সে ছিল আমাদের ছেলেবেলায়, শীতের মােলায়েম সােনালি রােদ, দুপুরের উষ্ণ ছাদ, সত্যিকারের দার্জিলিং-কমলালেবু। সারা শরীরে রােদ মেখে কমলালেবুর আস্বাদন। কমলালেবুর গন্ধে শীতের আবাহন। মাথার ওপর তামাটে নীল আকাশ। ডানা মেলা মন্থর চিল। হঠাৎ বেলা পড়ে আসবে। রােদ সরে যাবে গাছের মাথায়। উত্তর থেকে আসবে পাহাড়ের শীত শীত বাতাস। প্রবীণ মানুষদের মন স্মৃতি ভারাতুর। শােবার ঘরের খড়খড়ি জানলা বন্ধ। ঠান্ডা লাল মেঝে। খাট উষ্ণ বিছানা। ওয়াড় পরানাে লেপ পায়ের কাছে ভাঁজ করা। বড়সড় মাথার বালিশ, পাশবালিশ। মাথার ওপর নীল মশারি ঝুলে পড়ার অপেক্ষায়। শীতের বিছানার আলাদা এক আমেজ, আহ্বান। বড় আপনার। কোনও রকমে খাওয়াদাওয়া | সেরে, হাত ধােয়া হল কি হল না, লেপের আলিঙ্গনে গুটিসুটি। সারা রাত শীত হামাগুড়ি দেবে বরফ-শীতল লাল মেঝেতে। ঘরের কোণে। কোণে অদৃশ্য শ্বেতভল্লুক। বরফের দেশের বার্তা এনেছে। কাশ্মীর বরফের তলায়। এভারেস্টের উচ্চতা আরও কয়েক ফুট বেড়ে গেছে। অমরনাথের গুহায় বরফ জমছে শিবলিঙ্গের ছাঁচে।
নরম মােটা লেপের তলায় ফাঁকফোকর দিয়ে শীত ঢুকেছে সিঁদেল চোরের মতাে। পাশ ফিরলেই শরীর ছ্যাক করে উঠছে। গভীর রাত। দূরে কটা কুকুর কঁদছে। আশ্রয়হীন। গােয়েন্দা উপন্যাসে এই রকম শীতের রাতে আততায়ীরা বেরােয়। গায়ে ওভারকোট মাথায় কপাল ঢাকা টুপি। শ্মশানে চিতা জ্বলছে দাউ দাউ। সেই আগুনের উত্তাপ, আলােয় বসে আছেন তান্ত্রিক। শীতের দুপুর স্মৃতি ভারাতুর, শীতের রাত রহস্য, | রােমাঞ্চে ভরা। ছেলেবেলায় এমন রাতেই বেরােত নিশির ডাক। গভীর গলায় এক-একজনের নাম করে ডাকবে। হাতে একটা মুখ খােলা ডাব। যে উত্তর দেবে তার প্রাণটা চলে আসবে ডাবের জলে। খপ করে মুখটা ঢেকে দেবে। সেই জল খেয়ে বেঁচে উঠবে আর একজন। শীতের রাতে ল্যাম্প পােস্টের আলােগুলাে বড় একা। আলাের পাশে আলােছায়া। গুটিগুটি এসে জড়াে হয় আতঙ্ক। গাছের ডালে পাখির বাসা। মা-পাখি ডানা দিয়ে বাচ্চাদের ঢেকে রেখেছে। কখন রােদ উঠবে। আসবে আলাে আর উত্তাপ। মশারির ভেতর কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছেন দিদিমা।। মালা জপছেন। সেই কবে পৃথিবীতে এসেছেন! এই দুনিয়ায় সবই বেনিয়ম— আগে এসে পড়ে যায়, পরে এসে আগে। শীতের মন খারাপ করা উত্তুরে হাওয়ায় মৃত মানুষরা ভেসে আসেন বেঁচে থাকার গল্প নিয়ে। ভােরের শিশিরে রাতের কান্না। শীতের দিন তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। লম্বা হাইওয়ের মতাে লম্বা অন্ধকার রাত।
শীতকালে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা সেকালে একটু বিলাসী হতে চাইতেন। নানা রকম খাওয়ার পরিকল্পনা। তখন হাইব্রিড বিজ্ঞানে শাকসবজির জাত নষ্ট হয়ে যায়নি। প্রথম ফুলকপির অপূর্ব স্বাদ ও গন্ধ। ঠাস বাঁধাকপি। অপূর্ব কড়াইশুটি। দানাগুলাে নরম ও মিষ্টি। কচি কচি পেঁয়াজকলি। গােলাপি রঙের ছােটো ছােটো ছাঁচি পেঁয়াজ। গাজর। পালিশ করা কঁচালঙ্কা। বাজার ভর্তি মাছ। বাঁধাকপির সঙ্গে কড়াইশুটি আর ভেটকি মাছ। নানা রকম সবজি দিয়ে গরম গরম মুগের ডালের খিচুড়ি। গােটা গােটা ছাঁচি পেঁয়াজ দিয়ে মুসুর ডালের খিচুড়ি। টাটকা পালং শাকের ঘন্ট ছােটো ছােটো বড়ি দিয়ে। শীতের বেগুন এলােকেশী সুন্দরী। গরম গরম বেগুনি, ফুলাে ফুলাে মচমচে মুড়ি। এক বাটি মুড়ি খাঁটি সরষের তেল দিয়ে মাখা, সঙ্গে কড়াইশুটি, ফুলকপির ফুল, একটা আস্ত পেঁয়াজ, একটি নিখুঁত কাঁচালঙ্কা। সকাল দশটার মিষ্টি রােদে বসে খােলা। জায়গায় মুচমুচ করে খাওয়া। মাঝে মাঝে উত্তরে বাতাস। গাছের পাতা খসে পড়ার কাল। পাখিদের রূপ খুলে গেছে। আনন্দের নাচানাচি। ল্যাজ তুলে কাঠবেড়ালিদের ছােটাছুটি। ব্যাগ ভর্তি বাজারের আনন্দ নিয়ে কর্তামশাইয়ের গৃহ প্রবেশ। রান্নাঘরে জোড়া উনুন। দুধের সর তুলে তৈরি হচ্ছে গাওয়া ঘি। অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে সুগন্ধ। কামিনীভােগ চালের পায়েস হয়েছে। নবান্ন নিয়ে পৌষ আসছে, নানা রকম পিঠের প্রতিশ্রুতি। নতুন গুড়ের পাটালি। জয়নগরের মােয়া। শীতের হাওয়া আমলকীর ওই ডালে ডালে। লেপের তলায় সুখের ঘুম। দূর । থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের শব্দ। শীতল রাতে লােহার ইঞ্জিন একা একা চলেছে দেশ থেকে দেশান্তরে। নদী, সেতু অরণ্যপথ পেরিয়ে। বরফ-শীতল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। শীতের রাত কেমন হু হু শব্দ করে। কবরখানার মাটি থেকে প্রেত কুয়াশা ওঠে। গৃহহীন মানুষেরা খােলা ফুটপাথে কুঁকড়ে শুয়ে থাকে। কখন রােদ নামবে বড়াে বড়াে ইমারতের বাধা পেরিয়ে।
প্রবীণ চৌধুরী মশাই সারা বছর গঙ্গায় স্নান করেন। এক পােয়া ঝাঝালাে সরষের তেল শরীরকে খাওয়াবেন। আধ ঘণ্টার দলাই মালাই।। দু’আঙুলে তেল নিয়ে নাসিকায় সশব্দে টানবেন। প্রক্রিয়াটির নাম ন্যাস। দু’কানে দু’ফোটা। নাভীতে কিছুটা। তারপর সর্বাঙ্গে তৈল প্রয়ােগ চটাস চটাস, থপাস থপাস শব্দ। গঙ্গায় তীব্র বাতাস। তৈল প্রয়ােগে শরীর উষ্ণ। মনে বল। কীসের শীত! হিমালয়ে সাধুরা অনাবৃত দেহে বসে আছেন। স্থির ধ্যানে। শীত মনে করলেই শীত। মন্ত্র পড়তে পড়তে এক ডুব। কোথায় শীত! শীত দাঁড়িয়ে আছে ঘাটের সিঁড়িতে। জল থেকে উঠলেই ধরবে। এই স্নান এক প্রকার বীরত্ব। শরীর জড়িয়ে ধরবে রােদুর। শুকনাে কাপড়টি শরীরে জড়াবেন। বাঃ, পবিত্র ভাবের বেশ একটা আবেশ। ঠাকুরঘরে শালগ্রাম আছেন, দেবদেবীর পট। পূজার আসনে বসবেন। তারপর আহার। শীতকাল হল খাওয়ার কাল। থালা ঘিরে বাটির পর। বাটি। পশমের আসনে বসেছেন। তেঁতাে দিয়ে শুরু। মাছের মাথা। বাটা মাছ কড়কড়ে ভাজা। প্রথম পাতে গব্য ঘৃত, কয়েক রকমের ভাজা। শীতকালে হজমের সমস্যা নেই। নিশ্চিন্তে খেয়ে যাও। বাজারে বড়াে বড়াে গলদা চিংড়ি দেখে এসেছেন। হয়ে যাবে একদিন। খাওয়ার পরে শীতে ধরে। ইজি চেয়ারে রােদে বসে একটু আরাম করা। তন্দ্রা নামে চোখে। বেলা বাড়ছে, রােদ পালাচ্ছে। হাতে ছড়ি, গায়ে দামি শাল, মাথায় সাদা হনুমান টুপি, পায়ে পশমের মােজা, পালিশ করা চকচকে জুতাে। বৈকালিক ভ্রমণ। শীত বিত্তবানদের উপভােগের কাল। ওই ওপাশে পুকুরের ধারে কটা চালাবাড়ি। তাল-সুপুরির গাছ। তাল গাছের পাতায় ঝুলছে বাবুই পাখির বাসা। সামনের খােলা জায়গাটায় জ্বলবে পাতার আগুন। খেটে খাওয়া মানুষেরা গােল হয়ে বসে ওম নেবেন। মাঝে মাঝে হাত সেঁকবেন। বৈষ্ণবীর চালায় খঞ্জনি বাজিয়ে নাম হচ্ছে- জয় নিতাই। ছােটোদের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটু পরেই ঢুকে যাবে কাথার তলায়। সব আলাে নিভে যাবে। বাইরের খােলা জায়গাটায় উত্তরের বাতাস পােড়া ছাই নিয়ে একা একা খেলা করবে। বৃদ্ধা মানদা মাসির হাঁপানির টানটা বেড়েছে। ঠায় বসে আছেন। শ্বাসে সাঁই সাঁই শব্দ। কবিরাজ নিদান দিয়েছেন, পুরনাে ঘি নালিশ করতে হবে। বড় কষ্টের রাত। সবাই কঁাথার তলায়। একা বৃদ্ধা জেগে, জীবনের দিন গুনছেন। ললিতার যৌবন চলে গেছে। সেই সব কীর্তনের আসর অতীত। এখন শেষ দিনটির অপেক্ষায় বসে থাকা।
মিত্তির সায়েব হাইকোর্টের ব্যারিস্টার। শীত পছন্দ করেন। বিলেতের ক্লাইমেট। দামি স্যুট পরে ক্লাবে যান। দু-চার পেগ হুইস্কি, সঙ্গে কাটলেট, ফিশ ফ্রাই। অ্যারিস্টোক্র্যাটদের সঙ্গে গল্পগুজব। শীতটাকে আরও বেশি এনজয় করার জন্যে সিমলায় যাবেন, তখন ওভারকোট পরবেন, মাথায় হ্যাট, হাতে স্টিক। ফায়ার প্লেসের সামনে বসে পাইপ খাবেন। জিম করবেটের শিকার কাহিনী পড়বেন। শীত হল সায়েবদের কাল। নিরঞ্জন বললে, শীতকালে আমার জলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকে না। ড্রাই ওয়াশ। চানটান যা কিছু সব সেই দোলের পর। বাঙালির বােলবােলা শেষ হয়ে গেছে, যা ছিল ইংরেজ আমলে। শীতকালে সম্পন্ন বাঙালিরা সপরিবার বায়ু পরিবর্তনে যেতেন চেঞ্জে। সাঁওতাল পরগনায়, মধুপুর, শিমুলতলা, গিরিডি, সায়েবগঞ্জ। ওই সব জায়গা তখন চেঞ্জারে গমগম করত। হাটে গিয়ে বাজার করতে করতে বলতেন- কী শস্তা ! ড্যাম চিপ, ড্যাম চিপ। স্থানীয় মানুষরা চেঞ্জারদের বলতেন ‘ড্যানচি বাবু।
এখন সব এলােমেলাে হয়ে গেছে। ছটা ঋতু আর খেলা করে না। শীতের আকাশ থেকে ঝকঝকে সােনা রােদ আর ঝরে না। ম্যাড়মেড়ে রােদ, ঝাপসা ধোঁয়া ধোঁয়া দিন। মনমরা দুপুর। বায়ুদূষণ। নতুন একটা জগৎ বেরিয়ে এসেছে বিজ্ঞানের হাত ধরে ‘সাইবার ওয়াল্ড’। মানুষও ক্রমশ হাইব্রিড হয়ে যাবে। অকালপক্ক, দরকচা মারা। এর পর বাঙালি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঋতু যেমন হারিয়ে গেছে, সেই একই অবস্থা হবে। লাঠি ঠুকঠুক করে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া এক বৃদ্ধা চলেছেন। গায়ে খাদির চাদর। এই হল শীতকালের রূপ গুটিসুটি, জড়ােসড়াে। ঠান্ডা জল যেন সাপের ছােবল।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
এদেশে সোনাকে স্থিতি এবং ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...