারে। তাই আমরা ‘মংপুতে গেলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ঘুরে দেখতে। কবিগুরু যে নীর্জনতা কতটা ভালবাসতেন শহর থেকে, লােকালয় থেকে এত দূরে, নির্জনে তার বসবাস দেখলেই বােঝা যায়। সত্যি, আজ এ–সব কিছু দেখে মনটা যেন আলাদা একটা শান্তি পেল, আত্মা যেন তৃপ্ত হল।
চতুর্থ দিনঃ আজ সকাল থেকেই মন ভারাক্রান্ত। আজ ফিরে যাওয়ার পালা। ঘুম থেকে উঠেই দেখছি আকাশের মুখ একদম ভার এবং একটু পরেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মন কিছুতেই মানছেনা সবুজের এই সমারহ ছেড়ে কংক্রিটের জঙ্গলে ফিরে যেতে। কিন্তু আমাদের একলেরই হাত–পা বাঁধা। ফিরে আমাদের যেতেই হবে। যাওয়ার বেলায় মিঃ মােকতা আমাদের সবাইকে উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানালেন। আমার মুখ ফুটে কিছুই বেরলাে না শুধু মনে মনে বললাম “আবার দেখা হবে।” একরাশ সুখ স্মৃতি সুটকেশ ভরে এবার শহরের দিকে পাড়ি দেওয়ার পালা!
কি করে যাবেন :
কলকাতা থেকে ট্রেনে নেউ জলপাইগুড়ি কিংবা বাসে শিলিগুড়ি পৌঁছে, সেখান থেকে গাড়ি করে তাকদা। নিউ জলপাইগুরি থেকে তাকদার দূরত্ব 60 km তাই গাড়িতে ভাড়া পড়বে 2500-2600/– গাড়িকে আগে থেকে বুকড করে রাখতে হবে। গাড়ির জন্য আপনারা যােগাযােগ করতে পারেন প্রমােদ ভাই (9002677771) এবং এনােস ভাই (8670563062, 9474963162) এর সাথে।
কখন যাবেন :
বর্ষাকাল বাদে যে কোন সময় যেতে পারেন। ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস যাওয়ার জন্য উপযােগী। ফেব্রুয়ারি মার্চ মাস নাগাদ গেলে প্রচুর কমলালেবুর চাষ দেখতে পাবেন এবং এই সময় চমৎকার আবহাওয়া ও পাবেন।
কোথায় থাকবেন :
সাধারণ পর্যটকদের কাছে তা এখনও ততটা জনপ্রিয় হয়ে না ওঠায় ভ্রমনার্থীদের চাপ এখানে কম। তাই এখানে থাকার জন্য একটি মাত্র জায়গা Sanio guest house এখানে থাকার জন্য মি: মােকতান কে ফোন করে আগে থেকে বুকিং করে রাখতে হবে মিঃ মােকতান : – 9434462806
যাওয়া-আসাঃ গোপালপুর-রায়পুর NH-17য় ১০০০ মি উচ্চে পাইনে ছাওয়া দারিংবাড়ি। বেলঘর... Read More
শীত এলেই অনেকের মনেই একটাই ভাবনা ঘুর ঘুর করে, সেটি... Read More
অফিস আর বাড়ি একটানা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাই সুযােগ... Read More
ইছামতী নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেখার ইচ্ছে ছিল অনেক আগে থেকেই।... Read More
পাহাড়ের কোলে ছবির মতাে সাজানাে এক আদিবাসী গ্রাম। পুরুলিয়ার শহর... Read More
রুমা প্রধান প্রকৃতি এবং অ্যাডভেঞ্চারকে একসঙ্গে চান? অথচ হাতে সময়... Read More
কোচবিহার থেকে মাত্রা ৩৫ কিলােমিটার দূরে তুফানগঞ্জএর রসিকবিল বিভিন্ন প্রজাতির।...
ঘড়িতে ৮ টা বেজে ১০ মিনিট। তখনও অফিসে কাজ করছিলাম।...
কিটু চট্টোপাধ্যায় বাইক কিনেছি মাসখানেক। একদিন হঠাৎ ইচ্ছা হল বাইক...
কলকাতার খুব কাছে একরাত কাটানোর জন্য মনের মত জায়গা। উত্তর...
পুরি থেকে মাত্র ১৪ কিলােমিটার দূরে। এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যশালী শিল্পকলা...
শহুরে বাতাবরণ, কোলাহল থেকে বেড়িয়ে হাত বাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলেই...
আদুরে মেয়ের মতাে আদুরিয়া। বর্ধমানের কাছেই এই বন আবাসনটি ভ্রমণরসিকদের...
পাহাড়ের কোলে ছবির মতাে সাজানাে এক আদিবাসী গ্রাম। পুরুলিয়ার শহর...
ওড়িশার একমাত্র শৈলগ্রাম কন্ধমাল জেলার দারিংবাড়ি। শাল, সেগুন, মহুয়ার বন,...
ঢেউটা আলতাে করে পা দুটো ছুঁয়ে ফের আপন খেয়ালে চলে...