jamdani

অন্য হিমাচলের খোঁজে

শ্রীমা সেন মুখার্জি

কালকা মেলের ‘পথে হল দেরি’ মাত্র ঘন্টা পাঁচেকের। অবশ্য চণ্ডীগড় যাত্রীদের কাছে এটা অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ। শেষ রাত্রের অন্ধকারে না নেমে, সকাল আটটার আশপাশ নামলাম। সময় সুবিধাজনক। ক্লাস ফোরে পড়া মেয়েকে মনে করিয়ে দিলাম, এই হল চণ্ডীগড় পাঞ্জাব- হারিয়ানা দুই রাজ্যের যুগ্ম রাজধানী। আবার নিজেও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, অদ্ভুতভাবে এ শহরের কোনও রাস্তার নামকরণ কোনও রাজনৈতিক নেতার নামে হয়নি। স্টেশনের বাইরে গাড়ি নিয়ে আমাদেরই অপেক্ষায় সেন্টিজি। আগামী দিনগুলোর সারথি, গাড়ি দেরির কারণে বেচারা অপেক্ষায় ছিল অনেকক্ষণ।

যাত্রা শুরুতেই প্রাতরাশের কথা মনে এল। চণ্ডীগড়ের বাইরে খুব ভাল জায়গা পাবার সম্ভাবনা নেই। শহরের মধ্যেই আলু-পরোটা টক দই সহযোগে উদরপূর্তি করে নলাম। গাড়িও তার পাকস্থলী ভরে নিল তরল জ্বালানিতে। চণ্ডীগড় শহরের ঘরবাড়ি পথ ঘাট সবই পরিকল্পনা মাফিক নির্মাণ। শহর ছাড়িয়ে পঞ্চকুল্লা সেক্টরকে পাশে ফেলে এগোলাম, দূরে দেখা যায় আবছা শিবালিক শ্রেণ।

ঘনবসতি কমে এল। চাষের খেত ধরা দেয় দ্ষ্টিসীমায়। সূর্যের তাপে ছ্যাঁকা লাগছে গায়ে। ডেরাবানী নামের জনপদ পার হলাম। পথে গাড়ি বা লোকজন সংখ্যায় খুব বেশি নয়। রাইপুর রানি আসতে কয়েকটা ‘চা-য় কি দুকান’ নজরে এল। মনের মধ্যে চা-ত্ষ্ণা। অতএব থামাও গাড়ি। আশেপাশে ধানের খেত। নুয়ে পড়া শিষ তার। মহিষের দলের পেছনে ছড়ি হাতে ছোট্ট ছেলে, হাতে লজেন্স দিতেই একগাল হাসি।ঝাঁকড়া গছের নীচে দড়ির চারপাইতে আয়েশ করে বসতেই হাতে গরম ভঁইসের দুধের চা। চা শেষ হতে না হতেই ড্রাইভারজির তাড়া। নারাইণগড় আসতে পাহাড় শুরু হল। গাড়ির কিছুটা কমল। কলাম্ব হয়ে নাহান পৌঁছাতে মাঝদুপুর। হিমাচলের যে জেলাতে আমরা রয়েছি তার নাম সিরমুর। নাহান বেশ বড়ো শহর। স্কুল, কলেজ, সরকারি অফিসে জমজমাট। আরও ৩৭ কম পথ বাকি। ৪৫ মিনিট একজায়গায় থেমে ছাড়া পেলাম। সবাই খিদেতে কাতর। গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হবে তাই বনেরি গ্রামের এক হিমাচলী ধাবাতে থামতে হল। পথের পাশে সাজানো গোছানো ধাবা। পুরো পরিবারের সবাই ব্যবসা সামলাচ্ছেন। অনেক নীচে বহে চলেছে জলাল নদী। খেতে খেতে নদীর নামকরণের গল্প শোনালেন বৃদ্ধা দাদিমা। ঋষি জমদগ্নির সঙ্গে রাজা সহস্রবাহুর সৈন্যদের যুদ্ধে রক্তাক্ত নদীর জল যখন লাল হয়ে যায় তখন থেকেই এই নদীর নাম হয় জলাল।

বনেরি ছেড়ে এগিয়ে দেখি অনেক নীচের গিরিখাতে জলাল মিশেছে গিরি নদীতে। বিকেল তিনটে নাগাদ গাড়ি থামে রেণুকাজি লেকের পাশে হিমাচল পর্যটনের সামনে। প্রথম দর্শনে মন ভরে যায়। অ্যালপাইন গাছের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলোটি এক কথায় অনবদ্য। রেনুকাজি সমুদ্রতল থেকে ৬৭২ মিটার উঁচু। অক্টোবরের মাঝামাঝি। শীত বা গরম কোনওটাই বোধ হচ্ছিল না। সময় নষ্ট না করে লেকের জলে বোটিংয়ে ব্যস্ত হলাম। চমৎকর দেখতে বোটগুলি। হাঁসের মতো, চারজনের বসার ব্যবস্থা। শেষ বিকেলের আলো মেখে লেকের পাশে পরশুরাম ও তার মা রেণুকাজির মন্দির, পূজারি জি প্রসাদ, আর্শিবাদ দিলেন। বটলব্রাসের ডালে পিউ কাঁহার তীব্র আকুতি। রাত নামে লেকের জল ছুঁয়ে।

আজ সকাল সকাল রওনা হলাম। লক্ষ্য ১৮০ কিমি পথ পেরিয়ে খাড়া পাথর। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। নদী আমাদের পথের সঙ্গী। ভাল লাগলে চলা। না হলে থামা। চা খাওয়া, ফোটো তোলা চলতে লাগল। হরিপুর ধুরে এসে ভাঙায়নী মায়ের মন্দিরে থামা। অনায়স সিঁড়ি পৌঁছে দিল মায়ের প্রাঙ্গণে। শিলারূপী মাত্মূর্তি। ডিসেম্বর থেকে মার্চ মন্দির চত্বর থাকে বরফ ঢাকা। পাহাড়ের এক উঁচু জায়গায় মন্দির চত্বর থাকে বরফ ঢাকা।পাহাড়ের এক উঁচু জায়গায় মন্দিরের অবস্থান। বেশি সময় নষ্ট না করে এগোতে হল। পথ চলতে চিনি নিচ্ছি চিরপাইন,ওক, ভুজ গাছ। রণহাটে-এ এসে লাঞ্চের ব্যবস্থা হলো। এখন সঙ্গী হলো তমসা নদী।যাকে স্থানীয়রা বলছেন টনস। মাইল ফলক দেখি। তাতে অনু, রিক্সাণু, এমন সব নাম পাই। কিন্তু খাড়াপাথরের খোঁজ নেই, অন্ধকার নামার ঠিক আগে টিউনি এসে পৌঁছাই। চায়ের দোকানের নড়বড়ে কাঠের কেবিনে বসে জানালার ফাঁক দিয়ে নজরে আসে নৃত্যরতা তমসা। কিন্তু প্রকৃতিতে মনোযোগ দিতে পারি না পথের দুশ্চিন্তায়। অন্ধকার পথধরে নামি হেডলাইটের আলোকে সঙ্গী করে সবাই যে যার ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করতে থাকি। অবশেষে সন্ধ্যে সাতটা চল্লিশে গাড়ি থামে খাড়াপাথরের গিরিগঙ্গা রিসর্টের সামনে।

হিমাচল সরকারের ব্যবস্থাপনা চমৎকার। ঘরগুলি আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ও আরামদায়ক। আজ ক্লান্তি অনেক। তাই শুয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি। পরের দিন সকালে পথে নেমে দেখি খাড়াপাথর এক ছোট্ট জায়গা। একটি মন্দির দেখলাম যাতে লম্বা এক পাথরকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করা হচ্ছে। এই পাথরের নামেই অঞ্চলটি খাড়াপাথর নামে পরিচিত। আশেপাশে অনেক আপেল গাছ নজরে এলেও সেগুলি ফলশূন্য। আপেল পেড়ে ফেলা হয়েছে। ব্রেকফাস্টের পর চললাম গিরিগঙ্গার উৎস দর্শনে। ৬ কিমি পথ। পাইন বনের মধ্য দিয়ে। পথের অবস্থা খুব খারাপ।গিরি গঙ্গার উৎস হিসেবে একটি সিংহের মুখ থেকে নির্গত ধারাকে মানা হয়। যদিও ভৌগোলিকভাবে অনেক ওপরে অবস্থিত একটি হিমবাহ-এর উৎস। কয়েকটি মন্দির রয়েছে। মাতা গিরিগঙ্গা,রাজা জব্বল, যোগীরাজ। এছাড়া রাম-লক্ষণ-সীতা-ব্রহ্মা, শিব, গণেশেরও মন্দির দেখলাম।

হিমাচল পর্যটক আবাসেরও নির্মাণকার্য চলছে। বিকেলে গন্তব্য দশ কিমি দূরের দেওরিও ঘাঁটি। এই পথের আপেল বাগানগুলি ফলে পরিপূর্ণ। দূর থেকে পাহাড়ি বসতির হলুদ টিনের চাল নজরে আসে। কাছ এসে বুঝি ভুট্টা শুকানো চলছে। আগামী শীতের রসদ। সূর্যাস্তের অপূর্ব কমলা রঙ নাগাধিরাজ হিমালয়ের চূড়াগুলিকে রং মাখিয়ে নেয় পশ্চিমে। মাথার ওপরে চক্রাকারে ঘরে চলে একদল শঙ্খচিল। তাদের ডানার ভর করে সন্ধ্যে নাম। অন্ধকার পথে গাড়ির জানালা দিয়ে দেখি আকাশের নক্ষত্ররা জায়গা করে নিয়েছে পাহাড়ের কোণে।

আজ খাড়াপাথরকে বিদায় দিয়ে নয় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছালাম জুব্বাল প্রাসাদে। জুব্বল বেশ জমজমাট জায়গা, প্রাসাদটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। প্রবেশে বিধিনিষেধ রয়েছে। আলাপ হল ম্যানেজারের ছেলে লোকেন্দর রাঠোরের সঙ্গে। বাঙালির ভ্রমণপ্রিয়তা সঙ্গে তিনি পরিচিত। তাই প্রাসাদ দর্শনে কোনও বাধা রইল না। রাজা যোগীন্দ্রচন্দ্র বর্তমানে সিমলায়। প্রাসাদ, বাগান, মন্দির সব কিছু দেখলাম। ২০০ বছরের পুরোনো প্রাসাদ তৈরিই হয়েছিল বিনা পারিশ্রমিকে দাসেদের বয়ে আনা পাথরে। কত মানুষের দীর্ঘশ্বাস মাখা এই প্রাসাদ। প্রাসাদ দর্শন সেরে এগোলাম রাজপরিবারের কুলদেবী পিড়িদেবীর মন্দির দেখতে। এখানে গিরিগঙ্গা বহমান। তার নাম বিসকুলটি। এগোলাম হাটকোটির পথে। পাব্বর নদীর সঙ্গে মিলন হয়েছে বিসকুলটির। সপ্তম- অষ্টম শতাব্দীর নির্মাণ হাটকোটি মন্দিররাজির। অনেক ওপর থেকেই নজরে আসে। মূল মন্দির মহিষমর্দিনী দূর্গার। পিতলের মূর্তি। দেবী এখানে হাটেশ্বরী নামে পরিচিত। পঞ্চপাণ্ডব বসবাসকালে এখানে এসেছিলন। তাই পাঁচটি ছোট মন্দিরও দেখলাম। মন্দির দর্শন সেরে পৌঁছলাম রোহরু। ঠিকানা হিমাচল পর্যটনের হোটেল চানসাল। রোহরুর উচ্চতা খুব বেশি না হওয়াতে ঘরে পাখা চালাতে হল। ব্যালকনিতে বসে সামনে বয়ে চলা পাব্বর নদীর নৃত্য দেখতে ব্যস্ত থাকলাম। লনের ওক গাছের পাতায় খেলা করছে বিদায়ী সূর্যের নরম আলো।

পরের দিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই আমাদের যাত্রা শুরু হল। যাব চানসাল পাস। সন্ধ্যের আগেই ফিরতে হবে সেই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে। মোট যাওয়া-আসা নিয়ে ১০০ কিমি।ঘুমন্ত শহর ছেড়ে এগোই চিরগাঁওয়ের পথে। ডানহাতে অন্ধ্র নদীর সর্পিল ধারা। ২০ কিমি এগিয়ে পৌঁছোই ঠিকরি। জনপদ জাগছে। জড়তা কাটাতে চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ি। পুল পেরিয়ে ডানহাতি পথ ধরি, পথের অবস্থা বেশ খারাপ। স্বাভাবিক কারণেই গতি কম। ৯ কিমি সামনে শিলাদেশ। পথের দুপাশে একটানা আপেল বাগান। লাল ও সোনালি দুই ধরনের আপেলই রয়েছে। মাঝে মাঝে শেডের ভেতরে মেশিনে আপেল বাস্কে ভরা চলছে। ফলন্ত গাছের ভার ধরে রেখেছে বাঁশের অবলম্বন। কোনও গাছে শুকনো পাতা জড়ানো। শেষ বসতি লহরি পেড়িয়ে যাই। আপেল বাগান, ট্রাকের সারি পড়ে থাকে অনেক নীচে। পাইন, দেওদার, চিরপাইনের দল ক্রমশ বিদায় নেয়। যে পাখির দল সঙ্গ দিচ্ছিল, তারাও কোথাও হারিয়ে যায়। কয়েকটি বিশাল চেহারার কুকুর নজরে আসে। চানসালের পাঁচ কিমি আগে ট্রি-লাইন শেষ। ফুলবিহীন রডোডেনড্রন। পাথরের গায়ে লালচে ঘাসের আলপনা। কেমন একটা শূন্যতা চেপে বসে। ডান হাতে কিছু দূরে সমান ঘাসে ঢাকা মাঠে পাথর সাজিয়ে ‘ওঁ’ অক্ষরটি লেখা। উচ্চতা ১২৩০৩ ফুট। সকাল ১০ টা ৩০ মিনিট। অসম্ভব ঠান্ডা হাওয়া। মনে হচ্ছে পৃথিবীর বাইরে কোনও দূর গ্রহে এসে পৌঁছে গিয়েছি সমস্ত জাগতিক সুখ-দুঃখের হাতছানি এড়িয়ে। মন বলে-‘ভাল হোক’। ‘সবার ভাল হোক’।

কিছু জরুরি কথা – বর্ষা ও শীত ছাড়া অন্য সময় যাওয়া যায়। চণ্ডীগড় বা সিমলা থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। থাকার ব্যবস্থায় হিমাচল পর্যটন সর্বোত্তম।

 

Trending

Most Popular


Would you like to receive notifications on latest updates? No Yes