রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে সরে গেল ঋক। কিচেনে গেল। একটু কফি খেতে ইচ্ছে করছে। আজ ঠান্ডা জাঁকিয়ে পরেছে। ওয়েদার রিপাের্ট বলছে কলকাতায় দিনের বেলাতেই এগারাে ছিল। এখন এই রাত বারােটা নাগাদ নির্ঘাত নয়-দশ হবে। এমন ঠান্ডা খুব কমই পড়ে। গােটা শহর ঠান্ডায় জবুথবু।
আজ রবিবার। ঋকের অফিস ছুটি। শনি-রবি দুই দিন অফিস ছুটি থাকে। এই দুটো দিন ঋক সারাদিন নিজের ইচ্ছে মতাে কাটায়। শুয়ে ঘুমিয়ে আলস্যে কখনও বা মুভি দেখে। ও চাকরি করে একটা জার্মান কোম্পানিতে। ডেস্কজব। ভাল স্যালারি। স্কুল বয়স থেকেই পড়াশােনায় ভাল। ছিল ঋক। শুধু পড়াশােনা নয়, খেলাধুলােতেও। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় প্রথম স্কুল থেকে অযােধ্যা পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিল। জীবনে প্রথম সেই পাহাড় দেখা। চুড়ান্ত মুগ্ধতা। তিনদিনের সফর। পাগল হয়ে গেছিল ঋক। না ফেরার ইচ্ছেটা এতই প্রবল হয়েছিল যে ফেরার দিন সকালে নিখোঁজ হয়ে গেছিল। বন্ধুরা প্রচুর খুঁজে শেষে পাহাড়ের কাছে গ্রামের একটা পরিত্যক্ত বাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার করেছিল ওকে। ওখানে লুকিয়ে ছিল। অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে ফেরানাে হয়েছিল ওকে। তারপর থেকে প্রতি বছর অযােধ্যা পাহাড়ে ছুটে গেছে ঋক। তা সে বসন্ত পূর্ণিমা হােক বা ঘাের বর্ষা, জানুয়ারির কনকনে ঠান্ডা হােক ধু ধু মে মাস। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়প্রীতিটাও যেন জাঁকিয়ে বসেছিল ঘাড়ের ওপর। অযােধ্যা পাহাড় ছাড়িয়ে সেই প্রেম উত্তরবঙ্গের আনাচ-কানাচ থেকে উত্তর ভারত, সেখান থেকে দক্ষিণ ভারত। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকার কত জায়গায় যে কখনও একা কখনও বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরেছে। কত রকমের অভিজ্ঞতা। দীপশিখার সঙ্গে যখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পরিচয় হয়েছিল, পরিচয়ের কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল দুজনে মিলে এক্সপেডিশনের প্ল্যান করতে শুরু করেছে। হা দীপশিখার মধ্যেও ওই একইরকম উন্মাদনা। রােমাঞ্চের প্রতি চুড়ান্ত আগ্রহ। কলেজে পড়াকালীনই একটা গ্রুপ তৈরি করে বছরে তিন-চারবার পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া। আহা সেইসব দিন।
কী রে তাের হল? কম্পিউটারের সামনে বসে জোরে হাঁক পাড়ল দীপশিখা।
আনছি আনছি দাঁড়া। কফিটা বানিয়ে আবার দীপশিখার সামনে এল। একটা মগ দীপশিখার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অপরটায় চুমুক দিল। আহহহ! ঘড়িতে রাত একটা। প্রতি সপ্তাহে শনি-রবি ছুটির দিনগুলােতে বেশি রাত করেই শােয় ঋক আর দীপশিখা। এই অভ্যেস ওদের বরাবরের। বিয়ের চার বছর হয়ে গেল। এখনও একই অভ্যাস।
দীপু আর জাগিস না রে, এবার পেটেরটা খিস্তোবে তােকে। হেসে বলল ঋক।।
দীপশিখাকে ঋক আদর করে সংক্ষেপে দীপু বলে। আর দীপশিখা ঋককে বলে ঋ। এই চুক্তিটা হয়েছিল কলেজে পরিচয়ের কয়েকদিন পরেই। তখন বসন্তের শেষ। কলেজের কৃষ্ণচূড়া গাছটার মাথা এবং মাটি দুটোই লালে লাল। তার নিচে দাঁড়িয়ে ঋক বলেছিল, শােন দীপশিখা তাের নামটা খুব সুন্দর ঠিকই কিন্তু বড় বড়। যদি দীপু বলে ডাকি তাের আপত্তি আছে?
একটা শর্তে আপত্তি নেই। আমি তােকে শুধু ঋ বলে ডাকব। রাজি?
ডান। ব্যাস, সেই থেকে শুরু। তারপর দুইজনে একসাথে ওই কলেজ লাইফ থেকেই ঘুরে বেড়ানাে শুরু। কাছাকাছি ঘাটশিলা থেকে অযােধ্যা পাহাড়, শুশুনিয়া, সিকিম। পাহাড়ের প্রেম ওদের খুব কাছে নিয়ে এসেছিল। এইভাবেই ঘুরতে ঘুরতে একদিন দুজনের চাকরি। ফ্যাশন ডিজাইনিং এর স্পেশাল কোর্স করেছিল ঋক। ডিজাইনার হিসেবে জয়েন করল একটা কোম্পানিতে আর দীপশিখা একটা সিবিএসসি বাের্ড নামী স্কুলের ইংলিশ টিচার হয়ে। দুইজনেরই শনি-রবি ছুটি। ওই দিনটায় দুইজনে চুটিয়ে আনন্দ। নইলে বাকি পাঁচদিন ঋকের অফিস থেকে ফিরতে অনেকটাই রাত হয়। আবার দীপশিখার স্কুল সকাল সাতটা থেকে। ভাের ছটার মধ্যে স্কুলের গাড়ি চলে আসে। মাইক্রোবাস। টিচারদের জন্যেই বাসটা। স্কুল এবং বাড়ি নিয়ে আসা যাওয়া করে। সকাল সাতটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত স্কুল দীপশিখার। ঋকের অফিস এগারটা থেকে। ফলে একটু বেলা। পর্যন্ত ঘুমােয়। ঘুম থেকে উঠে দীপুকে বিছানায় দেখতে পায় না। শুধু শনি রবি সকালে দেখা হয়।
ঋক দেখল দীপশিখা একটু যেন ক্লান্ত। চার মাস হল ও ক্যারি করছে। দুজনের কারােরই এখন প্ল্যানিং ছিল না। অ্যাক্সিডেন্টালি হয়ে গেছে। কিন্তু জানার পর কেউই অ্যাবরশনের কথা ভাবেনি। সুতরাং…
ঋক বলল তুই এবার শুয়ে পড়। আর জাগিস না।
কেন রে ভাই? সবে তাে কলির সন্ধ্যে। অভি তাে রাত জওয়ান হ্যায়। বলে কোলের ওপর রাখা বালিশটাকে চেপে ধরল দীপশিখা।
তাের ঘুম পায় না?
তুই ঘুমাে। আমার ঘুম পাচ্ছে না। পাল্টা উত্তর দিল দীপশিখা। ও মন দিয়ে ওদের তিন বছর আগে ঘুরে আসা কাশ্মীরের ছবিগুলাে দেখছে। নভেম্বরে গেছিল। তখন চিনারট্রি তে আগুন রঙ ধরেছে। এবার পুজোর পরেই কাশ্মীর যাওয়ার প্ল্যান করেছিল চিনার ট্রি দেখবে বলে। যদিও এবার প্রথম নয়, এর আগে আরও দুইবার ওরা কাশ্মীর গেছে। একবার এপ্রিলে টিউলিপ গার্ডেন, আরেকবার জানুয়ারিতে বরফ দেখার জন্য। এবারে ছিল শুধু চিনার ট্রি।
নিশাতবাগের ছবিগুলাে মন দিয়ে দেখছিল। গােটা বাগানটায় যেন আগুন লেগে গেছে। দাউদাউ জ্বলছে বিশাল উঁচু গাছগুলাে মাটিতেও ছড়িয়ে রয়েছে সেই আগুন। কি অপরূপ সে আগুন! চোখ জুড়িয়ে যায়। এই সময়টা কাশ্মীরের আকাশে মাটিতে হাওয়াতেই আগুন রঙ ধরে থাকে। দুজনে জাস্ট মুগ্ধ হয়ে গেছিল। প্রচুর ছবি তুলেছিল দুজনে। ঋকের ডিএসএলআরটা যেমন ভাল, ওর ছবি তােলার হাতও খুব ভাল। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামে ওর অনেক ফলােয়ার শুধু ফটো দেখার জন্য।
উফফ ছবিগুলাে কী অসাধারণ না রে! আবার যাব।
তাের কী মনে হয়? ছেলে না মেয়ে?
ঋক কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ছেলে হােক মেয়ে হােক তার পিঠে আমি রুকস্যাক চাপিয়েই ছাড়ব।
শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল দীপশিখা। ওর গজদাঁতদুটো বেরিয়ে এল। সেদিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ঋক। এত সুন্দর লাগে দীপুকে হাসতে দেখলে। তাড়াতাড়ি আবার নিজের কাপে চুমুক দিল। দীপুর কাপটা খাটের ওপরেই রাখা। ধোঁয়া উঠছে। ঋক ল্যাপটপটা নিজের কাপে চুমুক দিল। দীপুর কাপটা খাটের ওপরেই রাখা। ধোঁয়া উঠছে। ঋক ল্যাপটপটা নিজের দিকে টানল। ওর পােস্ট করা ছবিগুলােতে ফ্যানফলােয়ার ফ্রেন্ডসরা লাইক কমেন্ট দেওয়া শুরু করেছে। যদিও ঋক আর দীপশিখার বাস্তব জগতের বন্ধুরা কেউই এইসব ফটোতে লাইক ইত্যাদি কিছুই করে না।
কফি শেষ করে সিগারেট ধরাল ঋক। দীপা ঋকের দিকে তাকাতেই সঙ্গে ওহ সরি বলে সিগারেটটা নিভিয়ে দিল। ওদের মধ্যে একটা চুক্তি হচ্ছে। দীপার প্রেগন্যান্সি টাইম থেকে বেবি একটু বড় হওয়া পর্যন্ত দুজনেই স্মােকিং থেকে বিরত থাকবে। ঋক স্মােক করতে পারবে কিন্তু সেটা বাড়িতে কখনই নয়। আর যদি ঋক স্মােক করে তাহলে দীপশিখাকেও কাউন্টার দিতে হবে। ওরা চিরকালই কাউন্টার ভাগ করে খাওয়া পাবলিক। কিন্তু এই সময়টায় দীপশিখার সিগারেট খাওয়া পুরাে বারণ। তাই এই চুক্তি। কিন্তু ঋকের অভ্যেসটা এখনও পুরােপুরি রপ্ত হয়নি। সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে জিভ কেটে হাসল ঋক।
লজ্জা করে না তাের? হেসেই জিজ্ঞাসা করল দীপশিখা। খুব করে ওইজন্যই তাে নিভিয়ে দিলাম।
ঋ
উ….
আমরা আবার কবে যাব রে?
দীপুর চোখের দিকে তাকাল ঋ। ও জানে একজন ভ্রমণবিলাসীর পক্ষে দিনের পর দিন বাড়িতে থাকা কী কঠিন।
এই তাে কয়েকটা মাস। তারপরেই.. কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ঋ আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল ল্যাপটপ নিয়ে। একজন কমেন্ট করেছে স্যার আপনার তােলা ছবির জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকি। পৃথিবীর কত জায়গায় আপনি ঘুরে বেড়ান। কত দুর্গম জায়গাতেও যান। আমি মুগ্ধ হয়ে ছবিগুলাে দেখি। আপনার সাহসের অন্ত নেই। আপনার সাহসকে শ্রদ্ধা জানাই।
ঋ কমেন্টটা পড়ে শােনাল দীপশিখাকে।
দীপশিখা হাসল।
ঋক কমেন্টের উত্তরে লিখল। পারবেন দাদা আপনি পারবেন। আমরা, যাদের বেড়ানাে সাধ আছে ষােল আনা কিন্তু সাধ্য নেই তাদের জন্য আপনার এই ছবিগুলাে অমূল্য। অনেকটাই সাধ মেটায়। বিশেষ করে ফটোর সঙ্গে থাকা আপনার বর্ণনাগুলাে। অসাধারণ স্যার।
অনেক ধন্যবাদ লিখে ঘর ছেড়ে ব্যালকনিতে এল ঋক। সিগারেট ধরাল। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। প্রথমেই এমন ঠান্ডায় কেঁপে উঠল ঋক। তারপর ঠান্ডাটা সইয়ে নিয়ে সিগারেটে লম্বা টান দিল। রাতের কলকাতা শহরের কুয়াশার মধ্যে সেই ধোঁয়া মিলিয়ে গেল। গােটা শহর ঘুমােচ্ছে আর ঋক তার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে একা। সিগারেট শেষ হওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
সাততলার ফ্ল্যাটের ফিফথ ফ্লোরে ঋক থাকে। ঋকরা ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে আবার বেডরুমে এল।।
কাল সােমবার। আবার অফিস শুরু। দীপশিখা কখন চলে যাবে ঋক টেরই পাবে না। ও তখন ঘুমে অচেতন।
দীপশিখার চোখ ল্যাপটপে।।
কী দেখছিস এত?
পুরনাে ফোল্ডার।
কই দেখি। ল্যাপটপ ঘুরিয়ে নিয়ে ঋক দেখল রাজস্থানের ফোল্ডার। ল্যাপটপে অনেকগুলাে ফোল্ডার রয়েছে। এক একটা ফোল্ডারের নাম সেই জায়গার নাম দিয়ে। শিলং, রাজস্থান, কাশ্মীর, অরুনাচল, হিমাচল, কালিম্পং। স্কুল লাইফে কেবি টেন ক্যামেরায় তােলা ছবির ঝাপসা প্রিন্টগুলাে থেকে আবার ছবি তুলে সফটকপি কম্পিউটারে রেখে দিয়েছে ঋক।
রাজস্থানের ফোল্ডারে কয়েকশ ছবি। এখানে প্রায় কুড়িদিন ছিল দুইজনে। প্রচুর প্রচুর ঘুরেছিল।
ঋ আমাদের হানিমুনের টুরটা মনে আছে? ঋককে উস্কে দিল দীপশিখা।
মনে নেই আবার ? ঝিমােনাে ভাবটা কেটে গেল ঋজুর। মনে পড়ল ওদের বিয়েটা। হঠাৎই দুইজনে ঠিক করল। ঋক একদিন দীপশিখাকে বলেছিল এই শােন আমাদের একটা ছােট কাজ সেরে ফেলতে হবে।
কী? বিয়েটা চট করে সেরে নিই চল।।
চল। সঙ্গে সঙ্গে রাজি দীপশিখা। রেজিস্ট্রির জন্য অ্যাপ্লাই পরের দিনই।
তার মাসখানেক পর কোনও সানাই নয়, রিচুয়াল নয়, শাঁখ উলু কিছু না। স্রেফ অফিসের কয়েকজন কলিগ আর বেড়াতে যাওয়ার টিমের কিছু বন্ধুবান্ধব। রেজিস্ট্রি করার পরদিনই দুইজনে কাঁধে রুকস্যাক চাপিয়ে রওনা হয়েছিল সান্দাকফুর দিকে। সে কী উত্তেজনা! চিত্রা সেখান থেকে ট্রেক করে টুংলু। রাতে সেখানে স্টে করে পরদিন আবার কালিপােখরি। সেখানে একরাত কাটিয়ে পরদিন বেলায় সান্দাকফু পৌঁছনাে।। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চতম স্থান। ট্রেকার্স হাটে দুইদিন থাকা। সে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। চারদিক ধু ধু করা ফাঁকা। চুড়ান্ত নৈঃশব্দ। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। ঋকের মনে পড়ল তখন পূর্ণিমা ছিল। রাত প্রায় এগারােটা নাগাদ আপাদমস্তক লেপকম্বল মুড়ি দিয়ে ঋকের ঘুমনাের চেষ্টায় তখন। দীপশিখা ওকে জোর করে বিছানা থেকে তুলেছিল। ওই পড়ে পড়ে ঘুমােচ্ছিস! শিগগির ওঠ। বাইরে একবার দেখবি আয় কী হচ্ছে! ঋক সাধের বিছানা ছেড়ে উঠতে চায়নি, কিন্তু দীপশিখার টানাটানিতে শেষে বাধ্য হয়েই চাপাচুপি দিয়ে হাটের বাইরে এসে স্রেফ হাঁ হয়ে গেছিল। গােটা আকাশ ঘন কালাে আর তার মাঝে এক উজ্জ্বল মুক্তোর মত চাঁদ জেগে রয়েছে। আর সেই চাদের আলােতে ঝলমল করছে। পাহাড়ের খাদে জমে শুয়ে থাকা মেঘপুঞ্জ। খাদের ওপারে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এতটাই কাছের আর এতটাই মােহময়ী লাগছিল যে মনে হচ্ছিল এই মেঘবিছানাে পথটুকু পায়ে হেঁটে পার হয়ে গেলেই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে স্পর্শ করা যাবে! ওই গভীর নিশ্চুপ রাত, তীব্র শনশন হাওয়া, চাদের ঘােরলাগা রূপ সব মিলিয়ে এমন অলৌকিক পরিবেশ রচনা করেছিল যে ঋক আর দীপশিখা দুজনেই বেশকিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ। তারপর ঋক শুধু ফিসফিস করে বলেছিল চল মেঘে লাফ দিবি? ওই নরম তুলাের মতাে উজ্জ্বল মেঘরাশি তীব্রভাবে টানছিল ওকে। দীপশিখা কিছু একটা আন্দাজ করে আর এক মুহুর্তও দেরি করেনি, ঋককে টেনে নিয়ে এসেছিল ঘরে।
গভীর একটা শ্বাস ছাড়ল ঋক। সেই দিনগুলাে… সেই দিনগুলাে…!
মন খারাপ করিস না ঋ।
চমকে উঠল ঋক। দীপশিখা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এখনও মেয়েটা ঋকের প্রতিটা মুহুর্তকে বােঝে দশ বছর আগে প্রথম পরিচয়ের পর দিন থেকেই দীপশিখা যেন ওকে পড়তে পারে, আগলে রাখে। সেদিনও রাখত। আজও…
না মন খারাপ করছি না। তুই আমার সঙ্গে রয়েছিস আমার আবার মন খারাপ কীসের।
দীপশিখা হাত বাড়াল। ঋক ছুঁল ওর হাতটা। সেই আগের মতােই উষ্ণ করতল দীপুর। দীপশিখার আঙুলগুলাে নিজের মুঠিতে নিল ঋক। ওর গা ঘেঁসে বসল। সেই মিস্টি গন্ধটা বেরচ্ছে। আচমকাই ঋক দেখতে পেল দীপুর গলা থেকে কাঁধ পর্যন্ত গভীর ক্ষত। লাল টকটকে ঘন রক্ত চুইয়ে পড়ছে।
আহ! কাতর শব্দ করে উঠল ঋক।
কী হল… কী হল ঋ। দীপু ঝুঁকে পড়ল ঋকের দিকে। ঝুঁকতে গিয়ে ওর গলায় জড়ানাে লাল মাফলারটা সরে গেল। নাহ ওই তাে ফর্সা নিটোল গ্রীবা দেখা যাচ্ছে। ইদানিং কী যে হয়! খালি হাবিজাবি জিনিস চোখে আসে।
তুই আমাকে নিয়ে বড় টেনশন করিস ঋ। আমার কিছু হবে না রে। আর কিছু হবে না।
দীপুর কথায় অল্প চমকে উঠল ঋ। কুঁকড়ে শুয়ে কান পাতল দীপুর ঈষৎ স্ফিত পেটের ওপর। স্পষ্ট শুনতে পেল আরেকটা খুব ছােট হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি। পুচকেটা বড় হচ্ছে একটু একটু করে। আর কয়েকটা মাস মাত্র। যেদিন প্রথম প্রেগটেস্টে পজিটিভ ধরা পড়েছিল সেদিন যে কী আনন্দ হয়েছিল ঋকের। দীপশিখাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়েছিল। ফ্ল্যাটের ছাদে দুইজনের অমন ছেলেমানুষী দেখতে পেয়ে বিল্ডিং এর অনেকেই মুচকি হেসেছিল। ঠিক দুই মাস পরেই জানুয়ারিতে দুইজনে বেরিয়ে পড়েছিল ইউমথাং ট্রিপে। ঋক একটু কিন্তু কিন্তু করেছিল, এই অবস্থায় যাবি?
আরে তুই দেখি এখন থেকেই সাবধানী হয়ে পড়ছিস! এরপর কি ভেতাে বাঙালি হয়ে যাবি নাকি? ছানাকে ভ্রুন অবস্থা থেকে বুঝিয়ে দেওয়া যাক ওর বাপ মা কেমন, তাহলে কিছুটা অভ্যস্ত হয়েই বেরােবে।
তারপর ব্যাগ গুছিয়ে সিকিম। গ্যাংটক তেকে লাচুং এর দিকে যাত্রা। টাটা সুমােতে। সেদিন তুমুল তুষারপাত হচ্ছিল। খুব। চারদিক ঢেকে গেছিল বরফে। ড্রাইভার ছেলেটা অল্পবয়সি। খুব মন দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। তুষারপাত এত বাড়ছিল যে গাড়ির চাকা ডুবে যাচ্ছিল। রাস্তায় সেদিন আর কোনও গাড়ি ছিল না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে আসছিল। কেমন অদ্ভুত নিঝুম একটা বিকেল…।
ঋক চুপ করে শুয়ে রইল দীপুর পেটে কান রেখে। টের পেল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে দীপশিখা। ঘুমিয়ে পড়ল ঋক। দেখা হল না ল্যাপটপে ওর কিছুক্ষণ আগে আপলােড করা ফটোগুলাের নিচে একজন কমেন্ট করেছেন, আপনার ছবিগুলাে আমি নিয়মিত ফলাে করি। কিন্তু আপনি কখনই নিজের ছবি দেন না। আমি আপনাকেও একবার দেখতে চাই। প্লিজ নিজের একটা অন্তত ফটো আপলােড করবেন। আর আপনার নামটাও জানতে চাই। অজানা যাত্রী নিশ্চয়ই আপনার প্রকৃত নাম নয়। প্লিজ আমার মতাে অনেক ফলােয়ারই কিন্তু আপনার পরিচয়। পেতে আগ্রহী। আশা করি নিরাশ করবেন না।
আজ সােমবার। ঘুম ভাঙল ঋকের। জানলার কাচ গলে শীতের রােদ এসে পড়েছে বিছানায়। চোখ মেলল ঋক। দেওয়াল ঘড়িতে বেলা সাড়ে আটটা। উঠে বসল। কাল রাতের কথা মনে পড়ল। ল্যাপটপটা অটো অফ হয়ে রয়েছে। বিছানায় ও একা। দীপা নেই। বিছানা ছাড়ল।। অফিসের জন্য তৈরি হতে হবে। ঠিক সাড়ে নটায় অফিসের বাস আসবে ওকে নিতে। লাঞ্চ অফিসের ক্যান্টিনেই করে। কিচেনে গেল চা বানাতে।
ঠিক নটা কুড়ি নাগাদ তৈরি হয়ে গেল ঋক। দরজায় কলিংবেল। ব্যাগটা নিয়ে ড্রয়িংরুমের মেন দরজার ঠিক মুখােমুখি দেওয়ালে টাঙানাে হাসিমুখ ফটোটার দিকে রােজের মতাে ঋক ফিসফিস করে বলল, বেরােলাম রে, সাবধানে থাকিস। আজ রাতে তাের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ফলস দেখতে যাব।
দরজা খুলল। সামনে দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাটের গার্ড। গত দেড় বছর ধরে তার রােজের ডিউটি ঋকের হুইলচেয়ারটা ধরে লিফটে নিয়ে যাওয়া। তারপর ওকে অফিসের বাসে ওই চেয়ার সমেত তুলে দেওয়া। না এইটুকু ছাড়া আর কোনও হেল্প কারও কাছ থেকে নেয় না ঋক। লাচুং থেকে ইউমথাং যাওয়ার পথে বিকেলের দিকে টাটা সুমােটা যখন আচমকাই স্কিড করে ওই উচু পাহাড় থেকে খাদে আছড়ে পড়েছিল, ঋকের যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন দেখেছিল ওর সামনে ঝুলে আছে দীপশিখার থ্যাতলানাে মাথাটা। ঘাড়টা ফালা হয়ে গিয়ে ঘন রক্ত গড়াচ্ছে। ঋকের দুটো পা-ই গুড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু যন্ত্রণা বােধ ছিল না, ওই অবস্থায় শুধু একবার ইচ্ছে করেছিল দীপশিখার পেটে কান দিয়ে শুনতে, বেঁচে রয়েছে। কি আরেকটা প্রাণ? ওই অবস্থায় সারা রাত। উদ্ধারকারীরা কখন এসেছিল কিছু জানা নেই। আর কোনও জ্ঞান ছিল না ঋকের।
বাস এল। ওকে চেয়ার সমেত তুলে দিল গার্ড। বাসে বসে থাকা কলিগদের মর্নিং জানিয়ে মােবাইল বার করে ভিক্টোরিয়া ফলসের সেরা ছবিগুলাে একটা বিশেষ পেইড সাইট থেকে ডাউনলােড করতে শুরু করল ঋক।
আজ রাতে দীপুর সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ফলস দেখবে ঋক। ওর পেটের ভেতরে যেটা বড় হচ্ছে সেটাও ঠিক শুনতে পাবে জলের অপরূপ শব্দ। পতনের শব্দ।
সন্দীপ মুখোপাধ্যায় - “নাম কী? থাকো কোথায়? কোন ক্লাস অবধি... Read More
এদেশে সোনাকে স্থিতি এবং ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।...
আমরা সবাই জানি যে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মাণ্ডের তিন প্রধান স্তম্ভকে...
লিপস্টিক আমার কাছে লিপস্টিক নয়। লিপস্টিক আমার কাছে প্রতীক। রং...
নাতাশা স্নান সেরে এসছে। সারাটা ঘরই এখন গন্ধস্নান করছে। একই...
পুলিশের উর্দিটা তখনও গা থেকে খুলিনি, সুসময়ী বলল, “তােমার জন্য...
শাে তখন জমে উঠেছে। শীতের সন্ধে। গায়ে ছিল হালকা জ্যাকেট।...
চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। খাবার মধ্যে এই। কিন্তু কথা ছিল...
সকাল বেলাটা আজকাল বিজনের বেশ সমস্যার। থিতু হয়ে প্রভাত উপভােগ...
রিশপের ছবিগুলাে সব ফেসবুকে আপলােড করার পর কম্পিউটারের সামনে থেকে...
লােকে ‘ব্যোমকেশ’ নামে ডাকেন। নতুন নামকরণ হয়েছে ‘সােনা দা। এদিকে...